এই পোস্টে আমরা দেশি ও বিদেশি শব্দ কাকে বলে সে সম্পর্কে আলোচনা করব।
ভাষাতাত্ত্বিকদের মতে বৈদিক বা সংস্কৃতভাষা থেকে সরাসরি বা প্রাকৃতের পথ বেয়ে যে শব্দাবলি বাংলায় এসেছে, তাছাড়া অন্য সমস্তই শব্দগুলিই আগন্তুক বা কৃতঋণ শব্দ।
এক কথায় আমরা বলতে পারি—এগুলি কোনো অবস্থাতেই বৈদিক বা সংস্কৃত ভাষাজাত শব্দ নয়, অন্যভাষা থেকে সংস্কৃতের পথ বেয়ে প্রাকৃতের বিবর্তনধারা পার হয়ে আসা শব্দও নয়, এগুলি ভারতের অন্য কোনো প্রদেশের বা বিদেশি কোনো ভাষা থেকে সরাসরি বাংলা ভাষায় গৃহীত শব্দাবলি।
মনে রাখবেন 'কৃতঋণ তদ্ভব শব্দগুলি সংস্কৃত ভাষায় আগে এসেছিল, তারপর বাংলাভাষায়। কিন্তু আগন্তুক / কৃতঋণ শব্দগুলির গায়ে সংস্কৃতের ছোঁয়াচ লাগেনি, সেগুলি সরাসরি বাংলায় এসেছে তাদের উৎস ভাষা থেকে।
এই আগন্তুক শব্দগুলিও আবার দুটি শ্রেণিতে বিন্যস্ত হতে পারে
১. দেশি
২. বিদেশি।
এই দেশি কৃতঋণ শব্দ কে আবার দুইভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে যথা
যেমন- ডাব, ঝাঁটা, ঝোল, ডোম, ঝিঙ্গা, কুলা, কান্দি, মুড়ি, উচ্ছে, খুকি, ইত্যাদি।
অর্থাৎ ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশে প্রচলিত নব্যভারতীয় আর্যভাষার বেশ কিছু শব্দ বাংলা ভাষায় গৃহীত হয়েছে এই শব্দকেই প্রাদেশিক শব্দ বলে। এগুলিও আগন্তুক বা কৃতঋণ পর্যায়ভুক্ত। যেমন—
পাঞ্জাবী ভাষা থেকে - শিখ, চাহিদা প্রভৃতি।
মারাঠী ভাষা থেকে- কর্মী, পাটিল।
গুজরাটী ভাষা থেকে - হরতাল, গরবা, খাদি, তকলি ইত্যাদি।
হিন্দী ভাষা থেকে - কুত্তা, পানি, লাগাতার, বন্ধ, ঝাণ্ডা, মিঠাই, সমঝোতা, বদলা, খতম, জলদি ইত্যাদি।
ভারতবর্ষে আর্যরা আসার আগে যে যে গোষ্ঠী এদেশে বাস করত, তাদের নিজস্ব ভাষার কিছু কিছু শব্দ আমরা বিভিন্ন ভারতীয় আর্যভাষায় গ্রহণ করেছিলাম। এই শব্দগুলির উৎপত্তি কোথা থেকে আসে তা জানা না থাকলেও আধুনিক ভাষাতাত্ত্বিক গবেষণায় দ্রাবিড়, অষ্ট্রিক বা ভোট-বর্মী ভাষাগোষ্ঠীকে এগুলির উৎস হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
আগেই দেখেছেন, এইসব ভাষার বেশ কিছু শব্দ সংস্কৃতে গৃহীত হয়ে তৎসম শব্দের মর্যাদা লাভ করেছে। অন্যান্য আরো কিছু শব্দ বাংলাভাষায় সরাসরি প্রবেশ করে 'দেশি শব্দ' হিসাবে আমাদের শব্দভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করে তুলেছে।
যেসব শব্দ ভারতবর্ষের বাইরের অন্য কোনো দেশে প্রচলিত ভাষার থেকে বাংলা ভাষায় গৃহীত হয়েছে, সেইসব শব্দগুলি বিদেশি কৃতঋণ শব্দ হিসাবে চিহ্নিত হতে পারে।
বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিদেশি জাতি এদেশে আসে এবং শাসনতান্ত্রিক বা ব্যবসায়িক প্রয়োজনে দীর্ঘকাল যাবৎ এদেশে বসবাস করে। তাদের নিজস্ব ভাষার বেশ কিছু শব্দ এই সহাবস্থানের ফলে বাংলাভাষায় অনুপ্রবেশ করেছিল এবং বর্তমানে বাংলাভাষার দেহে তারা এমনভাবে মিশে গেছে যে এদের আর বিদেশি বলে চেনার উপায়ও নেই।
এই সূত্রে সর্বপ্রথম উল্লিখিত হতে পারে তুর্কি-মুঘল-পাঠান জাতীয় মুসলমানদের সঙ্গে সঙ্গে এদেশে আগত আরবি, ফারসি ও তুর্কি শব্দাবলি। প্রায় হাজার বছর আগে আসা এইসব ভাষা ব্যবহারকারী মুসলমানরা রাজনৈতিক কারণে এদেশে প্রায় সাতশ' বছর শাসক হিসাবে ছিলেন। ফলে রাজভাষা হিসাবে এদেশে এইসব ভাষাগুলির একসময়ে যথেষ্ট অর্থকরী জনপ্রিয়তা এবং প্রতিপত্তি ছিল। এই কারণেই অতি দ্রুত এবং ব্যাপকভাবে এইসব ভাষার শব্দাবলি বাংলাভাষায় প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছিল।
মূলত ফারসি এবং ফারসির মাধ্যমেই কিছু তুর্কি ও আরবি শব্দকে বাংলাভাষা আত্মীকরণ করে নিজস্ব সম্পদে পরিণত করেছে। ভাষাতাত্ত্বিকদের মতে প্রায় আড়াই হাজার ফারসি ও ফারসি মাধ্যমে আগত আরবি ও তুর্কি শব্দ বাংলা শব্দভাণ্ডারের একটা বৃহৎ অংশ জুড়ে আছে। যেমন
ফারসি শব্দ—হাওয়া, রোজ, হপ্তা, উকিল, জমি, মজুর, আন্দাজ, জাহাজ, পেয়ালা, খুব, জোর দূরবীন, সিন্দুক প্রভৃতি।
আরবি শব্দ (ফারসি মাধ্যমে)- আইন, আক্কেল, কেচ্ছা (কস্স্সিা), কিতাব, জেলা, তাজ্জব, নিক্তি, আতর ইত্যাদি।
তুর্কি শব্দ (ফারসি মাধ্যমে) - চাকু, তকমা, বাহাদুর, কাঁচি, কুলী, উর্দু, কাবু, বিবি, বোচকা, আলখাল্লা, ইত্যাদি।
এরই দ্বিতীয় পর্যায় দেখা দিল ঊনবিংশ শতক থেকে যখন ইংরেজি শাসনকর্মের ভাষা হিসাবে পূর্ণমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হল। তখন ইংরেজি ভাষা শুধুই প্রশাসনিক ক্ষেত্রে নয়, পশ্চিমের শিল্প-সাহিত্য-দর্শন চর্চার ক্ষেত্রেও অপরিহার্য। ফলত ইংরেজি ভাষার আধিপত্য দেখা দিল এবং বাংলাভাষায় এর বহু সংখ্যক শব্দ ক্রমশ এমনভাবে প্রবেশ করল যে বর্তমানে সেগুলি, সমার্থক তৎসম বা তদ্ভব শব্দের থেকে অনেক বেশি সক্রিয় ও জোরালো।
