মানুষের শ্বাসতন্ত্রের প্রধান অংশসমূহের নাম?

মানুষের শ্বাসতন্ত্রের প্রধান অংশসমূহের নাম :-

দেহের যে অঙ্গগুলো শ্বসন প্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে, সেগুলোকে একত্রে শ্বাসতন্ত্র বলে।

যে সকল অঙ্গগুলো নিয়ে মানব শ্বাসতন্ত্র গঠিত তা হলো- নাসারন্ধ্র ও নাসাপথ (Nasal cavity), গলবিল ও গলনালি (Pharynx), স্বরযন্ত্র (Larynx), শ্বাসনালি (Trachea), বায়ুনালি বা ব্ৰহ্মাস (Bronchus ), ফুসফুস (Lung) ও মধ্যচ্ছদা (Diaphragm)।

মানুষের শ্বাসতন্ত্রের প্রধান অংশসমূহের কাজ :-

মানুষের শ্বাসতন্ত্রের প্রধান অংশসমূহের কাজ সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলো-

নাসারন্ধ্র বা নাসাপথ মানব শ্বাসতন্ত্রের প্রথম অংশের নাম নাসিকা। এটা মুখ গহবরের উপরে অবস্থিত একটি ত্রিকোণাকার গহবর। এর সাহায্যে কোন বস্তুর সুগন্ধ বা দুর্গন্ধ বোঝা যায়। একটি বিশেষ ধরনের স্নায়ু এ অঙ্গকে উদ্দীপিত করে, ফলে আমরা গন্ধ পাই।

একটি পাতলা পর্দা দ্বারা এটি দু'ভাগে বিভক্ত। ইহার সম্মুখ ভাগ লোম দ্বারা আবৃত ও পেছনের দিকের অংশ শ্লেষ্মা প্রস্তুতকারী পর্দা দ্বারা আবৃত। আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় বায়ুতে বিদ্যমান ধূলিকণা, রোগ জীবাণু ও আবর্জনা থাকলে তা এ লোম ও পর্দাতে আটকে যায়। ফলে বায়ু ফুসফুসে প্রবেশের পূর্বে অনেকটা নির্মল হয়ে যায়। এছাড়া শ্বসনের জন্য গৃহীত বায়ু নাসাপথ দিয়ে যাওয়ার সময় কিছুটা শুষ্ক ও আর্দ্র হয়। এর ফলে হঠাৎ ঠান্ডা বায়ু ফুসফুসে প্রবেশ করে কোন প্রকার ক্ষতি করতে পারে না।

আরও পড়ুন:- শ্বাসনালি সংক্রান্ত রোগ সমূহ?

গলবিল :

মুখ গহবরের পশ্চাতে হাঁ করলে যে অংশটি দেখা যায়, সেটাই গলবিল।

নাসাপথের পশ্চাৎভাগ হতে স্বরযন্ত্রের উপরিভাগ পর্যন্তএটা বিস্তৃত। গলনালির উভয়পাশে দুটি গ্রন্থিপিন্ড আছে এদেরকে টনসিল বলে। এর উপরিভাগে ও তালুর পশ্চাৎভাগে ক্ষুদ্র জিহ্বার ন্যায় অংশ থাকে, একে আলজিহ্বা বলে। খাদ্য ও পানীয় গলাধঃকরণের সময় এটা নাসাপথের পশ্চাৎপথ বন্ধ করে দেয়।

স্বরযন্ত্র :

এটি শ্বাসনালির প্রথমাংশ এবং গলবিলের নিচে ও শ্বাসনালির উপরে অবস্থিত। স্বরযন্ত্রের দু'ধারে দুটি পেশি থাকে। এরা ভোকালকর্ড নামে পরিচিত। এদের কম্পনের ফলে স্বরের উৎপত্তি হয়। স্বরযন্ত্রের উপরে জিহ্বা আকৃতির একটি ঢাকনা রয়েছে। একে উপজিহ্বা বলে।

শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার সময় এটি খোলা থাকে এবং এ পথে বায়ু ফুসফুসে যাতায়াত করে। আহারের সময় ঐ ঢাকনাটা স্বরযন্ত্রের মুখ ঢেকে দেয়। ফলে আহার্য দ্রব্য সরাসরি খাদ্যনালিতে প্রবেশ করে। স্বরযন্ত্র একটি ছিদ্র দিয়ে মুখহ্বরে উন্মুক্ত। এ ছিদ্রটিকে শ্বাসছিদ্র বলে।

শ্বাসনালি :

এটি খাদ্যনালির সম্মুখে অবস্থিত একটি ফাঁপা নল। এ নালিটি স্বরযন্ত্রের নিম্নাংশ থেকে শুরু করে ফুসফুসের নিকটবর্তী হয়ে ডান ও বাম দিকে দুটি শাখায় বিভক্ত হয়ে একটি ডান ফুসফুসে ও অন্যটি বাম ফুসফুসে প্রবেশ করেছে। এগুলো শ্বাসনালি।

