মানব দেহে রক্ত সঞ্চালন :
হৃদপিন্ড থেকে রক্ত ধমনি নালি দিয়ে শরীরের বিভিন্ন অংশে বাহিত হয় এবং দেহের বিভিন্ন অংশ থেকে শিরা নালি দিয়ে পুনরায় হৃদপিন্ডে ফিরে আসে।রক্ত সংবহন তন্ত্রের প্রধান অঙ্গ হৃদপিণ্ড। হৃদপিন্ড একটি পাম্পের ন্যায় কাজ করে। হৃদপিন্ডের সংকোচন ও প্রসারণ দ্বারা এ কাজ সম্পন্ন হয়। হৃদপিন্ডের অবিরাম সংকোচন ও প্রসারণের মাধ্যমে সারা দেহে রক্ত সংবহন পদ্ধতি অব্যাহত থাকে।
হৃদপিন্ডের সংকোচনকে বলা হয় সিস্টোল ও প্রসারণকে বলা হয় ডায়াস্টোল।
হৃদপিন্ডের এক বার সিস্টোল- ডায়াস্টোলকে একরের 'হৃদ স্পন্দন' (Heart Beat) বলা হয়।
হৃদপিন্ডের গঠন :-
হৃদপিন্ড বক্ষ গহ্বরের বাম দিকে দু'ফুসফুসের মাঝখানে অবস্থিত একটি ত্রিকোণাকার ফাঁপা অঙ্গ। এটি হৃদপেশি নামক এক বিশেষ ধরনের অনৈচ্ছিক পেশি দ্বারা গঠিত। এটি পেরিকার্ডিয়াম নামক পাতলা পর্দা দ্বারা আবৃত থাকে।হৃদপিন্ডের প্রাচীরে তিনটি স্তর থাকে। যথা-
(ক) বহিঃস্তর (Epicardium),
(খ) মধ্যস্তর (Myocardium) এবং
(গ) অন্তঃস্তর (Endocardium)।
আরও পড়ুন:- হৃদচক্র কাকে বলে?
(ক) বহিঃস্তর- বহিঃস্তর মূলত যোজক কলা দ্বারা গঠিত। এতে বিক্ষিপ্তভাবে চর্বি থাকে। এটি আবরণী কলা দিয়ে আবৃত থাকে।
(খ) মধ্যস্তর- এটি বহিঃস্তর এবং অন্তঃস্তরের মাঝখানে অবস্থান করে । এটি শক্ত অনৈচ্ছিক পেশি দিয়ে গঠিত।
(গ) অন্তঃস্তর- এটি সব থেকে ভেতরের স্তর। হৃদপিন্ডের প্রকোষ্ঠগুলো অন্তঃস্তর দিয়ে আবৃত থাকে। অন্তঃস্তরটি হৃদপিন্ডের কপাটিকাগুলোকেও আবৃত করে রাখে।
হৃদপিন্ডের ভেতরের স্তর ফাঁপা এবং চারটি প্রকোষ্ঠে বিভক্ত। উপরের প্রকোষ্ঠ দুটি নিচের প্রকোষ্ঠ দুটির চেয়ে আকারে
ছোট। উপরের প্রকোষ্ঠ দুটিকে ডান ও বাম অলিন্দ (Right and left auricle) এবং নিচের প্রকোষ্ঠ দুটিকে ডান ও বাম নিলয় (Right and left ventricle) বলে।
অলিন্দদ্বয়ের প্রাচীর তুলনামূলকভাবে পাতলা, আর নিলয়ের প্রাচীর পুরু । অলিন্দ ও নিলয় যথাক্রমে আন্তঃঅলিন্দ পর্দা ও আন্তঃনিলীয় পর্দা দ্বারা পরস্পর থেকে পৃথক থাকে।
হৃদপিন্ডের উভয় অলিন্দ ও নিলয়ের মধ্যে ছিদ্র পথ থাকে যা খোলা বা বন্ধ করার জন্য কপাটিকা (Valve) থাকে। ঠিক একইভাবে ডান অলিন্দ ও ডান নিলয় মধ্যবর্তী ছিদ্রপথ তিন পাল্লাবিশিষ্ট ট্রাইকাসপিড কপাটিকা দ্বারা সুরক্ষিত থাকে। অনুরূপভাবে বাম অলিন্দ ও বাম নিলয় দু'পাল্লাবিশিষ্ট বাইকাসপিড কপাটিকা দ্বারা সুরক্ষিত থাকে।
আরও পড়ুন:- রক্ত কাকে বলে?
