মৌলিক শব্দ কাকে বলে? মৌলিক শব্দ কত প্রকার ও কি কি?

বাংলা ভাষার বয়স প্রায় হাজার বছরের মতো। এই হাজার বছরে বাংলা ভাষা বিভিন্ন উৎস থেকে অজস্র শব্দ আরোহন করেছে, এবং এখনো করে চলেছে। ভাষাতাত্ত্বিক ড. সুকুমার সেন বাংলা শব্দের প্রধান দুটি উৎসের কথা বলেছেন। যথা- 

১. মৌলিক শব্দ ও 
২. আগন্তক শব্দ।

এখন প্রশ্ন হলো মৌলিক শব্দ কাকে বলে সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা।

মৌলিক শব্দ কাকে বলে :-

যে সকল শব্দ প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষা বা সংস্কৃত ভাষা থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে বাংলা ভাষায় এসেছে সেগুলিকে মৌলিক শব্দ বলা হয়।

আবার ব্যকরনে মোলিক শব্দকে এভাবেও ব্যাখ্যা করা হয়, যে শব্দকে বিশ্লেষণ করতে পারা যায় না, বা বিশ্লেষণ করলে ভাঙা অংশের কোনো অর্থ হয় না, তাকে মৌলিক শব্দ বলে। যেমন - মা, হাত, ঘোড়া— এগুলি মৌলিক শব্দ।

মৌলিক শব্দকে ‘স্বয়ংসিদ্ধ' শব্দও বলে। কারণ, মৌলিক শব্দের অর্থ স্বতঃপ্রকাশিত ও চূড়ান্ত।

অর্থাৎ যে সব শব্দকে অর্থসঙ্গতিপূর্ণভাবে বিভাজন করা সম্ভব নয় তাকে মৌলিক শব্দ বলে।

আরও পড়ুনঃ শৈলীবিজ্ঞান কি?

যেমন: গোলাপ, নাক, লাল, তিন, ইত্যাদি। এই শব্দগুলোকে আরও ছোট অংশে বিভাজনের চেষ্টা করা হলে দেখা যায় যে, কোনো অর্থদ্যোতক কিংবা অর্থবাচক অংশ পাওয়া যায় না। উদাহরণের অন্তর্গত 'গোলাপ' শব্দটি হয়ত 'গো' এবং 'লাপ' এই দুটি অংশে ভাগ করার চেষ্টা করা যেতে পারে। কিন্তু লক্ষণীয় যে, 'গো' অংশটি অর্থপূর্ণ হলেও এর সঙ্গে গোলাপের কোনো সম্পর্ক নেই, আর লাপ বাংলা ভাষার কোনো শব্দই নয়। ফলে, গোলাপ শব্দটিকে আর কোনো ক্ষুদ্র অংশে ভাগ করা যায় না। এই শব্দগুলোই মৌলিক শব্দ।

মৌলিক শব্দ গঠনের নিয়ম :-

মৌলিক শব্দ গঠনের ৩টি উপায় আছে। অর্থাৎ ৩ ভাবে মৌলিক শব্দ গঠিত হয়ে থাকে।

ক) বর্ণের সাথে বর্ণ:

বর্ণের সাথে বর্ণ যোগ করে মৌলিক শব্দ গঠন করা হয়।

যেমনঃ ব + ল = বল। এখানে ব ল এই বর্ণ দুটিকে যোগ করে বল শব্দ গঠিত হয়েছে।

একইভাবে আম আম, বই বই, মন মন ইত্যাদি উদাহরণ হিসেবে বলা যায়।

খ) 'কা-র' যোগে :

স্বরবর্ণের সংক্ষিপ্ত রূপকে 'কার' বলা হয়। সরল বর্ণের সাথে 'কার' যোগ করে শব্দ গঠন করা হয়। যেমনঃ পড়া শব্দটি। (প+অ=প), (ড়+আ=ড়া) এই দুটো মিলে প + ড়া = 'পড়া' শব্দটি তৈরি হয়েছে। এখানে 'প' এর সাথে যে 'অ' যুক্ত হয়েছে সেটা “পড়া' শব্দে দেখা যাচ্ছে না। কারণ 'অ' বর্ণের কোন সংক্ষিপ্ত রূপ নেই, তাই অ- 'প' ব্যঞ্জনের সাথে অন্তলীন হয়ে গেছে বা মিশে গেছে।

গ) ফলা যোগে:

ব্যঞ্জনবর্ণের সংক্ষিপ্ত রূপকে 'ফলা' বলা হয়। সরল বর্ণের সাথে ফলা যোগ করে শব্দ গঠন করা হয়। যেমনঃ ছাত্র শব্দটি। (ছ+আ = ছা), (ত+র=ত্র) এই দুটো মিলে ছা + এ = 'ছাত্র' শব্দটি তৈরি হয়েছে।

