শব্দার্থতত্ত্ব অর্থাৎ শব্দ ও অর্থের সম্পর্কবিচার, অর্থপরিবর্তনের কারণ ও পরিবর্তিত অর্থের নানা শ্রেণিভেদ সম্পর্কে ভাষাতত্ত্বের যে নিকটি গড়ে উঠেছে সেটিকে ভাষাবিজ্ঞানের আলোচনার আওতায় আনতে প্রথমদিকে অনেক ভাষাবিজ্ঞানীই নারাজ ছিলেন। তাঁদের মতে অর্থপরিবর্তন আসলে মানুষের মনের লের ফলশ্রুতি এবং যেহেতু এই মনকে বিজ্ঞানের সূত্র দ্বারা পুরোপুরি নির্দিষ্ট করা যায় না, তাই শব্দ ও অর্থের বিষয়টি ভাষাবিজ্ঞানের বিষয় হতে পারে না।
কিন্তু আধুনিক রূপান্তরমূলক সৃজনমূলক (Transformational Generative) ভাষাবিজ্ঞানে শব্দার্থকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কারণ যেহেতু ভাষার শব্দাবলীর দ্বারা বাক্য গঠনের আভ্যন্তরীণ নির্মাণের প্রক্রিয়াটির (deep structure) সঙ্গে অর্থ ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত। এর থেকে একটি জিনিস আমাদের কাছে স্পষ্টতা হ'ল শব্দার্থই যে কোনো ভাষার প্রাণ। এই ভাব বা অর্থ বাদে ভাষার কোনো উপযোগিতাই থাকে না। তাই শব্দার্থতত্ত্ব (Semantics) ভাষাবিজ্ঞানের একটি অপরিহার্য অঙ্গ।
ভাষার ধ্বনি পরিবর্তনেরও নানা কারণ আছে তেমনি অর্থ পরিবর্তনেরও নানা কারণ লক্ষ করা যায়। কিন্তু এই কারণগুলির সংখ্যা ও বৈচিত্র্য এত বেশি যে তাদের সবগুলিকেই একটিমাত্র আলোচনায় সীমিত করা কষ্টাসাধ্য। তবে বিভিন্ন ভাষাবিজ্ঞানীর পর্যালোচনা অনুযায়ী এই কারণগুলিকে প্রধানত দুটি শ্রেণিতে বিন্যস্ত করা যায়:
(১) স্থূলকারণ এবং
(২) সূক্ষ্ম কারণ।
আরও পড়ুনঃ খাঁটি বাংলা সন্ধি কাকে বলে?
এই দুই ক্ষেত্রেই আবার নানা উপশ্রেণিতে বিভাজিত হবার মতো কারণসমূহও লক্ষ করা যায়।
১) ভৌগোলিক বা ভিন্ন পারিবেশিক কারণ,
২) ঐতিহাসিক কারণ এবং
৩) উপকরণগত কারণ।
আসুন, প্রথমে এই তিনটি কারণে কীভাবে শব্দ তার অর্থ বদলে নেয়, বাংলা ভাষার শব্দ অনুযায়ী আমরা তা লক্ষ করি।
ভৌগোলিক বা ভিন্ন পারিবেশিক কারণ :
একই শব্দ ভিন্ন ভিন্ন ভৌগোলিক অঞ্চলে ভিন্নার্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন ধরুন ফার্সিতে প্রচলিত 'মুর্গ', শব্দটির অর্থ যে কোনো পাখি। কিন্তু আগন্তুক শব্দ হিসাবে বাংলাভাষায় প্রবেশ করে এর প্রয়োগ বিশেষ একটিমাত্র পাখি—মোরগ বা মুরগি (এক কথায় তৎসম 'কুক্কুট' অর্থে) বোঝাতে সীমাবদ্ধ হয়েছে।
একইরকমভাবে ফার্সী 'দরিয়া' শব্দটি মূলে 'নদী' বোঝালেও, বাংলায় এই শব্দটির অর্থ দাঁড়িয়েছে 'সমুদ্র। অনুরূপ কারণেই লক্ষ করুন আরও কত শব্দে এজাতীয় অর্থন্তর লক্ষ করা যায়- বাংলায় 'শাক' বলতে ভোজ্য উদ্ভিদকে বোঝালেও, ভারতের হিন্দিভাষী অঞ্চলে 'শাক' নিরামিষ তরকারি বোঝাতে ব্যবহৃত হয়।
