ধ্বনিতত্ত্ব কাকে বলে? ধ্বনি পরিবর্তনের কারণ কি?

ধ্বনিতত্ত্ব কাকে বলে :-

ভাষা নদী প্রবাহের সঙ্গে তুলনীয়। নদীর প্রধান ধর্ম স্রোত বা গতি, ভাষারও তাই। নদী থেমে থাকা মানে তার মৃত্যুর সূচনা, কালে সে শুকিয়ে যায়। তেমনি ভাষা মানুষের মুখে, লিপিতে, গ্রন্থে তার প্রতিষ্ঠা হারালে ক্রমশ তা বালুকাময় শুকনো নদীর মতো অতীতের স্মৃতি চিহ্নে পরিণত হয় 'মৃত ভাষা' রূপে।

কিন্তু সূক্ষ্ম বিচারে কোনো ভাষা কখনও মরে না, যদি সত্যি সত্যিই সে তার রূপ বদলায়। নদী যেমন বদলায় তার স্রোত মুখ, ভাষাও বদলায় তার ন্যূনতম একক 'ধ্বনি'।

নদীর খাত বদলের মতো ভাষাও যুগে যুগে তার প্রকৃতি বদলায়। নদীর গতিপথ পরিবর্তনের মতো মূল ভাষার ধ্বনি নিয়ে তার উচ্চারণ বা শ্রুতির পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে ধ্বনিকে বিচার করাই হল ধ্বনিতত্ত্ব। এক কথায় সাংগঠনিক পদ্ধতিতে ভাষার ধ্বনি সংগঠন বিশ্লেষণকে বলে ধ্বনিতত্ত্ব বা Phonology.

ধ্বনি পরিবর্তনের কারণ :-

কালের পরিবর্তনের সাথে সাথে ধ্বনির পরিবর্তন ঘটে, ভাষা শরীরের ক্রম পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে। এই পরিবর্তন ঘটে ভাষার বহিরঙ্গে এবং অভ্যন্তরে। বহিরঙ্গে পরিবর্তন ঘটে ভাষার মূল উপাদান ধ্বনিতে এবং অন্তরঙ্গ পরিবর্তন ঘটে অর্থে।

ভাষাবিজ্ঞানের বিশেষ এক ধারা— বর্ণনামূলক ভাষাবিজ্ঞান অনুযায়ী দু রকম ধ্বনি পরিবর্তন হয়—

১. সাধারণ ধ্বনি পরিবর্তন। এখানে সাধারণত বাক্ ব্যবহারে বিশেষ অর্থ পার্থক্য ঘটে না।

২. ব্যাকরণ সম্মত ধ্বনি পরিবর্তন। এই পরিবর্তনের পেছনে ব্যাকরণের প্রভাব থাকে।

আরও পড়ুনঃ মৌলিক স্বরধ্বনি কাকে বলে?

এই দুটি কারণ ছাড়াও নানা কারণে ধ্বনির পরিবর্তন ঘটে থাকে। যেমন—উচ্চারণের ত্রুটি, জিহ্বার জড়তা, আরামপ্রিয়তা; ভৌগোলিক পরিবেশ, অবস্থান; শ্রবণ ও বোধের ত্রুটি। ভিন্ন ভাষা সম্প্রদায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগ; বিশেষ ব্যক্তি বা পরিবারের বাক্ ও উচ্চারণ ভঙ্গী; ভাষা ব্যবহারকারীর মানসিক দৃষ্টিভঙ্গী ও অবস্থান; নিকটস্থ ধ্বনির প্রভাব ইত্যাদি।

ধ্বনি পরিবর্তনের বাহ্যিক কারণ :-

ধ্বনি পরিবর্তনের বাহ্যিক কারণগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-

১. ভৌগোলিক প্রভাব :

একই ধ্বনি স্থান বিশেষে অর্থাৎ প্রাকৃতিক ও ভৌগোলিক অবস্থা বিশেষে পরিবর্তিত হতে পারে। এই পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী একথা জোর দিয়ে বলা যায় না। তবে ভৌগোলিক অবস্থান, জলবায়ু, নির্দিষ্ট এলাকায় লোকেদের দৈহিক গঠন ও মানসিক প্রক্রিয়াজাত কারণে ধ্বনির পরিবর্তন কখনও কখনও হয়ে থাকে।