শ্বাসনালির অন্তর্গাত্র ঝিল্লী দ্বারা আবৃত। এ ঝিল্লীতে সূক্ষ্ম লোমযুক্ত কোষ থাকে। এর ভেতর দিয়ে বায়ু আসা যাওয়া করে। শ্বাসনালির ভেতর দিয়ে কোন অপ্রয়োজনীয় বস্ত্র প্রবেশ করলে সূক্ষ্ম লোমগুলো ধূলিকণাকে শ্লেষ্মার সাথে বাইরে বের করে দেয়।

আরও পড়ুন:- হৃদচক্র কাকে বলে?

ব্রঙ্কাস :

শ্বাসনালি স্বরযন্ত্রের নিম্নাংশ থেকে ফুসফুসের নিকটবর্তী হয়ে ডান ও বামদিকে দুটি শাখায় বিভক্ত হয়ে ডান ও বাম ফুসফুসে প্রবেশ করে। এগুলো ব্রঙ্কাই নামে পরিচিত।

ফুসফুসে প্রবেশ করার পর ব্রঙ্কাই দুটি অসংখ্য শাখা প্রশাখায় বিভক্ত হয়। এগুলোকে অণুক্লোম শাখা বা ব্রঙ্কিওল বলে।

ফুসফুস :

ফুসফুস শ্বাসতন্ত্রের প্রধান অঙ্গ। বক্ষগহবরের ভেতর হৃদপিণ্ডের দু'পাশে দুটি ফুসফুস অবস্থিত। এটি স্পঞ্জের ন্যায় নরম ও কোমল, হালকা লালচে রঙের। ডান ফুসফুস তিন খন্ডে ও বাম ফুসফুস দু'খণ্ডে বিভক্ত।

ফুসফুস দু'ভাঁজবিশিষ্ট পারা নামক পর্দা দ্বারা আবৃত। দুর্ভাঁজের মধ্যে এক প্রকার রস নির্গত হয়। ফলে শ্বাসক্রিয়া চলার সময় ফুসফুসের সাথে বক্ষগাত্রের কোন ঘর্ষণ লাগে না। ফুসফুসে অসংখ্য বায়ুথলি বা বায়ুকোষ, সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম শ্বাসনালি ও রক্তনালি থাকে। বায়ু থলিগুলোই হলো অ্যালভিওলাস (Alveolus )।

বায়ুথলি পাতলা আবরণী দ্বারা আবৃত হয়। প্রতিটি বায়ুথলি কৈশিক নালিকা দ্বারা পরিবেষ্টিত। এ বায়ুথলি ও কৈশিক নালিকাগুলোর ভেতর দিয়ে গ্যাসীয় আদান প্রদান ঘটে।

মধ্যচ্ছদা:

যে পেশিবহুল পর্দা বক্ষগহবর ও উদরগহ্বরকে আলাদা করে রাখে তাকে মধ্যচ্ছদা বলে। এটি দেখতে অনেকটা প্রসারিত ছাতার ন্যায়। মধ্যচ্ছদা সংকুচিত হলে নিচের দিকে নামে। তখন বুকের আয়তন বেড়ে যায়। আর মধ্যচ্ছদা প্রসারিত হলে উপরের দিকে উঠে যায় তখন বক্ষগহবর স্বাভাবিক অবস্থায় আসে। মধ্যচ্ছদা প্রশ্বাস গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

মানুষের শ্বাসক্রিয়া :-

শ্বাস-প্রশ্বাসের অঙ্গগুলো কেবলমাত্র গলবিলের দিকে খোলা থাকে, অন্য সবদিক বন্ধ থাকে। ফলে নাসাপথের ভেতর দিয়ে ফুসফুসের বায়ুগুলি পর্যন্ত বায়ু নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারে। এ সকল কার্য মূলত স্নায়ুবিক উত্তেজনা দ্বারা পরিচালিত হয়।

স্নায়ুবিক উত্তেজনার কারণে পিঞ্জরাস্থির মাংসপেশি ও মধ্যচ্ছদা সংকুচিত হয়। ফলে মধ্যচ্ছদা নিচের দিকে নেমে যায় ও বক্ষগহবর প্রসারিত হয়। বক্ষ গহবরের আয়তন বেড়ে গেলে বায়ুর চাপ কমে। যার ফলে ফুসফুসের ভেতরের বায়ুর চাপ বাইরের বায়ুর চাপের চেয়ে কমে যায়।

আরও পড়ুন:- স্নায়ুতন্র কি?

