সালোকসংশ্লেষণ কাকে বলে? সালোকসংশ্লেষণের পর্যায় ও গুরুত্ব?

সালোকসংশ্লেষণ কাকে বলে :-

যে জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় সবুজ উদ্ভিদ শর্করা জাতীয় খাদ্য তৈরি করে তাকে সালোকসংশ্লেষণ বলা হয়।

এটি একটি শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়াটি সজীব উদ্ভিদ কোষস্থ ক্লোরোফিল সূর্যের আলোকশক্তিকে ATP এবং NADPH+H+ নামক রাসায়নিক শক্তিতে রূপান্তরিত করে এবং ঐ রাসায়নিক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে CO2 বিজারণের মাধ্যমে শর্করা জাতীয় খাদ্য প্রস্তুত করে ও উপজাত হিসেবে O2 নির্গত করে।

উচ্চতর উদ্ভিদে সংঘটিত সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়াটি রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে দেখানো হলো-

এ প্রক্রিয়ায় দরকার হয় কার্বন ডাইঅক্সাইড, পানি, সূর্যালোক এবং ক্লোরোফিল। উৎপন্ন হয় শর্করা (গ্লুকোজ) এবং অক্সিজেন।

কার্বন ডাইঅক্সাইড ব্যবহৃত হয় শর্করা তৈরির জন্য, পানি ব্যবহৃত হয় রাসায়নিক শক্তি হিসেবে NADPH+H° তৈরির জন্য।

সূর্যালোকের দরকার হয় মূল শক্তির জন্য এবং ক্লোরোফিল দরকার হয় সূর্য শক্তিকে শোষণ করে রাসায়নিক শক্তিতে রূপান্তরের জন্য।

আরও পড়ুন:- সম্পূর্ণ ও অসম্পূর্ণ ফুল কি?

সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় সবুজ উদ্ভিদে তৈরিকৃত খাদ্য উদ্ভিদ নিজে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় বিপাকীয় প্রক্রিয়া সম্পাদন করতে ব্যবহার করে এবং অবশিষ্ট খাদ্য ফল, মূল, কান্ড অথবা পাতায় সঞ্চিত হয়। পাতার মেসোফিল টিস্যু সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার প্রধান স্থান।

সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় পানি জারিত হয় এবং কার্বন ডাইঅক্সাইড বিজারিত হয়। তাই একে একটি জারণ বিজারণ প্রক্রিয়া বলা হয়। এ বিক্রিয়ায় উপজাত দ্রব্য হিসেবে অক্সিজেন ও পানি উৎপন্ন হয়।

সালোকসংশ্লেষণের পর্যায় :-

এটি একটি দীর্ঘ ও জটিল প্রক্রিয়া। ইংরেজ শারীরতত্ত্ববিদ ব্ল্যাকম্যান (১৯০৫) একে দুটি পর্যায়ে ভাগ করেন। যথা-

(ক) আলোক নির্ভর পর্যায় এবং

(খ) আলোক নিরপেক্ষ পর্যায়।

আলোক নির্ভর পর্যায়-

এ পর্যায়ের জন্য আলো অপরিহার্য। এ পর্যায়ে সূর্য শক্তির সাহায্য নিয়ে পানি ভেঙ্গে অক্সিজেন, ইলেকট্রন এবং হাইড্রোজেন এ পরিণত হয়। পানির এরূপ ভাঙ্গনকে বলা হয় পানির সালোকবিভাজন ( Photolysis ) ।

আলোক নির্ভর পর্যায়ে সৌর শক্তি রাসায়নিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। এ রূপান্তরিত শক্তি ATP এবং NADPH+HT এর মধ্যে সঞ্চিত হয়। ATP এবং NADPH-H' তৈরিতে ক্লোরোফিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

ক্লোরোফিল অণু আলোক রশ্মির ফোটন শোষণ করে এবং তা থেকে শক্তি সঞ্চয় করে ADP এর সাথে অজৈব ফসফেট (Pi) মিলিত হয়ে ATP তৈরি করে। ATP তৈরির এ প্রক্রিয়াকে বলা হয় ফটোফসফোরাইলেশন।

আরও পড়ুন:- সহজাত আচরণ কি?

ফটোফসফোরাইলেশন দু'ভাবে সম্পন্ন হয়। যথা- চক্রীয় এবং অচক্রীয়। ক্লোরোপ্লাস্টে দু'রকম পিগমেন্ট সিস্টেম (যেমন- পিগমেন্ট সিস্টেম-১ এবং পিগমেন্ট সিস্টেম-২) থাকে। এরা সালোকসংশ্লেষণ-এর আলোক পর্যায় নিয়ন্ত্রণ করে। আলোক নির্ভর পর্যায়ের বিক্রিয়াসমূহ থাইলাকয়েড মেমব্রেন এ সংঘটিত হয়।

কার্বন ডাইঅক্সাইড আত্তীকরণের মাধ্যমে শর্করা তৈরি করতে ATP এবং NADPH+H এর শক্তি ব্যবহৃত হয় বিধায় ATP এবং NADPH+H' কে বলা হয় আত্তীকরণ শক্তি।