২. সামাজিক প্রভাব :

দেশের সামাজিক অবস্থা ধ্বনির প্রকৃতি নির্ণয়ে প্রভাব ফেলে। দেশে শান্তি থাকলে উচ্চারণ বিকৃতি কমে, কিন্তু অশান্তি বা যুদ্ধ-বিগ্রহের ফলে বিশেষ শব্দ বারবার ব্যবহারে ধ্বনি পরিবর্তনের পরিমাণ বেড়ে যায়।

৩. ঐতিহাসিক প্রভাব:

কালের গতির সঙ্গে তাল রেখে ইতিহাসের ধারা পরিবর্তনের মতোই ধ্বনি পরিবর্তিত হয়। যেমন— সিন্ধু > হিন্দু, নখহরণিকা > নরুণ।

৪. অন্য ভাষার প্রভাব :

ভৌগোলিক বা রাজনৈতিক কারণে দুটি ভাষাভাষী মানুষের একত্র বাস, মেলামেশা প্রভৃতির কারণে উভয়ের ভাষার উচ্চারণ রীতি স্বাতন্ত্র্য হারিয়ে ধ্বনিগত পরিবর্তন ঘটায়।

৫. ব্যক্তিগত প্রভাব :

ব্যক্তি বিশেষের উচ্চারণ রীতি ক্ষেত্রবিশেষে ধ্বনির পরিবর্তন ঘটিয়ে দেয়। ক্রমে তা পরিবারের বা অন্যের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। কোনো ব্যক্তি প্রভাবশালী বা প্রতিভাবান হলে, এমনটি ঘটে। ড. সুকুমার সেন যথার্থই বলেছেন—ভাষার বিশেষত্বের জট খুললে ব্যক্তি বা পরিবার বিশেষের বাক্ ব্যবহার পাওয়া সম্ভব।

৬. লিপি বিভ্রাট :

অপর কোনো ভাষার শব্দ লিখতে গিয়ে সম বর্ণের অভাবে কাছাকাছি উচ্চারণে নিয়ে আসার চেষ্টা হয়, ফলে ধ্বনিতে পরিবর্তন ঘটে যেতে পারে। যেমন, বাঙালি 'বসু' ইংরেজীর বদান্যে > বোস/বাসু; ক্যালকাটা > কলিকাতা, কোলকাতা, কলকাতা। আরবী 'প'-এর অভাবে লেখা 'পারশি' হয়েছে কারশি, ফারসি।

ধ্বনি পরিবর্তনের অভ্যন্তরীণ কারণ :-

ধ্বনি পরিবর্তনের অভ্যন্তরীণ কারণগুলোর মধ্যে দুটো পৃথক বিভাগ করা যায় -

(ক) শারীরিক কারণ :-

শারীরিক কারণজনিত ধ্বনি পরিবর্তন ঘটে থাকে। যেমন—

১. বাগ্যন্ত্রের ত্রুটি :

বক্তার বাগ্যন্ত্রের ত্রুটি থাকলে ধ্বনি যথাযথ ভাবে উচ্চারিত হয় না। কেননা বাগ্যন্ত্রের সাহায্যেই ধ্বনি উচ্চারিত হয়। জিহ্বার জড়তা থাকলেও ত্রুটি ঘটে। 

যেমন - শ > স > ছ, তোতলার উচ্চারণ প্রভৃতি।

২. শ্রবণযন্ত্রের ত্রুটি :

শ্রোতার শ্রবণযন্ত্রের ত্রুটির জন্যে বক্তার কথা শ্রোতা যথাযথ শুনতে পায় না। কানের ত্রুটি থাকলে শব্দ বা ধ্বনি ঠিক্‌ঠক্ শোনা যায় না, শ্রবণ ও বোধের ত্রুটিতে বা ঘাটতিতে ধ্বনি পরিবর্তিত হয়ে যায়।

আবার, অপরিচিত বা স্বল্প পরিচিত শব্দ উচ্চারণের দোষে শ্রোতা যথার্থ উচ্চারণ না বুঝে ভ্রান্ত একটা ধারণায় তা ব্যবহার করে। 