মৌলিক শব্দ কত প্রকার ও কি কি :-

সুকুমার সেন বাংলা শব্দের ভান্ডারে এই মৌলিক শব্দ আবার তিন প্রকার-

ক. তৎসম শব্দ

খ. অর্ধতৎসম শব্দ এবং

গ. তদ্ভব শব্দ।

এগুলো সম্পর্কে নীচে আলোচনা করা হলো:  

ক. তৎসম শব্দ :-

যে সমস্ত শব্দ প্রাচীন ভারতীয় আর্য বা সংস্কৃত ভাষা থেকে সরাসরি বাংলা ভাষায় এসেছে এবং অবিকৃত রূপে বাংলা ভাষায় টিকে আছে সেই সমস্ত শব্দ কে তৎসম শব্দ বলা হয়।

যেমন:- পিতা, মাতা, শিক্ষালয়, আচার্য, শিক্ষক, সকল, পদ, ঘাস প্রভৃতি হল বাংলা শব্দ ভান্ডারের তৎসম শব্দের উদাহরণ।

এই তৎসম শব্দ কে আবার অনেক ভাষাতাত্ত্বিক দুই ভাগে ভাগ করেছেন যথা- সিদ্ধতৎসম শব্দ ও অসিদ্ধতৎসম শব্দ

সিদ্ধতৎসম শব্দ: যেসব শব্দ বৈদিক বা সংস্কৃত সাহিত্যে পাওয়া যায় এবং যেগুলি ব্যাকরণ সিদ্ধ সেগুলিকে সিদ্ধতৎসম বলা হয় যেমন:- সূর্য, মিত্র, কৃষ্ণ, লতা, প্রভৃতি শব্দ।

অসিদ্ধতৎসম শব্দ:- যে সকল শব্দ বৈদিক বা সংস্কৃত সাহিত্যে পাওয়া যায় না এবং সংস্কৃত ব্যাকরণ শু নয়, তাকে অসিদ্ধতৎসম শব্দ বলে যেমন- কৃষাণ, ঘর, চল, ডাল, প্রভৃতি শব্দ।

খ. অর্ধতৎসম শব্দ :-

যে সমস্ত শব্দ প্রাচীন ভারতীয় আর্য (বৈদিক / সংস্কৃত) থেকে মধ্যবর্তী স্তর প্রাকৃতের মাধ্যমে না এসে সোজাসুজি বাংলা ভাষায় এসেছে এবং পরবর্তীকালে লোকমুখে কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত ও বিকৃতি লাভ করেছে তাকে অর্ধতৎসম শব্দ বলে।

যেমন-কৃষ্ণ কেষ্ট, নিমন্ত্রণ- নেমন্তন্ন ক্ষুধা খিদে, রাত্রি রাত্তির প্রভৃতি।

গ. তদ্ভব শব্দ :-

যে সমস্ত শব্দ প্রাচীন ভারতীয় আর্য বা সংস্কৃতি থেকে সোজাসুজি বাংলা ভাষায় আসেনি মধ্যবর্তী প্রাকৃতের মাধ্যমে পরিবর্তন লাভ করে বাংলা ভাষায় এসেছে তাদের তদ্ভব শব্দ বলা হয়।

খাঁটি বাংলার মূল শব্দ সম্পন্ন হল তদ্ভব শব্দ। এই শব্দ আবার দুই প্রকার যথা- নিজস্ব তদ্ভব ও বিদেশি তদ্ভব।

নিজস্ব তদ্ভব :- যেসব তদ্ভব শব্দ যথার্থই বৈদিক সংস্কৃতির নিজস্ব শব্দের পরিবর্তনের ফলে বাংলা ভাষায় এসেছে সেগুলিকে নিজস্ব তদ্ভব শব্দ বলা হয়ে থাকে। যেমন- ইলাগার ইন্দাআর ইন্দরা, উপাধ্যায় উদ্রকায় ওকা, একাদশ এগারহ - এগারো।

বিদেশি তদ্ভব শব্দ : যেসব শব্দ প্রথমে বৈদিক বা সংস্কৃত ভাষায় ইন্দো-ইউরোপীয় বংশের অন্য ভাষা থেকে বা ইন্দো- ইউরোপীয় ছাড়া অন্য বংশের ভাষা থেকে কৃতঋণ শব্দ হিসাবে এসেছিল এবং পরে প্রাকৃতের মাধ্যমে পরিবর্তন লাভ করে বাংলায় এসেছে সে সব শব্দকে বিদেশি তদ্ভব শব্দ বলা হয়ে থাকে। যেমন

ক. ইন্দো-ইউরোপীয় বংশ থেকে – দ্রামে (গ্রিক) দ্রম্য (সংস্কৃত) দম্ম (প্রাকৃত) দাম (বাংলা)।

খ. ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবংশ ভিন্ন অন্য বংশ থেকে- পিটল্ল (তামিল) পিল্লিক (সংস্কৃত) পিল্লিঅ (প্রাকৃত) পিলে (বাংলা) ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