ঐতিহাসিক কারণ :
জীবনযাত্রার পরিবর্তন অনেকসময়ই শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থকে পিছনে সরিয়ে ভিন্নতর অর্থকে সেইস্থানে প্রতিষ্ঠিত করে।
যেমন ধরুন 'আর্য' শব্দটি। বুৎপত্তি (ঋ + না = আর্য) অনুযায়ী এই শব্দের অর্থ গমনধর্মী, বন থেকে বনান্তরে যাযাবরবৃত্তিধারী একটি বিশেষ গোষ্ঠীভুক্ত মানুষ। পরে কৃষিনির্ভর, স্থিতিশীল জীবনযাত্রা গড়ে উঠলেও তাদের 'আর্য' নামটিই থেকে যায়, যার পরিবর্তিত অর্থ হয়ে ওঠে 'ইন্দো ইউরোপীয় বংশের নৃজাতি।
এরকম অর্থ পরিবর্তনের আরও একটি দৃষ্টান্ত হিসাবে দেখতে পারেন 'বিবাহ' 'পাণিগ্রহণ' ইত্যাদি শব্দগুলিকে। আদিমকালে বিবাহযোগ্যা কন্যাকে বলপ্রয়োগে হরণ করা এবং বহন করে নিয়ে যাওয়ার প্রথা ছিল বলে এই বিশেষরূপে বহন কার অর্থে 'বিবাহ' এবং বলপ্রয়োগে গ্রহণ করা অর্থে 'পানিগ্রহণ' শব্দগুলি ব্যবহৃত হোত।
বর্তমানে সভ্যতার বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই বর্বর প্রথার অবসান ঘটলেও শব্দগুলি পরিবর্তিত অর্থ গ্রহণ করে ভাষায় টিকে রয়েছে। উল্লিখিত দুটি শব্দই এখন 'পরিণয়সূত্র' অর্থে ব্যবহৃত হয়।
উপকরণগত কারণ :
যে উপকরণে কোনো বস্তু তৈরি হয়, সেই উপকরণের নাম বা ধর্ম অনুযায়ী অনেকসময় ওই বস্তুটির নামকরণ হয়, কিন্তু পরে সেই উপকরণটি পরিবর্তিত হয়ে গেলেও পুরনো নামটিই বজায় থাকে।
যেমন ধরুন 'কলম' শব্দটির মূল অর্থ 'শর' বা 'খাগ' যা একসময় লেখনী হিসাবে ব্যবহৃত হত। এখন শরের ব্যবহার অবলুপ্ত তো বটেই, উপরন্তু লেখনী নির্মাণে হেন বস্তু নেই যা ব্যবহৃত হয় না। অথচ সবকটি ক্ষেত্রেই 'কলম' শব্দটি ব্যবহার করতেই আমরা অভ্যস্ত।
লক্ষ করুন, পুরনো নামটির যোগ উপকরণটির সাথে। আর এই পুরনো নাম দিয়েই যখন নতুন জিনিসটিকে বোঝাচ্ছি, তখন তার সম্পর্ক আর এই জিনিসটি কীসে তৈরি হয়েছে সেই উপকরণের সঙ্গে নয়, শুধুমাত্র জিনিসটির সঙ্গেই। এরকম অর্থ পরিবর্তনের দৃষ্টান্ত আপনি আরও অনেক খুঁজে পাবেন।
একসময় জল বা বালিভর্তি ঘড়ার সাহায্যে সময় নিরূপণ করা হত, তাই তার নাম ছিল 'ঘড়ি'। আধুনিক যান্ত্রিক সময়নির্ধারক যন্ত্র সম্পূর্ণ আলাদা একটি ব্যাপার হলেও তার নাম রয়ে গেছে 'ঘড়ি।
তুলো দিয়ে তৈরি হত বলেই 'তুলি' বর্তমানে যা নাইলন তত্ত্ব বা পশুলোম তৈরি হয়, কিন্তু তার 'তুলি' নামটি অপরিবর্তিত।
১) সাদৃশ্য,
২) বিশ্বাস ও ধর্মীয় সংস্কার,
৩) শব্দ প্রয়োগে অসতর্কতা ও অজ্ঞতা,
৪) অল্পায়াস প্রবণতা এবং
৫) আলংকারিক প্রয়োগ।
আরও পড়ুনঃ বিশেষণের অভিশায়ন কাকে বলে?