যেমন- মোচলমান (মুসলমান) সম্বোধন 'আচ্ছালামু আলায়কুম' > 'আর ছালায় ম্যালকুম' হয়ে যায় অনেক সময়।

৩. অনুকরণ বা অনুসরণে অক্ষমতা :

বক্তার অসাবধানতা, অজ্ঞতা, আলস্যের কারণে বুঝতে না পেরে শ্রোতার ভুল অনুকরণে অনেক সময় ধ্বনি পরিবর্তিত হয়ে যায়। 

যেমন—কেউ কেউ 'ব্যবহার'কে বলেন 'ববহার'। বর্ণ বিপর্যয়ে রিক্সা > রিস্কা প্রভৃতি।

৪. দ্রুত উচ্চারণের ত্রুটি :

তাড়াহুড়ো করে কথা বলতে গিয়ে শব্দ মধ্যে কোথাও কোনো বর্ণ লুপ্ত হয়ে ধ্বনিকে পরিবর্তিত করে দেয়। 

যেমন— কোথায় যাবে > কোজ্জাবে, মাস্টার মশাই > মাস্টামশাই ইত্যাদি।

৫. অল্প আয়াস বা আরাম প্রবণতা :

বক্তা কোনো শব্দের সহজ উচ্চারণ করতে যুক্ত ব্যঞ্জন ভেঙে বা সমীকৃত করে, কিংবা নতুন ধ্বনির আগমন ঘটিয়ে অথবা অন্য উপায়ে ধ্বনিতে পরিবর্তন নিয়ে আসে, ফলে ধ্বনির পরিবর্তন ঘটে। 
যেমন কর্ম > কম্মো, জন্ম > জন্মো ইত্যাদি।

(খ) মানসিক কারণ :-

মানসিক কারণজনিত ধ্বনি পরিবর্তন অনেক ক্ষেত্রেই ঘটে—

১. সাদৃশ্যগত কারণে ধ্বনির পরিবর্তন হয়। বস্তুত ধ্বনি পরিবর্তনে সাদৃশ্যের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

যেমন— বধু > বৌ এবং বধূটিকা > বউড়ি শব্দ হয়েছে, শ্বশু > শাস > শাশুড়ী। ঝি > কিউড়ি, দ্বাদশ শব্দ সাদৃশ্যে হয়েছে একদশ > একাদশ।

২. লোকনিরুক্তির ফলে ধ্বনি পরিবর্তিত হয়। অপরিচিত এবং উচ্চারণ করা কঠিন, এমন শব্দ কম বেশি ধ্বনি সাম্যের সুযোগে পরিচিত শব্দের সাদৃশ্য লাভ করে। ফলে শব্দটির উৎস নির্ণয়ে বিকৃতি জনিত ধ্বনি পরিবর্তন ঘটে, এটাই লোকনিরুক্তি। সাধারণ মানুষ ব্যাকরণ না মেনে নিজের ইচ্ছেমতো শব্দের ব্যুৎপত্তি খোঁজেন। 

যেমন— ইং, হসপিটাল > হাসপাতাল, আর্মচেয়ার > আরাম কেদারা, বিস্ফোটক > বিষফোঁড়া ইত্যাদি।

৩. শ্বাসাঘাত বা অসাবধানতা জনিত কারণে ধ্বনিপরিবর্তন ঘটে। অজ্ঞতা বা অসাবধানে শব্দের যথাস্থানে শ্বাসের আঘাত না পড়ে অন্যত্র শ্বাসাঘাত পড়ে, ফলে ধ্বনি পরিবর্তন ঘটে যায়। এই শ্বাসাঘাতের ফলে শব্দের আদি-মধ্য-অন্ত্য স্বরেও প্রভাব পড়তে পারে বা স্বতো-দ্বিত্বভবন ঘটে যায়।

যেমন, গামোছা’— আদি স্বরে শ্বাসাঘাতের ফলে হয় 'গাম্‌ঘ্য', 'সকল > সকল, ছোট > ছোট্ট।

৪. বিশুদ্ধি প্রবণতা :