আলোক নিরপেক্ষ পর্যায়-

এ পর্যায়ে আলোর প্রয়োজন হয় না। আলোক নির্ভর পর্যায়ে সৃষ্ট ATP এবং NADPH+H বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কার্বন ডাইঅক্সাইড থেকে শর্করা উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়।

এ পর্যায়ে কার্বন ডাইঅক্সাইড বিজারিত হয় বিধায় একে কার্বন বিজারণ পর্যায় বলা হয়।

আবার কার্বন বিজারণ প্রক্রিয়ায় আলোর প্রত্যক্ষ দরকার হয় না। তাই একে আলোক নিরপেক্ষ বা অন্ধকার পর্যায় বলা হয়।

কিন্তু আলোর উপস্থিতিতে ATP এর সরবরাহ নিশ্চিত হয় এবং স্টোমাটা খোলা থাকায় CO2 ও O2 বিনিময় সহজ হয়। আলোক নিরপেক্ষ পর্যায়ের বিক্রিয়াসমূহ ক্লোরোপ্লাস্টের স্ট্রোমাতে সংঘটিত হয়। আবহমণ্ডলের CO2 হতে বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে শর্করা সৃষ্টির তিনটি পথ রয়েছে। যথা- ক্যালভিন চক্র, হ্যাচ এন্ড ব্ল্যাক চক্র ও ক্রেসলেসিয়ান অ্যাসিড বিপাক প্রক্রিয়া।

সালোকসংশ্লেষণের প্রভাবকসমূহ :-

সালোকসংশ্লেষণ কতগুলো প্রভাবক দ্বারা প্রভাবিত হয়। এগুলো বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ এ দু'ধরনের হয়।

বাহ্যিক প্রভাবকগুলোর মধ্যে রয়েছে- আলো, কার্বন ডাইঅক্সাইড, পানি, তাপমাত্রা, অক্সিজেন, খনিজ পদার্থ ইত্যাদি।

অভ্যন্তরীণ প্রভাবকের মধ্যে রয়েছে- পাতার বয়স, পাতার অন্তর্গঠন, ক্লোরোফিল, শর্করার পরিমাণ, প্রোটোপ্লাজম, পটাসিয়াম, এনজাইম ইত্যাদি ।

সালোকসংশ্লেষণের গুরুত্ব :-

জীবজগতে সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার গুরুত্ব অপরিসীম। একে একটি প্রাকৃতিক জৈব রাসায়নিক শিল্পও বলা যেতে পারে। নিচে সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার গুরুত্ব আলোচনা করা হলো-

আরও পড়ুন:- প্রজাতি কাকে বলে?

উদ্ভিদের খাদ্য প্রস্তুত: এ প্রক্রিয়ায় সবুজ উদ্ভিদ তাদের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য তৈরি করে। কাজেই সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে সবুজ উদ্ভিদ তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করে।

প্রাণীকূলের খাদ্য যোগান : প্রাণীকূল তাদের খাদ্যের জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সবুজ উদ্ভিদের উপর নির্ভরশীল।

শক্তির উৎস : জীবজগতের শক্তির একমাত্র উৎস হলো সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া। আমরা কাজকর্ম, চলাফেরা ইত্যাদিতে যে শক্তি প্রদর্শন করি তা আসে খাদ্য থেকে, আর আমরা এ খাদ্য গ্রহণ করি উদ্ভিদ থেকে, যা সবুজ উদ্ভিদ সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় তৈরি করে।

প্রকৃতপক্ষে এ শক্তির উৎস সূর্য। সবুজ উদ্ভিদ সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় সূর্যের আলোক শক্তিকে খাদ্যের মধ্যে রাসায়নিক শক্তিরূপে পরিবর্তিত করে।

জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়া: পরিচালন উদ্ভিদ ও প্রাণীর জীবন প্রক্রিয়ায় বহু বিপাকীয় বিক্রিয়া সংঘটিত হয়। এ সকল বিক্রিয়া না ঘটলে কোনও জীব টিকে থাকতে পারতো না। এ সমস্ত বিপাকীয় বিক্রিয়া পরিচালনার সকল শক্তি আসে সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট শর্করা থেকে।

পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা : উদ্ভিদকূল সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় বায়ুমন্ডল হতে কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষণ করে ও অক্সিজেন ত্যাগ করে। অন্যদিকে প্রাণীকূল তাদের জীবন ধারণের জন্য বায়ুমণ্ডল হতে অক্সিজেন গ্রহণ ও কার্বন ডাইঅক্সাইড ত্যাগ করে।

এমনিভাবে উদ্ভিদ ও প্রাণীর পারস্পরিক সহযোগিতায় পরিবেশের ভারসাম্য বজায় থাকে। মোট কথা হলো উদ্ভিদ ও প্রাণী তথা সমগ্র জীবভাগত তাদের খাদ্য, শক্তি ও জীবনসত্তার জন্য সম্পূর্ণভাবে সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার উপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