সাদৃশ্য :
ধ্বনি পরিবর্তনের ক্ষেত্রে যেমন সাদৃশ্যের ভূমিকা অনেকখানি, শব্দার্থ পরিবর্তনের ক্ষেত্রেও তাই। যেহেতু দেহের সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মধ্যে মাধাই শ্রেষ্ঠ এবং সর্বোচ্চ অবস্থিত, সেই কারণে এই অর্থসাজুয্যে শ্রেষ্ঠতা বা উচ্চতা বোঝাতে আমরা যথেচ্ছ 'মাথা' শব্দটিকে ব্যবহার করি।
যেমন 'গাঁয়ের মাথা', 'গাছের মাথা', 'মাথায় রাখা', 'মোড়ের মাথা ইত্যাদি। 'বড়' বা 'বৃহৎ' অর্থে 'রাম' শব্দটির ব্যবহার (রাম ছাগল, রামদা) বা অনুরূপভাবে 'রাজ' শব্দটির প্রয়োগও (রাজপথ, রাজহাঁস, রাজগাঁদা) এক্ষেত্রে লক্ষ্যণীয়। আকারের বিশালত্ব, রাজকীয়তা এবং ঐশ্বর্যের সঙ্গে সমীকৃত হয়েছে এই দুটি ক্ষেত্রেই।
বিশ্বাস ও ধর্মীয় সংস্কার :
সাধারণ মানুষের ধারণা অশুভ বিষয় বা বিপজ্জনক বস্তুর নাম উচ্চারণ করতে নেই। এই সংস্কারের বশেই কোনো বিপজ্জনক বস্তু বা অশুভ বিষয়কে কোনো একটি শুভ বা শোভন শব্দের দ্বারা প্রকাশ করা হয়। একে আপনি সুভাষণ বলে অভিহিত করতে পারেন।
এই প্রবণতায় অনেক সময়ই দেখা যায়—নতুন নামটির নতুন অর্থে প্রয়োগ হতে হতে তার অর্থগত পরিবর্তন ঘটে যায়। যেমন, 'মৃত্যু' অর্থে 'গঙ্গাপ্রাপ্তি' বা 'সাপ' বোঝাতে 'লতা', বসন্ত রোগকে 'মায়ের দয়া' বা 'শীতলায় দয়া, কুসীদজীবি'কে 'মহাজন' বলা এই বিশ্বাস বা সংস্কারচ্ছন্ন অর্থবিবর্তনেরই ফলশ্রুতি।
শব্দ প্রয়োগে অসতর্কতা ও অজ্ঞতা :
কোনো শব্দের মূল অর্থটি না জেনে, তাকে ভিন্ন, সম্পূর্ণ আলাদা কোনো অর্থে প্রয়োগ করলে, অনবধানজনিত অর্থান্তর ঘটার সম্ভাবনা সেখানে থাকে।
যেমন ধরুন 'সোচ্চার' শব্দটি। আমরা আমাদের চারপাশে এই শব্দটির যথেচ্ছ ব্যবহার লক্ষ করি 'জোরে বলা' বা 'ঘোষণা করা' অর্থে। অথচ দেখুন শব্দটির মূল অর্থ আদৌ এর সঙ্গে জড়িত নয়। কারণ মূল অর্থটি হ'ল 'সশব্দ বমন'।
ঠিক তেমনি 'পাষণ্ড' শব্দের মূল অর্থ বৌদ্ধ সন্নাসী না বুঝিয়ে 'নিষ্ঠুর' অর্থে প্রয়োগ করা কিংবা অল্প বা ছোট বোঝায় এমন 'স্তোক' শব্দটিকে অজ্ঞাতবশত 'স্তোকবাক্য হিসাবে ব্যবহার করা—আমাদের এই জাতীয় প্রবণতা থেকেই ভাষায় স্থায়ী হয়ে দেখা দেয়।
অল্পায়াস প্রবণতা :
ভাষা ব্যবহারে শৈথিল্যের বশে আমরা অনেকসময় কোনো একটি শব্দগুচ্ছের সবটুকু ব্যবহার না করে, তার অংশবিশেষ উচ্চারণ করেই কাজ চালিয়ে নিতে চেষ্টা করি। একে শব্দ সংক্ষেপ বা শব্দের অঙ্গচ্ছেদ বলতে পারেন।