সাধু রীতিতে শুদ্ধ শব্দকে অশুদ্ধ ভেবে তাকে শুদ্ধ ভাবে উচ্চারণ করতে গিয়ে বিকৃত হয়ে শব্দটি অশুদ্ধ হয়ে ওঠে, ফলে শব্দের ধ্বনি ও অর্থ পরিবর্তন ঘটে যায়। 

যেমন— বেনেগাঁও > বাণীগ্রাম, ইঁট আমতলা > ইষ্টআম্রস্তলক (গ্রামের নাম), পুষ্ট > পুরুষ্ট, উৎকৃষ্ট > উৎকৃষ্ণ ইত্যাদি।

৫. আবেগময়তা বা ভাব প্রবণতার জন্যে ধ্বনি পরিবর্তন ঘটে। স্নেহ-প্রীতি বা শ্রদ্ধাবশে অনেক সময় কোনো কোনো শব্দকে অতিরিক্ত ধ্বনি দিয়ে উচ্চারণ করা হয়ে থাকে, যাতে শব্দটির মধ্যে ভালো লাগা বোধটি জড়িয়ে যায়। এরই ফলে ঘটে ধ্বনি পরিবর্তন (আবেগ বা ভাবের ঘোরে)।

যেমন—আইমা > আম্মা > মাম্মা; বাবা > বাম্বাবা: দুষ্ট > দুষ্টু; বাবা > বাপু (বড়দের ক্ষেত্রে), কাকা > কাকু ইত্যাদি।

৬. অজ্ঞতা বশে কখনও কখনও ধ্বনি পরিবর্তন ঘটে যায়। হয়ত অজ্ঞতার জন্যেই উচ্চারণে অক্ষমতা আসে বা না জেনে ভুল শব্দ শুদ্ধ ভেবে উচ্চারণ করতে গিয়ে ধ্বনি পরিবর্তিত হয়।

যেমন—ব্যাজ > ব্যাচ, ফর্ম > ফ্রম, উচ্চারণ > উচ্চারণ ইত্যাদি।

৭. কুসংস্কার বা অন্ধ বিশ্বাস থেকে কোনো শব্দ উচ্চারণের যোগ্য না হলে, তাকে বিকৃত করে উচ্চারণের ফলে ধ্বনি পরিবর্তন ঘটে যায়।

যেমন – বিদ্যুৎলতা দেবী স্বামীর নাম 'নাড়ু' বলে তাঁর নাম না নিয়ে সারা জীবনব্যাপী 'নাড়'কে বলেন 'গুলি', নাগু সাধু ইত্যাদি।

৮. অন্যমনস্কতা-র জন্য বক্তা পরপর শব্দ উচ্চারণ করতে গিয়ে বর্ণ বিপর্যয় ঘটিয়ে ধ্বনির পরিবর্তন সাধিত করে।

যেমন—এক কাপ চা > এক চাপ কা, হাতে ছাতি ইত্যাদি।

৯. ছন্দের লালিত্য বা কবিতার কোমলতার জন্য অনেক সময় ধ্বনি পরিবর্তিত হয়। কবি সাহিত্যিকরা ছন্দ মিল বা ধ্বনির সূক্ষ্ম উচ্চারণে সচেতন ভাবেই ধ্বনির পরিবর্তন ঘটান। 

যেমন— জন্ম > জনম্, পাখি শব্দের সৌন্দর্য আনতে পাথ / পাথালি, জগৎ 'জিনে' কাব্যিক কারণে পরিবর্তিত।

১০. দীর্ঘ শব্দকে সংক্ষিপ্ত করার জন্য ধ্বনি পরিবর্তন ঘটানো হয়। যেমন—

খাইবার > খাবার, ক্যালিবার > ক্যালি, সারেগামা, ল.সা.গু ইত্যাদি।

উল্লেখ্য, ধ্বনি পরিবর্তনের উল্লিখিত কারণগুলোর মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ— ভৌগোলিক অবস্থান, জলবায়ু, পরিবেশ জনিত প্রভাব, ভাষা ব্যবহারকারীর মানসিক দৃষ্টিভঙ্গি, অন্য ভাষা গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ, নিকটস্থ ধ্বনির প্রভাব এবং শ্রবণ ও বোধের ত্রুটি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