উদ্ভিদ টিস্যুর প্রকারভেদ?

টিস্যু কাকে বলে :-

প্রতিটি জীবদেহ বিভিন্ন আকৃতির অসংখ্য কোষ দ্বারা গঠিত। এসব কোষের কাজও বিভিন্ন রকমের। কাজের বিভিন্নতার জন্যই কোষগুলো পরিবর্তিত হয়ে বিভিন্ন আকৃতি ধারণ করে। তবে একই আকার ও আকৃতির কিছু সংখ্যক কোষ গুচ্ছবদ্ধ হলে একই ধরনের কাজ করতে দেখা যায়। এদের উৎসও এক। এ গুচ্ছবদ্ধ কোষগুলোকে টিস্যু বলা হয়।

অর্থাৎ অবিচ্ছিন্ন ও সুসংগঠিত একগুচ্ছ কোষ যাদের উৎপত্তি এবং প্রধান প্রধান কাজ একই প্রকার সে কোষগুচ্ছকে টিস্যু বলা হয়।

কাজেই টিস্যু বলতে আমরা এমন একগুচ্ছ কোষকে বুঝি যে কোষগুলো একই স্থান থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে এবং সংঘবদ্ধভাবে অবস্থান করে একই কাজ সম্পন্ন করে।

উদ্ভিদ টিস্যুর প্রকারভেদ :-

উদ্ভিদ টিস্যু প্রধানত দু'প্রকার। যথা-

(ক) ভাজক টিস্যু এবং
(খ) স্থায়ী টিস্যু।

আরও পড়ুন :- সালোকসংশ্লেষণ কাকে বলে?

(ক) ভাজক টিস্যু-

বিভাজনে সক্ষম কোষ দ্বারা গঠিত টিস্যুকেই ভাজক টিস্যু বলা হয়।

ভাজক টিস্যুর কোষগুলোকে ভাজক কোষ বলা হয়। ভাজক কোষের বিভাজনের মাধ্যমেই উদ্ভিদের দৈহিক বৃদ্ধি ঘটে এবং ভাজক টিস্যু থেকেই অন্যান্য স্থায়ী টিস্যুর উৎপত্তি হয়।

ভাজক কোষগুলো ডিম্বাকার বা আয়তাকার, বড় নিউক্লিয়াস এবং ঘন সাইটোপ্লাজমবিশিষ্ট হয়। এদের কোষ প্রাচীর সেলুলোজ নির্মিত এবং পাতলা। এতে সাধারণত কোষ গহ্বর থাকে না। এদের কোষগুলোর মাঝে সাধারণত কোন আন্তঃকোষীয় ফাঁক থাকে না।

উদ্ভিদের মূলের অগ্রভাগে এবং কান্ড শীর্ষে সাধারণত ভাজক টিস্যু থাকে। অবস্থান অনুযায়ী এরা শীর্ষস্থ ভাজক টিস্যু। আবার উৎপত্তি অনুসারে এরা প্রাথমিক ভাজক টিস্যু নামে পরিচিত। কারণ ভ্রূণ থাকাকালীন এদের উৎপত্তি হয়।

ভাজক টিস্যুর কোষগুলোর বিভাজনের ফলে উদ্ভিদের মূল এবং কান্ডের দৈর্ঘ্যে বাড়ে। নগ্নবীজী এবং দ্বিবীজপত্রী উদ্ভিদের পরিণত মূল ও কান্ডের অভ্যন্তরে নতুন করে টিস্যুর সৃষ্টি হয়। স্থায়ী টিস্যু হতে এদের উৎপত্তি হয় বলে এদেরকে সেকেন্ডারি ভাজক টিস্যু বলা হয়। অবস্থান অনুযায়ী এরা পার্শ্বীয় ভাজক টিস্যু। এ টিস্যুর কোষগুলো বিভাজনের ফলে মূল ও কান্ডের বেড় বাড়তে থাকে অর্থাৎ মূল ও কান্ড ক্রমান্বয়ে মোটা হয়।

(খ) স্থায়ী টিস্যু -

ভাজক টিস্যু থেকে উৎপন্ন যে টিস্যুগুলো বিভাজনে অক্ষম তাদেরকে বলা হয় স্থায়ী টিস্যু।

