পুরুষবাচক ও স্ত্রীবাচক শব্দ কাকে বলে? কত প্রকার ও কি?

বাংলা ভাষায় লিঙ্গ একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে। বাংলা ভাষায় পুরুষবাচক ও স্ত্রীবাচক শব্দকে এক কথায় লিঙ্গ বলা হয়ে থাকে। এই লিঙ্গ শব্দের অর্থ হলো ব্যাকরণিক চিহ্ন বা বিধি, যা দ্বারা একটি লৈঙ্গিক বৈশিষ্টকে নির্দেশ করে।

পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় এই লিঙ্গবিধি একেক রকম। অর্থাৎ বিভিন্ন ভাষায় শব্দ প্রকরণে লিঙ্গ বা পুরুষ ও স্ত্রীবাচকতা বোঝানোর জন্য ভিন্ন ভিন্ন শব্দের ব্যবহার রয়েছে।

বাংলা ভাষাও এর বাতিক্রম নয়। বাংলা ভাষায় লিঙ্গভেদের এই পার্থক্য সহজেই শব্দ দ্বারা নির্ণয় করা যায়। বিশেষ করে এ ভাষায় অনেক বিশেষ্য পদ রয়েছে তাদের মধ্যে কোনোটি পুরুষ বুঝায়, আবার কোনোটি দ্বারা প্রকাশিত হয় স্ত্রীবাচকতা।

পুরুষবাচক ও স্ত্রীবাচক শব্দের সংজ্ঞা :-

সংক্ষেপে বলা যায়, যে সব শব্দ দ্বারা পুরুষ বোঝায় তাকে বলা হয় পুরুষবাচক শব্দ। এসব শব্দের উদাহরণ হলো ছেলে, ঠাকুর, কাকা, নাপিত, মামা ইত্যাদি।

আর যে সব শব্দ দ্বারা স্ত্রী বোঝায় তাকে বলা হয় স্ত্রীবাচক শব্দ। স্ত্রীবাচক শব্দের উদাহরণ হলো বোন, চাকরানী, মা, মামী ইত্যাদি।

ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়েরমতে, 'জগতে বা প্রকৃতিতে বস্তুসমূহ পুরুষ, স্ত্রী ও নপুংসক বা ক্লীব- এই তিন জাতি বা শ্রেণিতে পড়ে। বহু স্থলে ভাষাতেও প্রাকৃতিক অবস্থা অনুসারে নাম -বাচক শব্দগুলিকেও এই শ্রেণিতে ফেলা হয়। পুরুষ জাতীয় বস্তুর নামকে পুংলিঙ্গ, স্ত্রী-জাতীয় বস্তুর নামকে স্ত্রীলিঙ্গ এবং ক্লাব বা নপুংসক জাতীয় বস্তুর নামকে ক্লীবলিঙ্গ বলা হয়।

মুনীর চৌধুরী ও মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীরমতে, 'সব ভাষায় লিঙ্গভেদে শব্দ আছে, বাংলা ভাষায়ও আছে। বাংলা ভাষায় বহু বিশেষ্য পদ রয়েছে যাদের কোনোটিতে পুরুষ ও কোনোটিতে স্ত্রী বোঝায়। যে শব্দে পুরুষ বোঝায় তাকে পুরুষবাচক শব্দ, আর যে শব্দে স্ত্রী বোঝায় তাকে স্ত্রীবাচক শব্দ বলে। যেমন- বাপ-মা, ভাই-বোন, ছেলে-মেয়ে কেউই মৃত্যুর সময় কাছে ছিল না। এ বাক্যে বাপ, ভাই ও ছেলে পুরুষবাচক শব্দ আর মা, বোন ও মেয়ে স্ত্রীবাচক শব্দ।'

বাংলা ব্যাকরণের লিঙ্গ আলোচনায় তৎসম শব্দের প্রভাব বিদ্যমান থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে সংস্কৃত ব্যাকরণের নিয়ম বাংলা ভাষার লিঙ্গ প্রকরণে প্রযোজ্য হয় না।

যেমন- তৎসম পুরুষবাচক শব্দের পুরুষবাচক বিশেষণ এবং স্ত্রীবাচক বিশেষ্য শব্দের স্ত্রীবাচক বিশেষণ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। যেমন- বিজ্ঞান পুরুষ এবং বিদুষী নারী। এখানে 'পুরুষ" পুরুষবাচক বিশেষ্য এবং‌ "নারী" স্ত্রীবাচক বিশেষ্য। পাশাপাশি 'বিজ্ঞান' পুরুষবাচক বিশেষণ এবং 'বিদুষী' স্ত্রীবাচক বিশেষণ। কিন্তু বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে সংস্কৃত ব্যাকরণের নিয়ম অনেক সময় প্রযোজ্য হয় না। যেমন- সংস্কৃতে সুন্দর বালক ও সুন্দরী বালিকা ব্যবহৃত হলেও বাংলায় বিশেষণের পরিবর্তন হয় না। বাংলায় ব্যবহৃত হয় যথাক্রমে সুন্দর বালক ও সুন্দর বালিকা। বাংলা ভাষার শব্দভেদ বা লিঙ্গভেদের কারণে এমনটি হয়ে থাকে।