লক্ষ্য করে দেখবেন, এই শব্দগুলির অধিকাংশেরই কোনো বাংলা প্রতিশব্দ নেই (যেমন—টিকিট, সাইকেল, ইঞ্জিন, টেবিল, গ্লাস, ট্রাম, বাস, ইঞ্জেকশন, বাল্ব ইত্যাদি)। অর্থাৎ এরকম ইংরেজি শব্দগুলি আমাদের কাছে অপরিহার্যরূপে বিবেচিত। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত যত কথা বলি, তার সিংহভাগই জুড়ে আছে ইংরেজি শব্দ – অফিস (Office). লণ্ঠন (Lantern), বাকস ( Box), হাসপাতাল ( Hospital), ডাক্তার (Doctor), স্কুল (School), পুলিশ (Police), চেয়ার (Chair), টেবিল (Table ), ক্লাস, জাঁদরেল (General), স্যার (Sir) ইত্যাদি।
সংখ্যাগত দিক থেকে এরপরই আসে পর্তুগিজ ভাষা থেকে আগত শব্দাবলির প্রসঙ্গ। প্রশাসনিক দিক থেকে নয়, বরং অন্য এক বিচিত্র সম্পর্কে বাংলাভাষার সঙ্গে এই ভাষার যোগসূত্র রচিত হয়েছে। এদেশের জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে অনেক নতুন বস্তু ও নবসংস্কৃতির পরিচয় পর্তুগিজ শব্দের মাধ্যমেই সংঘটিত হয়েছে। যেমন—অঙ্গতা, আনারস, আলপিন, আলমারি, কেরানি, চাবি, কপি, আলকাতরা, তোয়ালে, জানালা, বোতল, বালতি, কামরা, বেহালা, পেঁপে, মিস্ত্রি, সাবান, গামলা, পেরেক, সাগু, তামাক ইত্যাদি।
ফরাসিরাও পর্তুগিজ ও ইংরেজদের মতো এদেশে উপনিবেশ স্থাপন করায় কিছু ফরাসি শব্দও বাংলাভাষায় এসে গেছে। যেমন—কার্তুজ, কুপন, কাফে, রেস্তোরাঁ, রেনেশাঁস, বুর্জোয়া, আঁতাত, ম্যাটিনি, বিস্কুট, মেনু, ওমলেট ইত্যাদি।
সংখ্যালঘু ওলন্দাজ শব্দাবলি বাংলাভাষার ক্ষেত্রে একমাত্র তাসখেলার ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ হয়ে রয়েছে।
যেমন—হরতন, রুইতন, ইস্কাপন, তুরুপ। এগুলি ছাড়াও আরও কিছু বিদেশিভাষার শব্দ প্রধানত ইংরেজির মাধ্যমে বাংলা ভাষায় এসেছে। যেমন—
শব্দ সম্পদ হিসেবে বিদেশি এতগুলি ভাষার কাছে বাংলাভাষা ঋণী। কিন্তু শুধু এখানেই বিদেশি ভাষাগুলির ঋণদান থেমে থাকেনি। একটু লক্ষ্য করলেই বুঝতে পারবেন যে যুগোপযোগী এবং ভাবপ্রকাশের ক্ষেত্রে যুতসই নতুন শব্দ গড়ে নিতেও বাংলাভাষা কতবার কতরকমভাবে হাত বাড়িয়েছে বিদেশি ভাষার ভাণ্ডারে।
আসুন, আমরা এবার বিচিত্র পথে আসা বিদেশি শব্দের প্রভাবটিকে দেখি- বাংলা শব্দগঠনের ক্ষেত্রে।
(ক) লিঙ্গান্তর সাধনে-ফারসি ভাষার প্রভাবে পাওয়া মদ্দা কুকুর, মাদী কুকুর।
(খ) প্রত্যয় হিসাবে ফারসি 'আনা', 'গিরি', 'দার', 'বাজ', 'সই' প্রভৃতি যোগ করে তৈরি হয়েছে বিবিআনা, বাবুগিরি, কেরানিগিরি, বাজনদার, চালবাজ, খড়িবাজ, মাপসই, টেকসই ইত্যাদি শব্দাবলি।
(গ) উপসর্গ হিসাবে-ফরাসি থেকে আগত উপসর্গ 'ফি', 'বে', 'গর' ইত্যাদি যোগে ফিসন, ফিহপ্তা, বেমানান, বেহাত, গররাজি, গরহাজির—এই জাতীয় শব্দগুলির উৎপত্তি। আবার ইংরেজি কিছু শব্দও এইভাবে উপসর্গের ভূ মিকা পালন করে। যেমন- 'হাফ'-(হাফ-হাতা, হাফ-আখড়াই), 'ফুল' (ফুল-হাতা, ফুল-মোজা) বা 'হেড' (হেড পণ্ডিত, হেড মিস্ত্রী)।