মহাধমনি ও ফুসফুসীয় ধমনির মুখে অর্ধচন্দ্রাকৃতির কপাটিকা থাকে। এদের অবস্থানের ফলে পাম্প করা রক্ত একই দিকে চলে এবং উল্টো দিকে রক্ত কোন ক্রমেই ফিরে আসতে পারে না।
হৃদপিন্ডের কাজ :-
১। হৃদপিন্ড রক্ত সংবহন তন্ত্রের প্রধান অঙ্গ। এর সাহায্যেই সংবহন তন্ত্রে রক্ত প্রবাহ সচল থাকে ।২। মানব হৃদপিন্ড চার প্রকোষ্ঠে বিভক্ত। সংবহন তন্ত্রে প্রকোষ্ঠগুলো সম্পূর্ণ বিভক্ত থাকায় এখানে অক্সিজেনযুক্ত ও অক্সিজেনবিহীন রক্তের সংমিশ্রণ ঘটে না।
হৃদপিন্ডের মধ্যে রক্ত সঞ্চালন পদ্ধতি :-
যেহেতু হৃদপিন্ড একটি পাম্পের ন্যায় ক্রিয়া করে। হৃদপিন্ডের অবিরত সংকোচন ও প্রসারণের মাধ্যমে এ ক্রিয়া সম্পন্ন হয়। হৃদপিন্ডের অলিন্দদ্বয় প্রসারিত হলে দেহের বিভিন্ন অংশ থেকে রক্ত হৃদপিন্ডে প্রবেশ করে।যেমন- মহাশিরার মাধ্যমে কার্বন ডাইঅক্সাইডযুক্ত রক্ত ডান অলিন্দে প্রবেশ করে। ঠিক একই সময় ফুসফুশীয় শিরার বা পালমোনারি শিরার মাধ্যমে অক্সিজেনযুক্ত রক্ত বাম অলিন্দে প্রবেশ করে।
অলিন্দদ্বয়ের সংকোচনের ফলে নিলয়দ্বয়ের পেশি প্রসারিত হয়। ফলে ডান অলিন্দ-নিলয়ের ছিদ্রপথের ট্রাইকাসপিড কপাটিকা খুলে যায় এবং ডান অলিন্দ থেকে কার্বন ডাইঅক্সাইডযুক্ত রক্ত ডান নিলয়ে প্রবেশ করে।
আরও পড়ুন:- রক্তচাপ এর কাজ কি?
ঠিক একই সময়ে বাম অলিন্দ ও বাম নিলয়ের মধ্যকার বাইকাসপিড কপাটিকা খুলে যায় এবং বাম অলিন্দ থেকে অক্সিজেনযুক্ত রক্ত বাম নিলয়ে প্রবেশ করে। এর পরপরই ছিদ্রগুলো কপাটিকা দ্বারা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে নিলয় থেকে রক্ত পুনরায় অলিন্দে প্রবেশ করতে পারে না।
যখন নিলয়ায় প্রসারিত হয় তখন ডান নিলয় থেকে CO, যুক্ত রক্ত ফুসফুসীয় ধমনির মাধ্যমে ফুসফুসে প্রবেশ করে। এখানে রক্ত পরিশোধিত হয় এবং বাম নিলয় থেকে O2 যুক্ত রক্ত মহাধমনির মাধ্যমে সারা দেহে পরিবাহিত হয় এবং উভয় ধর্মনির অর্ধচন্দ্রাকৃতির কপাটিকাগুলো বন্ধ হয়ে যায়। ফলে রক্ত পুনরায় নিলয়ে ফিরে আসতে পারে না। এভাবে হৃদপিন্ডে পর্যায়ক্রমে সংকোচন ও প্রসারণের ফলে রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে।
হৃদপিন্ড সম্পর্কিত রোগ :-
হার্ট অ্যাটাক হৃদপিন্ড রক্তের মাধ্যমে অক্সিজেন ও খাবারের সারবস্তু রক্তনালির মধ্য দিয়ে দেহের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে দেয়। নিজের কাজ সঠিকভাবে করার জন্য অর্থাৎ শক্তি অর্জনের জন্য হৃদপিণ্ডের তিনটি প্রধান রক্তনালি আছে। এগুলোর মধ্যে অনেক সময় চর্বি জমে রক্ত চলাচলে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। ফলে প্রাণঘাতী রোগ হার্ট অ্যাটাক হয়।