ভাজক টিস্যুগুলো বিভাজন ক্ষমতা লোপ পাওয়ার পর তা বৃদ্ধি পেয়ে একটি নির্দিষ্ট আকার ধারণ করে এবং স্থায়ী টিস্যুতে পরিণত হয়। স্থায়ী টিস্যুর কোষগুলো বিভাজন ক্ষমতাহীন, পূর্ণভাবে বিকশিত এবং সঠিক আকৃতিপ্রাপ্ত।

এদের কোষ প্রাচীর অপেক্ষাকৃত পুরু, নিউক্লিয়াস আকারে ছোট এবং সাইটোপ্লাজম কম। এদের কোষ গহবর থাকে এবং পাশাপাশি কোষের মাঝে আন্তঃকোষীয় ফাঁকা স্থান থাকতে পারে।

গঠন এবং কাজের উপর নির্ভর করে স্থায়ী টিস্যুকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা-

আরও পড়ুন :- সম্পূর্ণ ও অসম্পূর্ণ ফুল কি?

১। সরল টিস্যু,
২। জটিল টিস্যু এবং
৩। ক্ষরণকারী টিস্যু।

১। সরল টিস্যু :-

যে স্থায়ী টিস্যু একই প্রকার কোষ দ্বারা গঠিত, একই উৎসস্থল থেকে উৎপন্ন হয় এবং একই ধরনের কাজ সম্পন্ন করে তাকে সরল টিস্যু বলা হয়।

আকৃতি ও প্রকৃতির উপর ভিত্তি করে সরল টিস্যুকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। যথা-

i. প্যারেনকাইমা,

ii. কোলেনকাইমা এবং

iii. স্ক্লেরেনকাইমা।

i. প্যারেনকাইমা :

প্রায় সমান ব্যাসবিশিষ্ট, সাধারণত পাতলা বা পুরু প্রাচীর যুক্ত কোষ দ্বারা এ টিস্যু গঠিত। এ প্রকার টিস্যুর কোষের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও গভীরতা প্রায় একই রকম হয়। আকৃতিতে এরা গোলাকার, ডিম্বাকার, লম্বাটে বা বহুভূজাকৃতির হয়।

এ টিস্যুর কোষসমূহের মধ্যে আন্তঃকোষীয় ফাঁকা স্থান থাকতে পারে কিংবা নাও থাকতে পারে। এ জাতীয় কোষে ঘন প্রোটোপ্লাজম থাকে এবং এরা জীবিত টিস্যু। উদ্ভিদের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের অধিকাংশ অংশ বিশেষ করে কোমল অংশ এ টিস্যু দ্বারা গঠিত।

উদ্ভিদের মূল, কান্ডের ত্বক, কর্টেক্স, মজ্জা, মজ্জারশ্মি, পাতার মেসোফিল টিস্যু, বীজের ভ্রূণ ও এন্ডোস্পার্ম, ফল ও ফুলের নরম ও মাংসল অংশ ইত্যাদি প্যারেনকাইমা কোষ দ্বারা গঠিত।

কোন কোন প্যারেনকাইমা কোষে ক্লোরোপ্লাস্ট থাকে তাদেরকে ক্লোরেনকাইমা বলা হয়। পাতার ক্লোরেনকাইমাকে মেসোফিল বলে।

জলজ উদ্ভিদের প্যারেনকাইমা টিস্যুতে বড় বড় বায়ুকুঠুরী থাকে যাকে অ্যারেনকাইমা বলা হয়। কোন কোন প্যারেনকাইমা কোষে তেল, ট্যানিন এবং নানা ধরনের খনিজ পদার্থ জমা থাকে।

আরও পড়ুন :- পাতা কি?