(ঘ) সমাসবদ্ধ পদগঠনে ফারসি এবং ইংরেজি উভয় ভাষার কাছেই বাংলার ঋণ এ ব্যাপারে প্রায় সমান।
আমাদের কথা বাংলাভাষায় প্রতিনিয়ত কত যে এই গোত্রীয় শব্দ আমরা ব্যবহার করে চলেছি তা খুঁজে পেতে দেখলে চমকে যেতে হয়।
ফারসি প্রভাবজাত এরকম শব্দ রাজা-উজির, হাট-বাজার, শাকসব্জী, ধন-দৌলত, কাগজপত্র, আইন আদালত ইত্যাদি। ইংরেজি প্রভাবজাত এই পর্যায়ের শব্দ হিসাবে দেখতে পাবেন—মাস্টারমশাই, ডাক্তারবাবু, উকিল-ব্যারিস্টার, ডাক্তার-বদ্যি ইত্যাদি শব্দগুলিকে।
ভাষাতাত্ত্বিকদের মতে বৈদিক বা সংস্কৃতভাষা থেকে সরাসরি বা প্রাকৃতের পথ বেয়ে যে শব্দাবলি বাংলায় এসেছে, তাছাড়া অন্য সমস্তই শব্দগুলিই আগন্তুক বা কৃতঋণ শব্দ।
এক কথায় আমরা বলতে পারি—এগুলি কোনো অবস্থাতেই বৈদিক বা সংস্কৃত ভাষাজাত শব্দ নয়, অন্যভাষা থেকে সংস্কৃতের পথ বেয়ে প্রাকৃতের বিবর্তনধারা পার হয়ে আসা শব্দও নয়, এগুলি ভারতের অন্য কোনো প্রদেশের বা বিদেশি কোনো ভাষা থেকে সরাসরি বাংলা ভাষায় গৃহীত শব্দাবলি।
মনে রাখবেন 'কৃতঋণ তদ্ভব শব্দগুলি সংস্কৃত ভাষায় আগে এসেছিল, তারপর বাংলাভাষায়। কিন্তু আগন্তুক / কৃতঋণ শব্দগুলির গায়ে সংস্কৃতের ছোঁয়াচ লাগেনি, সেগুলি সরাসরি বাংলায় এসেছে তাদের উৎস ভাষা থেকে।
এই আগন্তুক শব্দগুলিও আবার দুটি শ্রেণিতে বিন্যস্ত হতে পারে
১. দেশি
২. বিদেশি।
(১) দেশি শব্দ কাকে বলে :-
যেসব শব্দ আমাদের দেশের অন্যান্য ভাষা থেকে সোজাসুজি বাংলা ভাষায় প্রবেশ লাভ করেছে তাকে দেশি কৃতঋণ শব্দ বা দেশি শব্দ বলে।এই দেশি কৃতঋণ শব্দ কে আবার দুইভাগে ভাগ করা হয়ে থাকে যথা
অন আর্য দেশি কৃতঋণ:
এদেশীয় অস্ট্রিক, কোল বা দ্রাবিড়, ভাষা বংশ থেকে যেসব শব্দ সরাসরি বাংলা ভাষায় এসেছে তাকে অন্ আর্য দেশি কৃতঋণ শব্দ বলে।যেমন- ডাব, ঝাঁটা, ঝোল, ডোম, ঝিঙ্গা, কুলা, কান্দি, মুড়ি, উচ্ছে, খুকি, ইত্যাদি।
আর্য দেশি কৃতঋণ শব্দ বা প্রাদেশিক শব্দ :
যে সকল শব্দ ভারতীয় আর্য ভাষার অন্যান্য শাখা থেকে বাংলায় এসেছে তাকে আর্য দেশি কৃতঋণ শব্দ বলা হয়। যেমন- হিন্দি- সেলাম, মস্তান, ওস্তাদ, ইত্যাদি। গুজরাটি- হরতাল ইত্যাদি।অর্থাৎ ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশে প্রচলিত নব্যভারতীয় আর্যভাষার বেশ কিছু শব্দ বাংলা ভাষায় গৃহীত হয়েছে এই শব্দকেই প্রাদেশিক শব্দ বলে। এগুলিও আগন্তুক বা কৃতঋণ পর্যায়ভুক্ত। যেমন—