রক্ষাহেবরের ভেতর ও বাইরের চাপের সমতা রক্ষার জন্য প্রশ্বাস বায়ু ফুসফুসের ভেতর সহজে প্রবেশ করতে পারে। এ পেশি সংকোচনের পরপরই পুনরায় প্রসারিত হয়। তাই মধ্যচ্ছদা পুনরায় প্রসারিত হয়ে উপরের দিকে উঠে যায় এবং বক্ষগহবরের আয়তন স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে।

এতে ফুসফুসের ভেতরের বায়ু চাপ বেড় যায়, ফলে কার্বন ডাইঅক্সাইড ও জলীয় বাষ্পসমৃদ্ধ বাতাস নিঃশ্বাসরূপে বাইরে নির্গত হয়। এভাবে মানবদেহে প্রতিনিয়ত শ্বাসকার্য চলতে থাকে। মূলত এটা বহিঃশ্বসন।

মানবদেহের গ্যাসীয় বিনিময় প্রক্রিয়া :-

গ্যাসীয় বিনিময় বলতে অক্সিজেন ও কার্বন ডাইঅক্সাইড এর বিনিময়কে বোঝায়।

এটি মূলত বায়ু ও ফুসফুসের রক্তনালির ভেতরে ঘটে। গ্যাসীয় বিনিময়কে দুটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়। যথা-

(ক) অক্সিজেন শোষণ এবং

(খ) কার্বন ডাইঅক্সাইড পরিবহন।

(ক) অক্সিজেন শোষণ :

শ্বসনের সময় অক্সিজেন ব্যাপন প্রক্রিয়ায় ফুসফুস থেকে রক্তে প্রবেশ করে। রক্তে প্রবেশ করার পর অক্সিজেন মুক্ত অবস্থায় থাকে না। এর একটি বড় অংশ লোহিত রক্ত কণিকার হিমোগ্লোবিনের সাথে যুক্ত হয়ে অক্সিহিমোগ্লোবিন নামক একটি অস্থায়ী যৌগ গঠন করে। এ যৌগ গঠন রক্তরসে অক্সিজেনের পরিমাণের উপর নির্ভর করে।

দেহে রক্ত পরিবহনের সময় বেশ কিছু অক্সিজেন রক্তরস থেকে লসিকায় প্রবেশ করে। লসিকায় তখন অক্সিজেনের পরিমাণ কম থাকায় এ ক্রিয়াটি ঘটে। ফলে রক্তরসে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায়। হিমোগ্লোবিন তখন তার সাথে যুক্ত অক্সিজেন ছাড়তে থাকে। এভাবে প্রথমে অক্সিজেন রক্তরস ও পরে লসিকা বা কোষ রসে প্রবেশ করে। এ সময় ফুসফুসের বায়ুথলি ও রক্তের চাপের পার্থক্যের জন্য অক্সিজেন ব্যাপন প্রক্রিয়ায় রক্তে প্রবেশ করে।

ফুসফুস থেকে ধ্বমনির রক্তে অক্সিজেন প্রবেশ করার পর রক্তে অক্সিজেন দু'ভাবে পরিবাহিত হয়। সামান্য পরিমাণ অক্সিজেন রক্তরসে প্রবীভূত অবস্থায় পরিবাহিত হয়। বেশির ভাগ অক্সিজেনই হিমোগ্লোবিনের লৌহ অংশের সাথে হালকা বন্ধনের মাধ্যমে অস্থায়ী যৌগ গঠন করে। যা অক্সিহিমোগ্লোবিন নামে পরিচিত। অক্সিহিমোগ্লোবিন থেকে অক্সিজেন সহজে বিছিন্ন হতে পারে।

হিমোগ্লোবিন + অক্সিজেন - অক্সিহিমোগ্লোবিন (অস্থায়ী যৌগ)

আক্সহিমোগ্লোবিন (অস্থায়ী যৌগ) - মুক্ত অক্সিজেন হিমোগ্লোবিন।

রক্ত কৈশিকনালিতে পৌঁছার পর অক্সিজেন প্রথমে পৃথক হয়ে লোহিত রক্ত কণিকার আবরণ, কৈশিকনালির প্রাচীর ভেদ করে লসিকাতে প্রবেশ করে। অবশেষে লসিকা হতে কোষ আবরণ ভেদ করে কোষে পৌঁছায়।

(খ) কার্বন ডাইঅক্সাইড পরিবহন:

খাদ্য জারণ প্রক্রিয়ায় কোষে কার্বন ডাইঅক্সাইড তৈরি করে। এ কার্বন ডাইঅক্সাইড প্রথমে কোষ আবরণ ভেদ করে লসিকাতে প্রবেশ করে এবং লসিকা থেকে কৈশিক নালির প্রাচীর ভেদ করে রক্ত রসে প্রবেশ করে। কার্বন ডাইঅক্সাইড প্রধানত বাইকার্বনেটরূপে রক্ত সঞ্চালনের মাধ্যমে পরিবাহিত হয়ে ফুসফুসে আসে, সেখানে কৈশিক নালি ও বায়ুথলি ভেদ করে দেহের বাইরে নির্গত হয়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