কাজ-

প্যারেনকাইমা টিস্যুর প্রধান কাজ খাদ্য সঞ্চয় করা, ক্লোরেনকাইমা ও মেসোফিল টিস্যুর কাজ খাদ্য প্রস্তুত করা। জলজ উদ্ভিদের অ্যারেনকাইমা উদ্ভিদকে বা তার অংশবিশেষকে পানিতে ভেসে থাকতে সাহায্য করে, ত্বকে অবস্থিত প্যারেনকাইমা প্রতিরক্ষা ও দৃঢ়তা প্রদান করে, জাইলেম ও ফ্লোয়েম টিস্যুতে অবস্থিত প্যারেনকাইমা খাদ্যের কাঁচামাল ও তৈরি খাদ্য পরিবহনে সাহায্য করে, অন্যান্য টিস্যুর সাথে মিলে দৃঢ়তা প্রদান করে, মুকুল উৎপাদনের মাধ্যমে বংশ বিস্তারে সাহায্য করে এবং স্ফীত ও রসালো উদ্ভিদে পানি সঞ্চয় করে।

ii. কোলেনকাইমা-

এ টিস্যুর কোষগুলো প্যারেনকাইমা জাতীয়, তবে কিছুটা লম্বাকৃতির। কোষের মাথা গোলাকার, চারকোণাবিশিষ্ট তির্যক বা ক্রমান্বয়ে সরু হতে পারে। প্রস্থচ্ছেদে এদের বহুভূজাকৃতির কোষ প্রাচীর অসমভাবে পুরু।

কোলেনকাইমা কোষগুলো সজীব। এদের মধ্যে প্রোটোপ্লাজম ও কোষ গহ্বর রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে কোলেনকাইমা কোষে ক্লোরোপ্লাস্ট থাকে। এ কোষগুলোর মাঝে আন্তঃকোষীয় ফাঁকা স্থান থাকতে পারে।

কোলেনকাইমা কোষের প্রাচীর সব সময় সর্বত্র সমানভাবে পুরু নয়। কোষ প্রাচীরের কোণায় কোণায় পেকটিন ও হেমিসেলুলোজ জমা হওয়ায় সে সকল স্থান অধিক স্থুল। কোষ প্রাচীরের অসম স্থলীকরণের কারণে কোলেনকাইমা তিন ধরনের হয়। যথা- কৌণিক, স্তরীভূত এবং কৃপযুক্ত কোলেনকাইমা।

কোলেনকাইমা টিস্যু সাধারণত কান্ড ও পাতার বহিঃত্বকের নিচে থাকে। পাতার বৃত্ত, শিরা, ফুলের বোঁটা ইত্যাদি জায়গায় কোলেনকাইমা থাকে। মূলে কোলেনকাইমা টিস্যু থাকে না।

কাজ-

উদ্ভিদদেহে দৃঢ়তা প্রদান করে, ক্লোরোফিল থাকলে খাদ্য প্রস্তুত করে, উদ্ভিদের অঙ্গ বাঁকাতে সাহায্য করে এবং বর্ধিষ্ণু অঙ্গে দৃঢ়তা প্রদান করে।

iii. স্ক্লেরেনকাইমা-

এ টিস্যুর কোষগুলো লম্বা, সরু ও সূঁচালো প্রাপ্তবিশিষ্ট এবং সমানভাবে পুরু। প্রাচীরের গায়ে লিগনিন জমা হয় এবং প্রাচীর অত্যন্ত পুরু ও শক্ত। কোন কোন সময় প্রাচীর এত পুরু হয় যে ভেতরের লুমেন খুব ছোট হয়ে কখনও কখনও প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। কোষ প্রাচীর সপাড় কৃপযুক্ত। পরিণত কোষগুলোতে প্রোটোপ্লাজম থাকে না বলে এরা মৃত। এ কোষগুলো আকার ও আকৃতিতে বিভিন্ন রকম হতে পারে। সাধারণত এরা দু'রকম হয়। যথা- (A) স্ক্লেরেনকাইমা তন্তু ও (B) ফ্লেরিড কোষ।

(A) স্ক্লেরেনকাইমা তন্তু-

এ কোষগুলো দেখতে তন্ত্রর ন্যায় সরু, লম্বা, দু'প্রান্ত সূঁচালো, কোষ প্রাচীর অত্যন্ত পুরু, শক্ত ও দৃঢ়। এদের প্রাচীরে কৃপ থাকে, স্ক্লেরেনকাইমা তন্ত্র দু'রকম। যথা- কাষ্ঠল তন্ত্র ও বাস্ট তন্তু। কাষ্ঠল তন্ত্র জাইলেমে থাকে এবং এদের কোষ প্রাচীরে সপাড় কৃপ থাকে। বাস্ট তন্তু ফ্লোয়েম টিস্যুতে অবস্থান করে এবং এদের কোষ প্রাচীরে সরল কৃপ উপস্থিত। পাটের আঁশ বাস্ট তন্ত্রর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