যেমন—“দণ্ডবৎ প্রণাম' কালক্রমে ‘দণ্ডবৎ -মাত্র হয়েই প্রণামের প্রক্রিয়াটিকে বুঝিয়ে দিচ্ছে। খবরের কাগজ' না বলে আমরা প্রায়শই শুধু 'কাগজ' বলে সংবাদপত্রের অর্থটিকে পরিস্ফুট করে তুলি। কিংবা সন্ধ্যার সময় প্রদীপ দেওয়া আমাদের কাচে হয়ে ওঠে 'সন্ধ্যা দেওয়া'।
আলংকারিক প্রয়োগ :
বক্তব্যকে সোজাসুজি না বলে, আলংকারিক বাচনভঙ্গি ব্যবহারের ফলে বহু শব্দেরই মূল অর্থ পিছনে সরে গিয়ে, বিচিত্র অর্থ প্রকাশ করতে দেখা যায়।
যেমন- বাড়ি মাথায় করা, মাথায় আকাশ ভেঙে পড়া, মামার বাড়ি (জেলখানা অর্থে), শ্রীঘর (ঐ একই অর্থে) বললে, আমরা ভুলেও মূল অর্থ খোঁজার চেষ্টা করি না।
কারণ এই দৃষ্টান্তগুলির আলংকারিক অর্থই আমাদের মধ্যে বদ্ধমূল লক্ষ্য করুন, বিনয় বা নম্রতার পরাকাষ্ঠা দেখাতেও আমরা প্রায়ই শব্দের এই জাতীয় প্রয়োগ করি। নিমন্ত্রিতকে “দুটি ডালভাত” খাবার জন্য অনুরোধ করি, নিজের বাড়িকে বলি 'গরীবের বাড়ি।
আরও পড়ুনঃ পুরুষবাচক ও স্ত্রীবাচক শব্দ কাকে বলে?
এইভাবে লক্ষ করুন বক্তা বা ভাষাব্যবহারকারী ব্যক্তি কীভাবে তাঁর বিবক্ষা অনুযায়ী শব্দ ও অর্থের সম্পর্কটিকে নিয়ন্ত্রণ করেন। যে দৃষ্টান্তগুলি আমরা ইতপূর্বে দেখলাম, নজর করুন তাতে দুটি ধরনের পরিবর্তনসূত্র লক্ষ করা যায়।
প্রথমত শব্দ যেখানে নিজেদকে অপরিবর্তিত রেখে অর্থকে বদলে নিচ্ছে সময়ের সঙ্গেসঙ্গে ('কলম', 'আর্য বা 'দরিয়া' জাতীয় শব্দ) দ্বিতীয়ত অর্থ তার প্রাধান্য বিস্তার করে, তার পরিচ্ছদস্বরূপ শব্দটিকে বদলে নিচ্ছে (মাথা, গঙ্গাপ্রাপ্তি, পাষণ্ড, কাগজ, শ্রীঘর ইত্যাদি শব্দের মতো দৃষ্টান্তে)।
আরও সূক্ষ্মভাবে বলতে গেলে অর্ধপরিবর্তনের স্থূল কারণগুলি প্রথম ক্ষেত্রে সক্রিয়, আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রটিতে প্রধানত সক্রিয় হয়ে উঠেছে অর্থপরিবর্তনের মনস্তত্ত্ব নির্ভর সূক্ষ্ম কারণগুলি।
কিন্তু আধুনিক রূপান্তরমূলক সৃজনমূলক (Transformational Generative) ভাষাবিজ্ঞানে শব্দার্থকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কারণ যেহেতু ভাষার শব্দাবলীর দ্বারা বাক্য গঠনের আভ্যন্তরীণ নির্মাণের প্রক্রিয়াটির (deep structure) সঙ্গে অর্থ ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত। এর থেকে একটি জিনিস আমাদের কাছে স্পষ্টতা হ'ল শব্দার্থই যে কোনো ভাষার প্রাণ। এই ভাব বা অর্থ বাদে ভাষার কোনো উপযোগিতাই থাকে না। তাই শব্দার্থতত্ত্ব (Semantics) ভাষাবিজ্ঞানের একটি অপরিহার্য অঙ্গ।
শব্দার্থ পরিবর্তনের কারণ :-