পাঞ্জাবী ভাষা থেকে - শিখ, চাহিদা প্রভৃতি।
মারাঠী ভাষা থেকে- কর্মী, পাটিল।
গুজরাটী ভাষা থেকে - হরতাল, গরবা, খাদি, তকলি ইত্যাদি।
হিন্দী ভাষা থেকে - কুত্তা, পানি, লাগাতার, বন্ধ, ঝাণ্ডা, মিঠাই, সমঝোতা, বদলা, খতম, জলদি ইত্যাদি।
ভারতবর্ষে আর্যরা আসার আগে যে যে গোষ্ঠী এদেশে বাস করত, তাদের নিজস্ব ভাষার কিছু কিছু শব্দ আমরা বিভিন্ন ভারতীয় আর্যভাষায় গ্রহণ করেছিলাম। এই শব্দগুলির উৎপত্তি কোথা থেকে আসে তা জানা না থাকলেও আধুনিক ভাষাতাত্ত্বিক গবেষণায় দ্রাবিড়, অষ্ট্রিক বা ভোট-বর্মী ভাষাগোষ্ঠীকে এগুলির উৎস হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
আগেই দেখেছেন, এইসব ভাষার বেশ কিছু শব্দ সংস্কৃতে গৃহীত হয়ে তৎসম শব্দের মর্যাদা লাভ করেছে। অন্যান্য আরো কিছু শব্দ বাংলাভাষায় সরাসরি প্রবেশ করে 'দেশি শব্দ' হিসাবে আমাদের শব্দভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করে তুলেছে।
বিদেশি শব্দ কাকে বলে :-
যে সকল শব্দ এ দেশের বাইরের কোন ভাষা থেকে সরাসরি বাংলা ভাষায় প্রবেশ লাভ করেছে সেই শব্দগুলিকে বিদেশি শব্দ বলা হয়।যেসব শব্দ ভারতবর্ষের বাইরের অন্য কোনো দেশে প্রচলিত ভাষার থেকে বাংলা ভাষায় গৃহীত হয়েছে, সেইসব শব্দগুলি বিদেশি কৃতঋণ শব্দ হিসাবে চিহ্নিত হতে পারে।
বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিদেশি জাতি এদেশে আসে এবং শাসনতান্ত্রিক বা ব্যবসায়িক প্রয়োজনে দীর্ঘকাল যাবৎ এদেশে বসবাস করে। তাদের নিজস্ব ভাষার বেশ কিছু শব্দ এই সহাবস্থানের ফলে বাংলাভাষায় অনুপ্রবেশ করেছিল এবং বর্তমানে বাংলাভাষার দেহে তারা এমনভাবে মিশে গেছে যে এদের আর বিদেশি বলে চেনার উপায়ও নেই।
এই সূত্রে সর্বপ্রথম উল্লিখিত হতে পারে তুর্কি-মুঘল-পাঠান জাতীয় মুসলমানদের সঙ্গে সঙ্গে এদেশে আগত আরবি, ফারসি ও তুর্কি শব্দাবলি। প্রায় হাজার বছর আগে আসা এইসব ভাষা ব্যবহারকারী মুসলমানরা রাজনৈতিক কারণে এদেশে প্রায় সাতশ' বছর শাসক হিসাবে ছিলেন। ফলে রাজভাষা হিসাবে এদেশে এইসব ভাষাগুলির একসময়ে যথেষ্ট অর্থকরী জনপ্রিয়তা এবং প্রতিপত্তি ছিল। এই কারণেই অতি দ্রুত এবং ব্যাপকভাবে এইসব ভাষার শব্দাবলি বাংলাভাষায় প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছিল।
