অর্থের চাহিদা কাকে বলে? অর্থের চাহিদা নির্ধারক কাকে বলে?

অর্থের চাহিদা কাকে বলে :-

দৈনন্দিন সকল কর্মকাণ্ডে অর্থের প্রয়োজন। ব্যাবসায়িক লেনদেন, পারিবারিক জীবন নির্বাহ, মূল্যের সংরক্ষক, সঞ্চয় সৃষ্টি প্রভৃতি সকল কাজে অর্থ একমাত্র হাতিয়ার, এজন্যই যেকোনো মানুষই কমবেশি অর্থের প্রয়োজন অনুভব করে। ফলে মানুষ বিভিন্ন প্রয়োজনে নগদ অর্থ হাতে ধরে রাখতে চায়। আবার সঞ্চয় আকারেও অর্থ জমা রাখতে পারে। নগদ অর্থ হাতে রাখার ইচ্ছাকে অর্থের চাহিদা বলে (Demand for Money)।

এ প্রসঙ্গে D G Pierce & D M Show বলেন, 'অর্থের চাহিদা বলতে আমরা দ্রব্য ও সেবা ক্রয়, আর্থিক সম্পদ ক্রয়, অন্যকে দান করা ইত্যাদি উদ্দেশ্যে এর ব্যবহার বুঝি না, বরং ধরে রাখাকে বুঝি।

সুতরাং কোনো নির্দিষ্ট সময়ে সমাজের জনগণ বিভিন্ন প্রয়োজনে যে পরিমাণ নগদ অর্থ হাতে ধরে রাখতে চায় তাকে অর্থের চাহিদা বলা হয়।

অর্থের নিজস্ব কোনো উপযোগ নেই। অর্থ দ্রব্যসামগ্রীর মতো সরাসরি ভোগও করা যায় না। কেবলমাত্র দ্রব্যসামগ্রী ক্রয় করার উদ্দেশ্যেই অর্থের চাহিদা হয়। অর্থ হলো বিনিময়ের মাধ্যম। একটি নির্দিষ্ট সময়ে যে পরিমাণ দ্রব্য অর্থের বিনিময়ে বেচাকেনা হয় তা-ই অর্থের চাহিদা সৃষ্টি করে।

সুতরাং অর্থের মোট চাহিদার পরিমাণ দেশে বিক্রয়যোগ্য দ্রব্যের মোট মূল্যের সমান। যদি সমাজে বিক্রয়যোগ্য দ্রব্যের পরিমাণ বেশি হয় তাহলে অর্থের চাহিদা বৃদ্ধি পায় এবং যদি বিক্রয়যোগ্য দ্রব্যের পরিমাণ কম হয় তাহলে অর্থের চাহিদা কম হবে।
 
আরও পড়ুনঃ একচেটিয়া প্রতিযোগিতামূলক বাজার কাকে বলে?

কিন্তু একটি নির্দিষ্ট সময়ে বিক্রয়যোগ্য দ্রব্যের পরিমাণ স্থির থাকে। তাই একটি নির্দিষ্ট সময়ে অর্থের চাহিদার কোনো পরিবর্তন হয় না।

অর্থের চাহিদার বিভিন্ন ধারণা :-

কোনো নির্দিষ্ট সময়ে সমাজের সকল জনগণ বিভিন্ন প্রয়োজনে যে পরিমাণ নগদ অর্থ হাতে ধরে রাখতে চায় তাকে অর্থের চাহিদা বলে। মানুষের প্রয়োজনের কথা চিন্তা করে অর্থের চাহিদাকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা হয়।

১. অর্থের লেনদেনজনিত চাহিদা (Transitory Demand for Money)
২. অর্থের সতর্কতামূলক চাহিদা (Precautionary Demand for money)
৩. অর্থের ফটকা চাহিদা (Speculative Demand for Money)

অর্থের লেনদেনজনিত চাহিদা :

দৈনন্দিন লেনদেন, দ্রব্য ও সেবার কেনাবেচা এবং যেকোনো প্রকার আদান-প্রদানে অর্থ ব্যবহৃত হয়। এসব প্রয়োজনে ব্যবহৃত অর্থের চাহিদাকে অর্থের লেনদেন চাহিদা বলে।