আমরা আগেই দেখেছি যে কোনো ভাষার শব্দ ব্যবহার অনেকটাই ঐ ভাষা ব্যবহারকারীর ইচ্ছানুগ। সময়ের সঙ্গেসঙ্গে সভ্যতার বিবর্তন অনুযায়ী মানুষের মনের গঠন ও অভিজ্ঞতার তারতম্য ঘটে। তারই ফলে মানুষ যখন ভাষা ব্যবহার করে, তার নিজের সেই আভ্যন্তরীণ বদল ভাষার বাইরের কাঠামোটিকে যেমন বদলে দেয়, তেমনি তার ভিতেরর অর্থটিকেও পরিবর্তিত হতে বাধ্য করে।ভাষার ধ্বনি পরিবর্তনেরও নানা কারণ আছে তেমনি অর্থ পরিবর্তনেরও নানা কারণ লক্ষ করা যায়। কিন্তু এই কারণগুলির সংখ্যা ও বৈচিত্র্য এত বেশি যে তাদের সবগুলিকেই একটিমাত্র আলোচনায় সীমিত করা কষ্টাসাধ্য। তবে বিভিন্ন ভাষাবিজ্ঞানীর পর্যালোচনা অনুযায়ী এই কারণগুলিকে প্রধানত দুটি শ্রেণিতে বিন্যস্ত করা যায়:
(১) স্থূলকারণ এবং
(২) সূক্ষ্ম কারণ।
আরও পড়ুনঃ খাঁটি বাংলা সন্ধি কাকে বলে?
এই দুই ক্ষেত্রেই আবার নানা উপশ্রেণিতে বিভাজিত হবার মতো কারণসমূহও লক্ষ করা যায়।
অর্থপরিবর্তনের স্থূল কারণ :-
দেশ-কাল, অনুযায়ী, ভাষায় শব্দ ব্যবহারকারী মানুষের অভিজ্ঞতার তারতম্যে শব্দের যে অর্থান্তর ঘটে, সেগুলিকে এই পর্যায়ভুক্ত করা যায়। এবিষয়ে প্রভাবসৃষ্টিকারী কারণগুলিকে আমরা তিনটি সূত্রে চিহ্নিত করতে পারি। যেমন-১) ভৌগোলিক বা ভিন্ন পারিবেশিক কারণ,
২) ঐতিহাসিক কারণ এবং
৩) উপকরণগত কারণ।
আসুন, প্রথমে এই তিনটি কারণে কীভাবে শব্দ তার অর্থ বদলে নেয়, বাংলা ভাষার শব্দ অনুযায়ী আমরা তা লক্ষ করি।
ভৌগোলিক বা ভিন্ন পারিবেশিক কারণ :
একই শব্দ ভিন্ন ভিন্ন ভৌগোলিক অঞ্চলে ভিন্নার্থে ব্যবহৃত হয়। যেমন ধরুন ফার্সিতে প্রচলিত 'মুর্গ', শব্দটির অর্থ যে কোনো পাখি। কিন্তু আগন্তুক শব্দ হিসাবে বাংলাভাষায় প্রবেশ করে এর প্রয়োগ বিশেষ একটিমাত্র পাখি—মোরগ বা মুরগি (এক কথায় তৎসম 'কুক্কুট' অর্থে) বোঝাতে সীমাবদ্ধ হয়েছে।
একইরকমভাবে ফার্সী 'দরিয়া' শব্দটি মূলে 'নদী' বোঝালেও, বাংলায় এই শব্দটির অর্থ দাঁড়িয়েছে 'সমুদ্র। অনুরূপ কারণেই লক্ষ করুন আরও কত শব্দে এজাতীয় অর্থন্তর লক্ষ করা যায়- বাংলায় 'শাক' বলতে ভোজ্য উদ্ভিদকে বোঝালেও, ভারতের হিন্দিভাষী অঞ্চলে 'শাক' নিরামিষ তরকারি বোঝাতে ব্যবহৃত হয়।
ঐতিহাসিক কারণ :
জীবনযাত্রার পরিবর্তন অনেকসময়ই শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থকে পিছনে সরিয়ে ভিন্নতর অর্থকে সেইস্থানে প্রতিষ্ঠিত করে।
