যোগান কাকে বলে? যোগানের উপাদানসমূহ?

যোগান কাকে বলে :-

অনেকে যোগান ও মজুদ ধারণা দুটিকে একই অর্থে ব্যবহার করে থাকেন। কিন্তু যোগান ও মজুদ দুটি বিন্ন ধারণা। একটি নির্দিষ্ট সময়ে একজন বিক্রেতা কোনো পণ্যের যে পরিমাণ বিরাজমান বাজার দামে বিক্রয় করতে রাজি থাকে তাকে যোগান বলে।

সামগ্রিক অর্থে অর্থনীতিতে যোগান বলতে একটি নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট পণ্যে বিক্রেতাগণ কোনো দ্রব্যের যে পরিমাণ বাজারে বিক্রয় করতে রাজি থাকে তাকে যোগান বলে।

অন্যদিকে বিক্রয়যোগ্য দ্রব্যের পরিমাণ যা একজন বিক্রেতা বাজার দামে বিক্রয় করতে রাজি নয় তা হলো মজুদ।

বিষয়টি একটি উদাহরনের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যাক। ধরা যাক, একজন বিক্রেতার নিকট ১০০০ কেজি চাল রয়েছে যা সে ৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রয় করবে। কিন্তু চালের বাজার দাম কেজি প্রতি ৪০ টাকা। আর এই দামে বিক্রেতা কেবল ৪০০ কেজি চাল বিক্রয় করতে রাজি আছে। এই ৪০০ কেজি হলো যোগানের পরিমাণ। অবশিষ্ট ৬০০ কেজি চাল হলো মজুদ বা স্টক।

যোগান বিধি কাকে বলে :-

যোগান বিধির প্রবক্তা অধ্যাপক মার্শাল। অন্যন্য অবস্থা যেমন সম্পর্কযুক্ত দ্রব্যের দাম, আবহাওয়া, প্রযুক্তি ইত্যাদি অপরিবর্তিত থেকে দ্রব্যের দাম বাড়লে যোগান বাড়ে এবং দাম কমলে যোগান কমে। দাম ও যোগানের এই ক্রিয়াগত সরাসরি সম্পর্ককে অর্থনীতিতে যোগান বিধি বলা হয়।

অধ্যাপক মার্শালের মতে," অন্যান্য অবস্থা অপরিবর্তিত থেকে যদি কোনো দ্রব্যের দাম বাড়ে তবে তার যোগান বাড়বে এবং দাম কমলে তার যোগানও কমবে।" দাম ও যোগানের মধ্যে সরাসরি বা প্রত্যক্ষ সম্পর্ক বিরাজ করে। আর দ্রব্যের দাম ও যোগানের এই ক্রিয়াগত সম্পর্কই হলো যোগান বিধি।

আরও পড়ুনঃ সম্পদ কাকে বলে?

যোগান বিধির ব্যতিক্রম :-

যোগান বিধির কতগুলো ব্যতিক্রম রয়েছে। নিম্নে সেগুলো আলোচনা করা হলো:

১. সীমাবদ্ধ যোগানের পরিমাণ :

কিছু কিছু পণ্য রয়েছে যেগুলোর যোগান সীমাবদ্ধ। যেমন: দুর্লভ চিত্র, টিপু সুলতানের তলোয়ার ইত্যাদি। এসবের মূল্য বাড়লেও যোগান বাড়ানো সম্ভব নয়।

২. শ্রমের ক্ষেত্রে :

শ্রমের মূল্য বৃদ্ধি পেলেও অনেক সময় শ্রমের যোগান বৃদ্ধি পায় না। কারণ শ্রমিক মজুরির চেয়ে তার বিশ্রামকে বেছে নিতে পারে।

৩. প্রাকৃতিক অবস্থা :

আবহাওয়া তথা প্রাকৃতিক অবস্থা প্রতিকূল থাকলে কৃষি পণ্যের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে। এক্ষেত্রে দাম বৃদ্ধি পেলেও কৃষি পণ্যের যোগান বাড়ানো সম্ভব নয়।

৪. উৎপাদন ব্যয় :

উৎপাদন ব্যয় বেশি হলে দাম বৃদ্ধি পেলেও যোগান বৃদ্ধি পায় না। কারণ এক্ষেত্রে উৎপাদক তথা বিক্রেতার মুনাফা বেশি হয় না।