যখন কারও হৃদযন্ত্রের কোনও অংশে রক্ত জমাট বাঁধার কারণে রক্ত প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায় কিংবা বাধাগ্রস্থ হয়ে হৃদপিণ্ডের কোষ কিংবা হৃদপেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়, তখন করোনারি প্রন্থোসিস নামে হার্ট অ্যাটাক হয়। বর্তমানে শুধু ৪০-৬০ বছর বয়সী লোকেরা নয় অনেক ক্ষেত্রে ১৮ বছরের তরুণরাও এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
হার্ট অ্যাটাকের কারণ :-
১. দেহের ওজন বেড়ে যাওয়া।২. অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস যেমন- অধিক তেলযুক্ত খাবার (বিরানি, তেহারি, বার্গার, বিফ ও চিকেন প্যাটিস) খাওয়া।
৩. অলস জীবন যাপন এবং শারীরিক পরিশ্রম না করা।
৪. সর্বদা হতাশা, দুশ্চিন্তাগ্রস্থ ও বিমর্ষ থাকায় যে কোনো বয়সে এ রোগের ঝুঁকি বাড়ে।
হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ :-
১. বুকে অসহনীয় ব্যথা অনুভব হওয়া।২. বুকের মাঝখানে প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করা। ব্যথা বাম দিক থেকে সারা বুকে ছড়িয়ে যেতে পারে।
৩. ব্যথা অনেক সময় গলা বা বাম হাতে ছড়িয়ে যায়।
৪. রোগী প্রচন্ডভাবে ঘামতে থাকে ও বুকে ভারী চাপ অনুভব করে।
৫. বমির ভাব বা অনেক সময় রোগীর বমি হতে পারে।
হার্ট অ্যাটাকের প্রতিকার-
হার্ট অ্যাটাকের রোগ এক মারাত্মক হৃদরোগ। এ রোগ থেকে বাঁচতে হলে কিছু নিয়ম মেনে চলা দরকার। যথা-১. ধূমপান না করা।
২. নিয়মিত ব্যায়াম করা বা হাঁটা।
৩. খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করা।
৪. কাঁচা ফল ও শাকসব্জি বেশি বেশি খাওয়া।
৫. চর্বিযুক্ত খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকা।
৬. ভাজা খাবার, মসলাযুক্ত খাবার, ফাস্টফুড খাওয়া বাদ দেওয়া।
হৃদপিণ্ডকে সুস্থ রাখার উপায় :-
মানুষের স্বাভাবিক জীবন যাত্রায় হৃদপিন্ডের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হৃদপিণ্ড সুস্থ রাখার জন্য সঠিক জীবন চক্র ও খাদ্য নির্বাচনের প্রয়োজন রয়েছে। নানা ধরনের চর্বি জাতীয় খাদ্য হৃদযন্ত্রের কার্যক্রমকে ব্যাহত করে।রক্তের কোলেস্টেরল হৃদপিন্ডের রক্তনালিতে প্রতিন্ধকতা সৃষ্টি করে হৃদযন্ত্রের ক্ষতি করে। মাদক ও নেশা সেবনে হৃদযন্ত্রের স্বাভাবিক ক্রিয়া এবং হৃদযন্ত্রের প্রভূত ক্ষতি হয়।
ধূমপান বা জার নিকোটিন হৃদপেশির ক্ষতি করে। মেদ বা চর্বি সৃষ্টিকারী খাদ্য, যেমন- তেল, চর্বি, অতিরিক্ত শর্করা পরিহার করে, সুষম খাদ্য গ্রহণ করে, প্রতিদিন পরিমিত ব্যায়াম এবং হাঁটা চলার মাধ্যমে সুস্থ জীবন লাভ করা যায়।
0 মন্তব্যসমূহ
Please do not enter any spam link in the comment box.