যেমন ধরুন 'আর্য' শব্দটি। বুৎপত্তি (ঋ + না = আর্য) অনুযায়ী এই শব্দের অর্থ গমনধর্মী, বন থেকে বনান্তরে যাযাবরবৃত্তিধারী একটি বিশেষ গোষ্ঠীভুক্ত মানুষ। পরে কৃষিনির্ভর, স্থিতিশীল জীবনযাত্রা গড়ে উঠলেও তাদের 'আর্য' নামটিই থেকে যায়, যার পরিবর্তিত অর্থ হয়ে ওঠে 'ইন্দো ইউরোপীয় বংশের নৃজাতি।
এরকম অর্থ পরিবর্তনের আরও একটি দৃষ্টান্ত হিসাবে দেখতে পারেন 'বিবাহ' 'পাণিগ্রহণ' ইত্যাদি শব্দগুলিকে। আদিমকালে বিবাহযোগ্যা কন্যাকে বলপ্রয়োগে হরণ করা এবং বহন করে নিয়ে যাওয়ার প্রথা ছিল বলে এই বিশেষরূপে বহন কার অর্থে 'বিবাহ' এবং বলপ্রয়োগে গ্রহণ করা অর্থে 'পানিগ্রহণ' শব্দগুলি ব্যবহৃত হোত।
বর্তমানে সভ্যতার বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই বর্বর প্রথার অবসান ঘটলেও শব্দগুলি পরিবর্তিত অর্থ গ্রহণ করে ভাষায় টিকে রয়েছে। উল্লিখিত দুটি শব্দই এখন 'পরিণয়সূত্র' অর্থে ব্যবহৃত হয়।
উপকরণগত কারণ :
যে উপকরণে কোনো বস্তু তৈরি হয়, সেই উপকরণের নাম বা ধর্ম অনুযায়ী অনেকসময় ওই বস্তুটির নামকরণ হয়, কিন্তু পরে সেই উপকরণটি পরিবর্তিত হয়ে গেলেও পুরনো নামটিই বজায় থাকে।
যেমন ধরুন 'কলম' শব্দটির মূল অর্থ 'শর' বা 'খাগ' যা একসময় লেখনী হিসাবে ব্যবহৃত হত। এখন শরের ব্যবহার অবলুপ্ত তো বটেই, উপরন্তু লেখনী নির্মাণে হেন বস্তু নেই যা ব্যবহৃত হয় না। অথচ সবকটি ক্ষেত্রেই 'কলম' শব্দটি ব্যবহার করতেই আমরা অভ্যস্ত।
লক্ষ করুন, পুরনো নামটির যোগ উপকরণটির সাথে। আর এই পুরনো নাম দিয়েই যখন নতুন জিনিসটিকে বোঝাচ্ছি, তখন তার সম্পর্ক আর এই জিনিসটি কীসে তৈরি হয়েছে সেই উপকরণের সঙ্গে নয়, শুধুমাত্র জিনিসটির সঙ্গেই। এরকম অর্থ পরিবর্তনের দৃষ্টান্ত আপনি আরও অনেক খুঁজে পাবেন।
একসময় জল বা বালিভর্তি ঘড়ার সাহায্যে সময় নিরূপণ করা হত, তাই তার নাম ছিল 'ঘড়ি'। আধুনিক যান্ত্রিক সময়নির্ধারক যন্ত্র সম্পূর্ণ আলাদা একটি ব্যাপার হলেও তার নাম রয়ে গেছে 'ঘড়ি।
তুলো দিয়ে তৈরি হত বলেই 'তুলি' বর্তমানে যা নাইলন তত্ত্ব বা পশুলোম তৈরি হয়, কিন্তু তার 'তুলি' নামটি অপরিবর্তিত।
অর্থ পরিবর্তনের সূক্ষ্ম কারণ :
এই জাতীয় কারণটি মূলত ভাষা ব্যবহারকারীর প্রকাশসামর্থ্য ও ঔচিত্যবোধের উপর নির্ভর করে অর্থ পরিবর্তন ঘটাতে সাহায্য করে। এক্ষেত্রেও অর্থ পরিবর্তনের স্থূল কারণের মতই কয়েকটি ভিন্ন ভিন্ন পর্যায় লক্ষ করা যায়, যাদের আমরা শ্রেণিভুক্ত করতে পারে এইভাবে –১) সাদৃশ্য,
২) বিশ্বাস ও ধর্মীয় সংস্কার,
৩) শব্দ প্রয়োগে অসতর্কতা ও অজ্ঞতা,
৪) অল্পায়াস প্রবণতা এবং
৫) আলংকারিক প্রয়োগ।
আরও পড়ুনঃ বিশেষণের অভিশায়ন কাকে বলে?