৫. পরিবহণ সমস্যা :

পণ্যের পরিবহন সমস্যা থাকলে তা যোগান দেয়া সমস্যা হয়। এক্ষেত্রে নাম বেশি হলেও পরিবহণ সমস্যা থাকায় নির্দিষ্ট সময়ে পণ্য যোগান দেয়া সম্ভব হয় না।

৬. মৌসুমি কারণ :

অনেক সময় কৃষি পণ্যের ক্ষেত্রে যেমন কৃষকদের ফসল উঠার সময় দাম কম থাকলেও কৃষি পণ্যের যোগান কমে না বরং বাড়ে। কারণ অর্থনৈতিক বিভিন্ন কারণে কৃষকরা তাদের পন্য বিক্রি করে দেয়।

এভাবে যোগান বিধির ব্যতিক্রমসমূহ আলোচনা করা যায়।

যোগানের উপাদানসমূহ :-

চাহিদার মত যোগানেরও কতগুলো নির্ধারক রয়েছে। এগুলোকে যোগানের উপাদান বলা হয়ে থাকে। নিম্নে যোগানের নির্ধারকসমূহ আলোচনা করা হলো -

১. দ্রব্যের দাম :

আমরা জানি, অন্যান্য অবস্থা অপরিবর্তিত থেকে দ্রব্যের দামের উপর যোগান নির্ভর করে। দ্রব্যের নিজস্ব দাম বাড়লে যোগান বাড়ে আর দাম কমলে যোগান কমে। দ্রব্যের দাম কোনো পন্যের যোগানের সবচেয়ে শক্তিশালী নির্ধারক।

২. উপকরনের দাম :

উৎপাদনের উপকরনের মূল্য যেমন মজুরি, সুদ ইত্যাদি বৃদ্ধি পেলে উৎপাদকের উৎপাদন করার সামর্থ্য কমে যায়। এক্ষেত্রে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পায়। ফলে পূর্বের বাজার দামে একই পরিমাণ সরবরাহ করা সম্ভব হয় না।

৩. আবহাওয়া :

আবহাওয়া যোগানের একটি অন্যতম নির্ধারক। বিশেষকরে কৃষিজাত দ্রব্যের যোগান আবহাওয়ার উপর ব্যপকভাবে নির্ভরশীল। আবহাওয়া অনুকুল থাকলে কৃষিজাত দ্রব্যের যোগান বাড়ে আর প্রতিকূল থাকলে দ্রব্যের যোগান কমে।

৪. সময় :

অনেক পণ্য রয়েছে যেগুলোর মূল্য বৃদ্ধি পেলেও স্বল্পকালে তাদের যোগান বৃদ্ধি করা সম্ভব হয় না। কিন্তু দীর্ঘকালে দামের সাথে সাথে যোগানের পরিমাণের সামঞ্জস্য রাখা যায়। আবার কিছু পণ্য আছে যেগুলোর চাহিদা সময় অনুযায়ী পরিবর্তন হয়। যেমন, গ্রীষ্মকালে গরম কাপড়ের চাহিদা হ্রাস পায় তাই গরম কাপরের মূল্য হ্রাস পায় সেহেতু গরম কাপড়ের যোগান হ্রাস পায় ।

৫. কর :

কোনো দ্রব্যের উপর কর আরোপ করা হলে সেই দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি পায়। এতে দ্রব্যের চাহিদা দ্রাস পায় এবং সাথে সাথে যোগান হ্রাস পায়। তাই কর যোগানের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক।

৬. ভর্তুকি :

ভর্তুকি যোগানের আরেকটি নির্ধারক। কোনো পণ্যের উপর ভর্তুকি প্রদান করলে সেই দ্রব্যের মূল্য হ্রাস পায়। ফলে সেই দ্রব্যের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। এতে সেই দ্রব্যের যোগান বৃদ্ধি পায়।

৭. বিকল্প দ্রব্যের দামের পরিবর্তন :