(B) ফ্লেরিড কোষ-

এ কোষগুলো সাধারণত গোলাকার। কোন কোন সময় লম্বাটে দন্ডাকার অথবা অসম আকৃতির হতে পারে। কোষ প্রাচীর লিগনিনযুক্ত এবং অত্যন্ত স্থূল হওয়ায় লুমেন খুব সরু আকার ধারণ করে।

ফ্লেরিড কোষ কোন কোন ক্ষেত্রে শাখান্বিত। নরম টিস্যুতে ফ্লেরিড থাকলে তাকে ফ্লেরিড কোষ বলা হয়। একে স্টোন কোষও বলা হয়ে থাকে।

নাসপাতি, আপেল, পেয়ারা, সফেদা ইত্যাদির বীজত্বকে ও সুপারীতে ফ্লেরিড থাকে এ কারণে খাওয়ার সময় খসখসে লাগে।

স্ক্লেরেনকাইমার কাজ-

উদ্ভিদের বিভিন্ন অঙ্গকে দৃঢ়তা প্রদান করা এ টিস্যুর প্রধান কাজ, মৃত কোষ অনেক সময় গাছের বর্জ্য ধারণ করে এবং কখনও কখনও বাইরে শক্ত আবরণ সৃষ্টি করে ভেতরের নরম অংশকে রক্ষা করে (যেমন- নারিকেল এবং তালের বীজের আবরণ)।

২। জটিল টিস্যু-

এ টিস্যুর আসল কাজ মাটি থেকে পানি ও অজৈব লবণ পরিবহন করে পাতায় পৌঁছানো এবং পাতায় যে খাদ্য প্রস্তুত হয় তা পরিবহন করে উদ্ভিদ দেহের বিভিন্ন অংশে পৌঁছানো। এদের কাজ পরিবহন বলে এ টিস্যুকে পরিবহন টিস্যুও বলা হয়। জটিল টিস্যু দু'প্রকার। যথা-

(i) জাইলেম টিস্যু ও

(ii) ফ্লোয়েম টিস্যু।

জাইলেম টিস্যু :-

এ টিস্যু পরিবহন টিস্যুগুচ্ছের অন্যতম অংশ। ভাস্কুলার উদ্ভিদে জাইলেমের সাহায্যেই খাদ্য দ্রব্যের উপাদানগুলো মাটি থেকে মূলের মাধ্যমে পাতায় পরিবাহিত হয়। উৎপত্তি ও বিকাশের ভিত্তিতে জাইলেম দু'রকম। যথা- a) প্রাথমিক জাইলেম ও b) সেকেন্ডারি জাইলেম।

ভ্রূণ থেকে উদ্ভিদ বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে প্রোক্যাম্বিয়াম থেকে যে জাইলেমের সৃষ্টি হয় তাকে প্রাথমিক জাইলেম বলা হয়। উদ্ভিদের সেকেন্ডারি বৃদ্ধির সময় ক্যাম্বিয়াম থেকে যে জাইলেমের সৃষ্টি হয় তাকে সেকেন্ডারি জাইলেম বলা হয়। পরিণত অবস্থায় আবৃতবীজী উদ্ভিদে জাইলেম চার রকম কোষ দ্বারা গঠিত। যথা- (A) ট্রাকিড, (B) ট্রাকিয়া বা ভেসেল, (C) জাইলেম প্যারেনকাইমা ও (D) জাইলেম তন্ত্র।

৩। ক্ষরণকারী টিস্যু-

উদ্ভিদদেহে সরল ও জটিল টিস্যু ছাড়াও বিশেষ ধরনের কাজ করার জন্য বিশেষ কিছু টিস্যু আছে।

যে সব টিস্যু থেকে নানা রকম উৎসেচক, বর্জ্য পদার্থ ইত্যাদি নিঃসৃত হয় তাদেরকে ক্ষরণকারী টিস্যু বলা হয়।

ক্ষরণকারী টিস্যু দু'প্রকার। যথা-

i) তরুক্ষীর টিস্যু ও

ii) গ্রন্থি টিস্যু।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