সাদৃশ্য :
ধ্বনি পরিবর্তনের ক্ষেত্রে যেমন সাদৃশ্যের ভূমিকা অনেকখানি, শব্দার্থ পরিবর্তনের ক্ষেত্রেও তাই। যেহেতু দেহের সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মধ্যে মাধাই শ্রেষ্ঠ এবং সর্বোচ্চ অবস্থিত, সেই কারণে এই অর্থসাজুয্যে শ্রেষ্ঠতা বা উচ্চতা বোঝাতে আমরা যথেচ্ছ 'মাথা' শব্দটিকে ব্যবহার করি।
যেমন 'গাঁয়ের মাথা', 'গাছের মাথা', 'মাথায় রাখা', 'মোড়ের মাথা ইত্যাদি। 'বড়' বা 'বৃহৎ' অর্থে 'রাম' শব্দটির ব্যবহার (রাম ছাগল, রামদা) বা অনুরূপভাবে 'রাজ' শব্দটির প্রয়োগও (রাজপথ, রাজহাঁস, রাজগাঁদা) এক্ষেত্রে লক্ষ্যণীয়। আকারের বিশালত্ব, রাজকীয়তা এবং ঐশ্বর্যের সঙ্গে সমীকৃত হয়েছে এই দুটি ক্ষেত্রেই।
বিশ্বাস ও ধর্মীয় সংস্কার :
সাধারণ মানুষের ধারণা অশুভ বিষয় বা বিপজ্জনক বস্তুর নাম উচ্চারণ করতে নেই। এই সংস্কারের বশেই কোনো বিপজ্জনক বস্তু বা অশুভ বিষয়কে কোনো একটি শুভ বা শোভন শব্দের দ্বারা প্রকাশ করা হয়। একে আপনি সুভাষণ বলে অভিহিত করতে পারেন।
এই প্রবণতায় অনেক সময়ই দেখা যায়—নতুন নামটির নতুন অর্থে প্রয়োগ হতে হতে তার অর্থগত পরিবর্তন ঘটে যায়। যেমন, 'মৃত্যু' অর্থে 'গঙ্গাপ্রাপ্তি' বা 'সাপ' বোঝাতে 'লতা', বসন্ত রোগকে 'মায়ের দয়া' বা 'শীতলায় দয়া, কুসীদজীবি'কে 'মহাজন' বলা এই বিশ্বাস বা সংস্কারচ্ছন্ন অর্থবিবর্তনেরই ফলশ্রুতি।
শব্দ প্রয়োগে অসতর্কতা ও অজ্ঞতা :
কোনো শব্দের মূল অর্থটি না জেনে, তাকে ভিন্ন, সম্পূর্ণ আলাদা কোনো অর্থে প্রয়োগ করলে, অনবধানজনিত অর্থান্তর ঘটার সম্ভাবনা সেখানে থাকে।
যেমন ধরুন 'সোচ্চার' শব্দটি। আমরা আমাদের চারপাশে এই শব্দটির যথেচ্ছ ব্যবহার লক্ষ করি 'জোরে বলা' বা 'ঘোষণা করা' অর্থে। অথচ দেখুন শব্দটির মূল অর্থ আদৌ এর সঙ্গে জড়িত নয়। কারণ মূল অর্থটি হ'ল 'সশব্দ বমন'।
ঠিক তেমনি 'পাষণ্ড' শব্দের মূল অর্থ বৌদ্ধ সন্নাসী না বুঝিয়ে 'নিষ্ঠুর' অর্থে প্রয়োগ করা কিংবা অল্প বা ছোট বোঝায় এমন 'স্তোক' শব্দটিকে অজ্ঞাতবশত 'স্তোকবাক্য হিসাবে ব্যবহার করা—আমাদের এই জাতীয় প্রবণতা থেকেই ভাষায় স্থায়ী হয়ে দেখা দেয়।
অল্পায়াস প্রবণতা :