যখন একটি দ্রব্যের পরিবর্তে অন্য একটি দ্রব্য ব্যবহার করা যায় তখন তাকে বিকল্প দ্রব্য বলে। যেমন- চিনি, গুড়। এক্ষেত্রে চিনির দাম হ্রাস পেলে চিনির চাহিদা হ্রাস পাবে । এতে উৎপাদক চিনির যোগান না বাড়িয়ে গুড়ের উৎপাদন বৃদ্ধি করবে।

৮. উৎপাদকের সংখ্যা :

বাজারে কোনো দ্রব্যের যোগান অনেক সময় উৎপাদকের সংখ্যার উপর নির্ভর করে। উৎপাদকের সংখ্যা বেশি হলে উৎপাদন বেশি হয়। এতে যোগান বৃদ্ধি পায়।

৯. যুক্ত যোগান :

কিছু পণ্য আছে যেগুলোর একটির যোগান বাড়লে আরেকটির যোগানও বাড়ে। যেমন, গবাদি পশুর মাংশ ও চামড়া। গবাদি পশুর মাংশ যত বেশি যোগান দেয়া হবে সাথে সাথে চামড়ার যোগানও তেমনি বাড়বে।

১০. নতুন দ্রব্য উৎপাদন :

যদি নতুন দ্রব্য উৎপাদনের সুযোগ সৃষ্টি হয় তবে উৎপাদক পুরাতন দ্রব্যের উৎপাদন কমিয়ে দেয়। এক্ষত্রে পুরাতন দ্রব্যের দাম অপরিবর্তিত থাকা সত্ত্বেও যোগান হ্রাস পায়।

১১. প্রযুক্তি :

প্রযুক্তি যোগান বৃদ্ধির অন্যতম নির্ধারক। যে কোনো উন্নত প্রযুক্তি উৎপাদন বৃদ্ধির সহায়ক হয়। কাজেই উৎপাদন ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার উৎপাদন বৃদ্ধি তথা যোগান বৃদ্ধি করে।

১২. প্রত্যাশা :

কোনো পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির প্রত্যাশা থাকলে উৎপাদক সেই পণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি করে। এতে সেই পণ্যের যোগান বৃদ্ধি পায়।

যোগানের পরিবর্তনের কারণসমূহ :-

আমরা জানি, দামের পরিবর্তনে যোগান ধনাত্মকভাবে পরিবর্তিত হয়। তবে দামের পরিবর্তন ছাড়াও যোগানের পরিবর্তন হয়ে থাকে। নিম্নে যোগানের পরিবর্তনের কারণগুলো আলোচনা করা হলো:

১. উৎপাদকের নিজস্ব চাহিদার পরিবর্তন :

দ্রব্যের উৎপাদক যদি নিজেই তার দ্রব্য ভোগের চাহিদা বৃদ্ধি করে তবে ই দ্রব্যের যোগান কমে যায়। যেমন: একজন দুধ উৎপাদক যদি নিজে তার উৎপাদিত দুধের চাহিদা বৃদ্ধি করে তবে দুধের যোগানের উপর তার প্রভাব পড়বে। এক্ষেত্রে দুধের যোগান কমবে।

২. উৎপাদন ব্যয়ের পরিবর্তন :

উৎপাদন ব্যয় হ্রাস পেলে যোগান বৃদ্ধি পাবে। আবার উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পেলে যোগান হ্রাস পায়।

৩. আবহাওয়া :

আমরা জানি কৃষি পণ্যের যোগান আবহাওয়ার উপর নির্ভরশীল। তাই আবহাওয়ার তারতম্যেও কারণে কৃষি পণ্যের যোগান পরিবর্তিত হয়। অনুকূল আবহাওয়া থাকলে ফসল উৎপাদন বাড়ে এবং যোগান বাড়ে।

৪. কর ও ভর্তুকি :

দ্রব্যের উৎপাদনে ভর্তুকি প্রদান করা হলে সংশ্লিষ্ট দ্রব্যের যোগান বৃদ্ধি পায়। আর কর আরোপ করা হলে বিক্রেতার উৎপাদন সামর্থ্য কমে যায় তাই যোগান কমে।

৫. উৎপাদন কৌশলের পরিবর্তন :

দ্রব্য উৎপাদনে উন্নত কলা কৌশল ব্যবহার করলে উৎপাদন বৃদ্ধি পায় এবং সাথে সাথে যোগান বৃদ্ধি পায়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