অর্থাৎ দৈনন্দিন লেনদেনের জন্য মানুষ যে পরিমাণ নগদ অর্থ হাতে ধরে রাখতে চায় তাকে অর্থের লেনদেন চাহিদা বলা হয়। অর্থের লেনদেন চাহিদা মূলত আয়ের ওপর নির্ভর করে। অন্যান্য অবস্থা অপরিবর্তিত থাকলে আয়ের সাথে অর্থের লেনদেন চাহিদার সম্পর্ক ধনাত্মক। অর্থাৎ আয় বাড়ালে অর্থের লেনদেন চাহিদা বাড়ে।

অর্থের সতর্কতামূলক চাহিদা :

ভবিষ্যতে কোনো অনিশ্চিত বা অপ্রত্যাশিত অবস্থার মোকাবিলা করার জন্য সতর্কতা হিসেবে বর্তমানে মানুষ কিছু নগদ হাতে ধরে রাখতে চায়। অর্থের এরূপ চাহিদাকে সতর্কতামূলক চাহিদা বলে।

যেমন- ভবিষ্যতে অসুস্থতা, ব্যবসায়ে ক্ষতি, চাকরিচ্যুতি কিংবা অনুরূপ কোনো অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হতে পারে। এ ধরনের আশংকায় সতর্কতামূলক অর্থের চাহিদা সৃষ্টি হয়। সতর্কতামূলক অর্থের চাহিদা আয়ের ওপর নির্ভর করে। আয়ের সাথে সতর্কতামূলক চাহিদা সম্পর্ক ধনাত্মক। অর্থাৎ অন্যান্য অবস্থা অপরিবর্তিত থেকে আয় বাড়লে সতর্কতামূলক অর্থে চাহিদা বাড়ে।

অর্থের ফটকা চাহিদা :

দৈনন্দিন লেনদেন ও ভবিষ্যতের সংকট মোকাবিলা ছাড়াও মানুষ ফটকা ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে নগদ অর্থ হাতে ধরে রাখতে চায়। ফটকা উদ্দেশ্যে যে পরিমাণ নগত অর্থ মানুষ হাতে ধরে রাখতে চায় তাকে অর্থের ফটকা চাহিদা বলে।

যেমন- মানুষ ঋণপত্রে টাকা খাটিয়ে কিছু বাড়তি অর্থ উপার্জন করতে চায়। ঋণপত্রের দাম (সুদের হার) বেশি হলে মানুষ ঋণপত্র ক্রয় করে। সে ক্ষেত্রে নগদ অর্থের পরিবর্তে মানুষ ঋণপত্র হাতে রাখে, অর্থাৎ নগদ অর্থের চাহিদা কমে।

আবার বিপরীত অবস্থায় নগদ অর্থের চাহিদা বাড়ে। অর্থের এ ধরনের চাহিদাকে বলা হয় অর্থের ফটকা ব্যবসায় জনিত চাহিদা। অর্থের ফটকা চাহিদা নির্ভর করে সুদের হারের ওপর। অন্যান্য অবস্থা অপরিবর্তিত থাকলে সুদের হার বাড়লে অর্থের ফটকা চাহিদা কমে। আবার সুদের হার কমলে অর্থের ফটকা চাহিদা বাড়ে। অর্থাৎ সুদের হারের সাথে অর্থের ফটকা চাহিদার সম্পর্ক বিপরীত।

অর্থের চাহিদা নির্ধারক কাকে বলে :-

নগদ অর্থ হাতে ধরে রাখার ইচ্ছাকে অর্থের চাহিদা বলে। অর্থের চাহিদা যে সকল উপাদান দ্বারা প্রভাবিত হয় সেগুলোকে বলা হয় অর্থের চাহিদার নির্ধারক।

নিম্নে অর্থের চাহিদার নির্ধারকসমূহ ব্যাখ্যা করা হলো।

১. আয় :

আয়ের ওপর অর্থের চাহিদা বিশেষভাবে অর্থের লেনদেন ও সতর্কতামূলক চাহিদা নির্ভর করে। আয় বেশি হলে চাহিদা বেশি হয় এবং আয় কম হলে অর্থের চাহিদা কম হয়।

২. ভোগপ্রবণতা :