ভাষা ব্যবহারে শৈথিল্যের বশে আমরা অনেকসময় কোনো একটি শব্দগুচ্ছের সবটুকু ব্যবহার না করে, তার অংশবিশেষ উচ্চারণ করেই কাজ চালিয়ে নিতে চেষ্টা করি। একে শব্দ সংক্ষেপ বা শব্দের অঙ্গচ্ছেদ বলতে পারেন।
যেমন—“দণ্ডবৎ প্রণাম' কালক্রমে ‘দণ্ডবৎ -মাত্র হয়েই প্রণামের প্রক্রিয়াটিকে বুঝিয়ে দিচ্ছে। খবরের কাগজ' না বলে আমরা প্রায়শই শুধু 'কাগজ' বলে সংবাদপত্রের অর্থটিকে পরিস্ফুট করে তুলি। কিংবা সন্ধ্যার সময় প্রদীপ দেওয়া আমাদের কাচে হয়ে ওঠে 'সন্ধ্যা দেওয়া'।
আলংকারিক প্রয়োগ :
বক্তব্যকে সোজাসুজি না বলে, আলংকারিক বাচনভঙ্গি ব্যবহারের ফলে বহু শব্দেরই মূল অর্থ পিছনে সরে গিয়ে, বিচিত্র অর্থ প্রকাশ করতে দেখা যায়।
যেমন- বাড়ি মাথায় করা, মাথায় আকাশ ভেঙে পড়া, মামার বাড়ি (জেলখানা অর্থে), শ্রীঘর (ঐ একই অর্থে) বললে, আমরা ভুলেও মূল অর্থ খোঁজার চেষ্টা করি না।
কারণ এই দৃষ্টান্তগুলির আলংকারিক অর্থই আমাদের মধ্যে বদ্ধমূল লক্ষ্য করুন, বিনয় বা নম্রতার পরাকাষ্ঠা দেখাতেও আমরা প্রায়ই শব্দের এই জাতীয় প্রয়োগ করি। নিমন্ত্রিতকে “দুটি ডালভাত” খাবার জন্য অনুরোধ করি, নিজের বাড়িকে বলি 'গরীবের বাড়ি।
আরও পড়ুনঃ পুরুষবাচক ও স্ত্রীবাচক শব্দ কাকে বলে?
এইভাবে লক্ষ করুন বক্তা বা ভাষাব্যবহারকারী ব্যক্তি কীভাবে তাঁর বিবক্ষা অনুযায়ী শব্দ ও অর্থের সম্পর্কটিকে নিয়ন্ত্রণ করেন। যে দৃষ্টান্তগুলি আমরা ইতপূর্বে দেখলাম, নজর করুন তাতে দুটি ধরনের পরিবর্তনসূত্র লক্ষ করা যায়।
প্রথমত শব্দ যেখানে নিজেদকে অপরিবর্তিত রেখে অর্থকে বদলে নিচ্ছে সময়ের সঙ্গেসঙ্গে ('কলম', 'আর্য বা 'দরিয়া' জাতীয় শব্দ) দ্বিতীয়ত অর্থ তার প্রাধান্য বিস্তার করে, তার পরিচ্ছদস্বরূপ শব্দটিকে বদলে নিচ্ছে (মাথা, গঙ্গাপ্রাপ্তি, পাষণ্ড, কাগজ, শ্রীঘর ইত্যাদি শব্দের মতো দৃষ্টান্তে)।
আরও সূক্ষ্মভাবে বলতে গেলে অর্ধপরিবর্তনের স্থূল কারণগুলি প্রথম ক্ষেত্রে সক্রিয়, আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রটিতে প্রধানত সক্রিয় হয়ে উঠেছে অর্থপরিবর্তনের মনস্তত্ত্ব নির্ভর সূক্ষ্ম কারণগুলি।
0 মন্তব্যসমূহ
Please do not enter any spam link in the comment box.