'লিঙ্গ' শব্দের অর্থ চিহ্ন। এটি সংস্কৃত শব্দ এবং এর ব্যুৎপত্তি হলো লিঙ্গ+অ = লিঙ্গ । লিঙ্গ শব্দের ভিন্ন অর্থ থাকলেও ব্যাকরণে এটি শব্দের শ্রেণিবিশেষ বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। লিঙ্গের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে যে সকল শব্দ দ্বারা বিশেষ্য ও সর্বনাম পদের মধ্যে পুরুষ, স্ত্রী বা ভিন্ন জাতি বোঝায় তাকে লিঙ্গ বলে।

বাংলায় পুরুষবাচক ও স্ত্রীবাচক শব্দ ও লিঙ্গের প্রকারভেদ :-

বাংলা ভাষার পুরুষবাচক ও স্ত্রীবাচক শব্দকে প্রধানত দুইভাগে ভাগ করা হয়েছে। এগুলি হলো-
 
আরও পড়ুনঃ পুরুষ কাকে বলে? 

ক) পতি ও পত্নিবাচক অর্থে ব্যবহৃত শব্দ:

স্বামী ও পত্নীবাচক অর্থে ব্যবহৃত শব্দের উদাহরণ হলো চাচ-চাচা, মামা-মামী, দাদা-দাদী, নানা-নানী, ভাই-ভাবী ইত্যাদি।

ঘ) পুরুষ ও মেয়ে বা স্ত্রী জাতীয় অর্থে ব্যবহৃত শব্দ:

পুরুষ ও মেয়ো বা স্ত্রী জাতীয় অর্থে ব্যবহৃত হয়- পাগল-পাগলী, খোকা-খুকী, মোরগ-মুরগী, বালক-বালিকা, দেবর ননদ ইত্যাদি শব্দ।

স্ত্রীবাচক ও পুরুষবাচক শব্দের জন্য কিছু বিশেষ নিয়ম :

ক. যেসব পুরুষবাচক শব্দের শেষে তা রয়েছে, স্ত্রীবাচক বোঝাতে সেসব শব্দে স্ত্রী হয়। যেমন নেতা- নেত্রী, কর্তা কর্ত্রী, শ্রোতা- শ্রোত্রী, ধাতা ধাত্রী ইত্যাদি।

খ. পুরুষবাচক শব্দের শেষে অত, বান, মান, ঈয়ান থাকলে স্ত্রীবাচক শব্দ করার জন্য যথাক্রমে অতী, বর্তী, মতি, ঈয়সী হয়। যেমন: শ্রীমান- শ্রীমতি, গুণবান- গুণবতী, রূপবান- রূপবতী, বুদ্ধিমান- বুদ্ধিমতি ইত্যাদি।

গ. কোনো কোনো পুরুষবাচক শব্দ থেকে বিশেষ নিয়মে স্ত্রীবাচক শব্দ গঠিত হয়। যেমন: বন্ধু-বান্ধবী, নর-নারী, পতি-পত্নী, সম্রাট-সম্রাজ্ঞী, শিক্ষক-শিক্ষয়িত্রী, স্বামী-স্ত্রী ইত্যাদি।

ঘ. নিত্য স্ত্রীবাচক শব্দ : এসব শব্দের পুরুষবাচক রূপ নেই। যেমন- সাবা, বিধবা, সতীন, ললনা, পোয়াতী, লক্ষ্মী, সুজলা, সুফলা, অধীরা, গভিনী, ডাইনী, পেত্নী, শাকচুন্নী, কুলটা, বিমাতা ইত্যাদি।

ঙ. উভয়লিঙ্গ শব্দ : সন্তান, মন্ত্রী, ঋষি, সৈন্য, পুলিশ, শিশু, হাতি, মানুষ, গরু, আমি, তুমি, তুই, আপনি, সে তিনি ইনি, উনি, জল, পাখি ইত্যাদি।

চ. কিছু পুরুষবাচক শব্দের দুটো করে স্ত্রীবাচক শব্দ রয়েছে। যথা-

দেবর- ননদ (দেবরের বোন)/ জা (দেবরের স্ত্রী), ভাই - বোন এবং ভারী (ভাইয়ের স্ত্রী), শিক্ষক-শিক্ষয়িত্রী (পেশা অর্থে), এবং শিক্ষক পত্নী (শিক্ষকের স্ত্রী), বন্ধু বান্ধবী (মেয়ে বন্ধু) এবং বন্ধুপত্নী (বন্ধুর স্ত্রী), দাদা-দিদি (বড় বোন) এবং বৌদি (দাদার স্ত্রী) ইত্যাদি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