মূলত ফারসি এবং ফারসির মাধ্যমেই কিছু তুর্কি ও আরবি শব্দকে বাংলাভাষা আত্মীকরণ করে নিজস্ব সম্পদে পরিণত করেছে। ভাষাতাত্ত্বিকদের মতে প্রায় আড়াই হাজার ফারসি ও ফারসি মাধ্যমে আগত আরবি ও তুর্কি শব্দ বাংলা শব্দভাণ্ডারের একটা বৃহৎ অংশ জুড়ে আছে। যেমন
ফারসি শব্দ—হাওয়া, রোজ, হপ্তা, উকিল, জমি, মজুর, আন্দাজ, জাহাজ, পেয়ালা, খুব, জোর দূরবীন, সিন্দুক প্রভৃতি।
আরবি শব্দ (ফারসি মাধ্যমে)- আইন, আক্কেল, কেচ্ছা (কস্স্সিা), কিতাব, জেলা, তাজ্জব, নিক্তি, আতর ইত্যাদি।
তুর্কি শব্দ (ফারসি মাধ্যমে) - চাকু, তকমা, বাহাদুর, কাঁচি, কুলী, উর্দু, কাবু, বিবি, বোচকা, আলখাল্লা, ইত্যাদি।
এরই দ্বিতীয় পর্যায় দেখা দিল ঊনবিংশ শতক থেকে যখন ইংরেজি শাসনকর্মের ভাষা হিসাবে পূর্ণমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হল। তখন ইংরেজি ভাষা শুধুই প্রশাসনিক ক্ষেত্রে নয়, পশ্চিমের শিল্প-সাহিত্য-দর্শন চর্চার ক্ষেত্রেও অপরিহার্য। ফলত ইংরেজি ভাষার আধিপত্য দেখা দিল এবং বাংলাভাষায় এর বহু সংখ্যক শব্দ ক্রমশ এমনভাবে প্রবেশ করল যে বর্তমানে সেগুলি, সমার্থক তৎসম বা তদ্ভব শব্দের থেকে অনেক বেশি সক্রিয় ও জোরালো।
লক্ষ্য করে দেখবেন, এই শব্দগুলির অধিকাংশেরই কোনো বাংলা প্রতিশব্দ নেই (যেমন—টিকিট, সাইকেল, ইঞ্জিন, টেবিল, গ্লাস, ট্রাম, বাস, ইঞ্জেকশন, বাল্ব ইত্যাদি)। অর্থাৎ এরকম ইংরেজি শব্দগুলি আমাদের কাছে অপরিহার্যরূপে বিবেচিত। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত যত কথা বলি, তার সিংহভাগই জুড়ে আছে ইংরেজি শব্দ – অফিস (Office). লণ্ঠন (Lantern), বাকস ( Box), হাসপাতাল ( Hospital), ডাক্তার (Doctor), স্কুল (School), পুলিশ (Police), চেয়ার (Chair), টেবিল (Table ), ক্লাস, জাঁদরেল (General), স্যার (Sir) ইত্যাদি।
সংখ্যাগত দিক থেকে এরপরই আসে পর্তুগিজ ভাষা থেকে আগত শব্দাবলির প্রসঙ্গ। প্রশাসনিক দিক থেকে নয়, বরং অন্য এক বিচিত্র সম্পর্কে বাংলাভাষার সঙ্গে এই ভাষার যোগসূত্র রচিত হয়েছে। এদেশের জীবনযাত্রার ক্ষেত্রে অনেক নতুন বস্তু ও নবসংস্কৃতির পরিচয় পর্তুগিজ শব্দের মাধ্যমেই সংঘটিত হয়েছে। যেমন—অঙ্গতা, আনারস, আলপিন, আলমারি, কেরানি, চাবি, কপি, আলকাতরা, তোয়ালে, জানালা, বোতল, বালতি, কামরা, বেহালা, পেঁপে, মিস্ত্রি, সাবান, গামলা, পেরেক, সাগু, তামাক ইত্যাদি।
ফরাসিরাও পর্তুগিজ ও ইংরেজদের মতো এদেশে উপনিবেশ স্থাপন করায় কিছু ফরাসি শব্দও বাংলাভাষায় এসে গেছে। যেমন—কার্তুজ, কুপন, কাফে, রেস্তোরাঁ, রেনেশাঁস, বুর্জোয়া, আঁতাত, ম্যাটিনি, বিস্কুট, মেনু, ওমলেট ইত্যাদি।