ভোগপ্রবণতা অর্থের লেনদেন চাহিদাকে অনেকাংশে প্রভাবিত করে। ভোগপ্রবণতা বেশি হলে নগদ অর্থের চাহিদা বেড়ে যায়। আবার ভোগপ্রবণতা কম হলে নগদ অর্থের চাহিদা কমে।

৩. আয়প্রাপ্তির ধরন :

আয় উপার্জন বা প্রাপ্তির মেয়াদের ওপর নগদ অর্থের চাহিদা নির্ভর করে। আয় প্রাপ্তির হলে নগদ অর্থ হাতে ধরে রাখার বেশি হয়। আবার আয়প্রাপ্তির মেয়াদ কম হলে অর্থের চাহিদা কম

৪. সঞ্চয়প্রবণতা :

মানুষের সঞ্চয়প্রবণতা নগদ অর্থের চাহিদাকে প্রভাবিত করে। সঞ্চয়প্রবণতা বেশি হলে অর্থের চাহিদা কম হয়। আবার সঞ্চয়প্রবণতা কম হলে অর্থের চাহিদা বেশি হয়।

আরও পড়ুনঃ ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা কাকে বলে?

৫. সুদের হার :

সুদের হারের ওপর অর্থের চাহিদা বিশেষ করে অর্থের ফটকা চাহিদা নির্ভর করে। সুদের হার কমলে অর্থের ফটকা চাহিদা বাড়ে। আবার সুদের হার বাড়লে অর্থের ফটকা চাহিদা কমে।

৬. মুদ্রা বাজার :

অর্থের চাহিদা মুদ্রা বাজারের ওপর নির্ভর করে। মুদ্রা বাজার উন্নত হলে নগদ অর্থ হাতে ধরে রাখার প্রবণতা মানুষের কমে যায় তথা অর্থের চাহিদা কমে যায়। আবার মুদ্রা বাজার অনুন্নত হলে অর্থের চাহিদা বৃদ্ধি পায়।

৭. দাম স্তর :

দাম স্তর নগদ অর্থের চাহিদা অনেকাংশে প্রভাবিত করে। দাম স্তর বাড়তে থাকলে তথা মুদ্রাস্ফীতির সময় অর্থের চাহিদা বাড়ে। আবার দাম স্তর কমতে থাকলে তথা মুদ্রা সংকোচনের সময় অর্থের চাহিদা হ্রাস পায়।

৮. প্রত্যাশা :

প্রত্যাশা অর্থের চাহিদাকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। দাম বৃদ্ধির প্রত্যাশা, আয় বৃদ্ধির প্রত্যাশা, ব্যবসায়ের লোকসানের প্রত্যাশা ইত্যাদি বিষয় নগদ অর্থের চাহিদাকে প্রভাবিত করে।

৯. ব্যাংক ব্যবস্থা :

উন্নত ব্যাংক ব্যবস্থা নগদ অর্থের চাহিদাকে বর্তমান কালে প্রবলভাবে প্রভাবিত করে। ক্রেডিট কার্ড, ভিসা কার্ড ইত্যাদি সুবিধা প্রদানের ফলে নগদ অর্থ হাতে রাখার প্রবণতা হ্রাস পায়। পক্ষান্তরে ব্যাংক ব্যবস্থা অনুন্নত ও ব্যাংকিং সুবিধা কম থাকলে মানুষ বাধ্য হয়ে নগদ অর্থ হাতে ধরে রাখে।

১০. সামাজিক নিরাপত্তা :

সামাজিক নিরাপত্তা অর্থের চাহিদাকে বিশেষ করে অর্থের সতর্কতামূলক চাহিদাকে প্রভাবিত করে। সামাজিক নিরাপত্তা থাকলে বর্তমানে লেনদেন চাহিদা বাড়ে, ভবিষ্যতের জন্য অর্থ জমা রাখার প্রবণতা কমে।

আবার সামাজিক নিরাপত্তার অভাব হলে বর্তমানে লেনদেন চাহিদা কমে ভবিষ্যতের জন্য অর্থ জমা রাখার প্রবণতা বাড়ে। উপরিউক্ত বিষয়গুলো দ্বারা একটি দেশের অর্থের চাহিদা প্রভাবিত হয়।

উক্ত বিষয়গুলো অনুকূল পরিবর্তন হলে অর্থের চাহিদা বাড়ে এবং প্রতিকূল পরির্তন হলে অর্থে চাহিদা কমে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