ধ্বনি পরিবর্তনের রীতি বা ধারা

ধ্বনি পরিবর্তনের কারণ সম্পর্কে ধারণা হলেই প্রশ্ন জাগে এই পরিবর্তন কি কোনও রীতি বা সূত্র মেনে চলে? উত্তর এক কথায় হ্যাঁ।

ভাষায় ধ্বনি পরিবর্তন গণিতের ফর্মুলার মতোই নির্দিষ্ট সূত্র মেনে চলে। তবে গাণিতিক ফর্মুলার ব্যতিক্রম না হলেও, ধ্বনি পরিবর্তনের ফর্মুলা তেমনটি নয়, এর ব্যতিক্রম আছে। এই বাতিক্রমের কারণ— ভাষা জড়বস্তু নয়।

বুদ্ধি মান সামাজিক বোধসম্পন্ন প্রকৃতি জগতের শ্রেষ্ঠ প্রাণী মানুষ— মানুষই ভাষার জন্মদাতা, ভাষার ধারক, বাহক। তাই মানুষের মনে যা নেই, মানুষের ভাষাতেও তা নেই।

মনের খেয়ালেই মনে নিয়ম ভাঙার ইচ্ছে জন্মায়। আর তখনই ধ্বনি পরিবর্তনের নিয়মের রাজত্বে ব্যতিক্রমী ব্যাপার ঘটে। সর্বদা নয়, মাঝে মাঝে মানুষের মনে সাম্যবোধকে অগ্রাধিকার দিতেই—একই শ্রেণীর পদের ভিন্ন ভিন্ন রূপ কে নিয়মে একটা ধরাবাঁধা নিয়মে বাঁধতে চাই। এই সাম্যবোধের জন্যেই ভাষা যত জীবন্ত হবে, যত বেশি চলমান হবে, তত ব্যাকরণ হতে থাকবে সোজা — সহজ। যদিও তা চলতে থাকবে একটা সূত্র মেনেই।

ধ্বনি পরিবর্তনের নিয়ম মেনে মধু > মউ, বধূ > বউ হয়। প্রাচীন বাংলার পদের শেষে ই, উ পশ্চিমবঙ্গের উপভাষায় লুপ্ত হয়, তাই রাতি > রাত। সংস্কৃত যুক্ত ব্যঞ্জন > প্রাকৃতে যুগ্ম, কিন্তু বাংলায় একক ব্যঞ্জন হয়। এই নিয়মে সপ্ত> সত্ত> সাত, অষ্ট > অঠ > আট। কিন্তু সর্ব > সব সব। সাব' নয় কেন? এটাই ব্যতিক্রম।
 
আরও পড়ুনঃ ধ্বনির লোপ কাকে বলে? 

এর কারণ তখন বহুবচন বোঝাতে 'সভা' শব্দের প্রচলন ছিল, সে সময় প্রাকৃত থেকে বাংলার জন্ম হয়েছে। এখন গণ, সমূহ, রাশি ইত্যাদিতে বহুবচন বোঝান হয়। কিন্তু 'সর্ব' এবং 'সভা' দুটো শব্দই ছিল বহুবচন স্থাপক। তাই 'সভ্য' শব্দের প্রভাবে সাব' না হয়ে 'সব' হয়েছে। সে কারণে ধ্বনি পরিবর্তনের সূত্র নির্ণয়ের পূর্বে আমাদের দুটো বিষয় মনে রাখতে হবে–

১. ধ্বনি পরিবর্তনের নিয়ম শুধু বিশেষ কোনও ভাষার, বিশেষ অবস্থায় প্রয়োগ করার যোগ্য, অন্য কোনও অবস্থায় নয়।

২. শব্দের মধ্যে অবস্থিত ধ্বনিগুলোর সুনির্দিষ্ট সংস্থানেই কেবলমাত্র সূত্র অনুযায়ী পরিবর্তন ঘটবে, অন্য কোনও ভাবে নয়।

ধ্বনি পরিবর্তনের রীতি বা সূত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে কোনও ভাষাতেই বিচিত্র ভাবে ধ্বনির পরিবর্তন ঘটেছে। কেন, কিভাবে, কোন্ পরিস্থিতিতে তা ঘটেছে? ধ্বনি পরিবর্তনের প্রবৃত্তি কিরূপ? তা নিয়ে অনুসন্ধান করলেই শৃঙ্খলাবদ্ধ বিষয়টি অস্পষ্ট থাকে না।

ধ্বনি পরিবর্তনের এই প্রবৃত্তিগুলো মূলত দুটি ধারায় কল্পনা করা যায়—

(i) বিবর্তনমূলক বা সংযোগমূলক ও

(ii) মনোবিষয়ক।

এর মধ্যে রয়েছে সাদৃশ্য ও বিভ্রান্তি। যাকে সহজ কথায় বলা যায় সাধারণ ধ্বনি পরিবর্তন ও ব্যাকরণ গত ধ্বনি পরিবর্তন। এগুলোর ভিত্তিতেই ভাষাবিজ্ঞানীদের বিস্তৃত গবেষণার ধ্বনির প্রধান চারটি সূত্র বা ধারা প্রতিষ্ঠিত -

১. নতুন ধ্বনির আগম,

২. ধ্বনিলোপ,

৩. ধ্বনির রূপান্তর ও সমন্বয়,

৪. ধ্বনির স্থানান্তর বা বিপর্যাস।

এদের প্রতিটি ধারায় আবার ধ্বনি পরিবর্তনের বিভিন্ন সূত্র রয়েছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