সংখ্যালঘু ওলন্দাজ শব্দাবলি বাংলাভাষার ক্ষেত্রে একমাত্র তাসখেলার ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ হয়ে রয়েছে।
যেমন—হরতন, রুইতন, ইস্কাপন, তুরুপ। এগুলি ছাড়াও আরও কিছু বিদেশিভাষার শব্দ প্রধানত ইংরেজির মাধ্যমে বাংলা ভাষায় এসেছে। যেমন—
- রুশ ভাষা থেকে - সোভিয়েত, বলশেভিক, স্পুটনিক
- ইতালীয় ভাষা থেকে - কোম্পানি, গেজেট, ম্যাজেন্টা, ফ্যাসিস্ট।
- জার্মান ভাষা থেকে - নাৎসী
- স্পেনীয় ভাষা থেকে - কমরেড
- চীনা ভাষা থেকে - চা, চিনি
- জাপানি ভাষা থেকে - রিকসা, জুজুৎসু
- মালয়ী ভাষা থেকে - গুদাম
- বর্মী ভাষা থেকে - ঘুগনি, লুঙ্গি।
শব্দ সম্পদ হিসেবে বিদেশি এতগুলি ভাষার কাছে বাংলাভাষা ঋণী। কিন্তু শুধু এখানেই বিদেশি ভাষাগুলির ঋণদান থেমে থাকেনি। একটু লক্ষ্য করলেই বুঝতে পারবেন যে যুগোপযোগী এবং ভাবপ্রকাশের ক্ষেত্রে যুতসই নতুন শব্দ গড়ে নিতেও বাংলাভাষা কতবার কতরকমভাবে হাত বাড়িয়েছে বিদেশি ভাষার ভাণ্ডারে।
আসুন, আমরা এবার বিচিত্র পথে আসা বিদেশি শব্দের প্রভাবটিকে দেখি- বাংলা শব্দগঠনের ক্ষেত্রে।
(ক) লিঙ্গান্তর সাধনে-ফারসি ভাষার প্রভাবে পাওয়া মদ্দা কুকুর, মাদী কুকুর।
(খ) প্রত্যয় হিসাবে ফারসি 'আনা', 'গিরি', 'দার', 'বাজ', 'সই' প্রভৃতি যোগ করে তৈরি হয়েছে বিবিআনা, বাবুগিরি, কেরানিগিরি, বাজনদার, চালবাজ, খড়িবাজ, মাপসই, টেকসই ইত্যাদি শব্দাবলি।
(গ) উপসর্গ হিসাবে-ফরাসি থেকে আগত উপসর্গ 'ফি', 'বে', 'গর' ইত্যাদি যোগে ফিসন, ফিহপ্তা, বেমানান, বেহাত, গররাজি, গরহাজির—এই জাতীয় শব্দগুলির উৎপত্তি। আবার ইংরেজি কিছু শব্দও এইভাবে উপসর্গের ভূ মিকা পালন করে। যেমন- 'হাফ'-(হাফ-হাতা, হাফ-আখড়াই), 'ফুল' (ফুল-হাতা, ফুল-মোজা) বা 'হেড' (হেড পণ্ডিত, হেড মিস্ত্রী)।
(ঘ) সমাসবদ্ধ পদগঠনে ফারসি এবং ইংরেজি উভয় ভাষার কাছেই বাংলার ঋণ এ ব্যাপারে প্রায় সমান।
আমাদের কথা বাংলাভাষায় প্রতিনিয়ত কত যে এই গোত্রীয় শব্দ আমরা ব্যবহার করে চলেছি তা খুঁজে পেতে দেখলে চমকে যেতে হয়।
ফারসি প্রভাবজাত এরকম শব্দ রাজা-উজির, হাট-বাজার, শাকসব্জী, ধন-দৌলত, কাগজপত্র, আইন আদালত ইত্যাদি। ইংরেজি প্রভাবজাত এই পর্যায়ের শব্দ হিসাবে দেখতে পাবেন—মাস্টারমশাই, ডাক্তারবাবু, উকিল-ব্যারিস্টার, ডাক্তার-বদ্যি ইত্যাদি শব্দগুলিকে।
0 মন্তব্যসমূহ
Please do not enter any spam link in the comment box.