ধান গাছের ব্লাইট রোগের কারণ,লক্ষণ, প্রতিকার ও প্রতিরোধ?

সকল ব্যাকটেরিয়া উদ্ভিদে রোগ উৎপাদন করে না। যে সকল ব্যাকটেরিয়া উদ্ভিদে রোগ সৃষ্টি করে তাদের অধিকাংশই Xanthomonas Encinia এবং Pseudomonas গণের প্রজাতিসমূহ। এছাড়াও Streptomyces, Corynebacterium, Agrobacterium গণের কিছু প্রজাতিও উদ্ভিদের রোগ উৎপাদন করে। এ সকল ব্যাকটেরিয়া উদ্ভিদে প্রধানত ব্লাইট, পাতার দাগজনিত রোগ, নরম পঁচা, গল, ক্যাঙ্কার, ঢলে পড়া প্রভৃতি রোগ সৃষ্টি করে।

ব্লাইট বা মড়ক :-

এক্ষেত্রে ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে গাছের কিছু কিছু অংশ খুব দ্রুত বিবর্ণ হয়। ফলে রোগাক্রান্ত গাছগুলো মরে যায়। অনেক সময় মৃত অংশ পাঁচে দুর্গন্ধ সৃষ্টি করে। একে ব্লাইট বা মড়ক বলা হয়। যেমন- ধানের পাতা ধ্বসা রোগ।

এটির জন্য দায়ী ব্যাকটেরিয়া হলো Xanthomonas oryzae ধান গাছের ব্লাইট রোগ ধানের যতগুলো মারাত্মক রোগ রয়েছে তার মধ্যে ব্যাকটেরিয়াল ব্লাইট অন্যতম।

প্রায় পৃথিবীব্যাপি এর বিস্তৃতি। জাপানের কৃষকরা সর্বপ্রথম ধানের ব্লাইট রোগের সন্ধান পান। প্রথমদিকে তারা মনে করতো পরিবেশজনিত কোন কারণে এ রোগটি হয়। কিন্তু পরে বিভিন্ন গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে, ধান গাছের ব্লাইট রোগ এক প্রকার ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সংঘটিত হয়।

বাংলাদেশে এ রোগের অস্তিত্ব প্রথম পাওয়া যায় ১৯৬৬ সালে রোপা আমন ধানে। এ রোগের প্রকোপের মাত্রা অনুযায়ী ধানের ফলন ৬- ৬০% কমে যায়।

ধান গাছের ব্লাইট রোগের কারণ :

Takaeshi ১৯০৮ সালে প্রমাণ করেন যে, ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে এ রোগ হয়। পরে আরও অনেকে এ ব্যাকটেরিয়া নিয়ে কাজ করেন। ধান গাছের ব্যাকটেরিয়াল ব্লাইট রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুর নাম Xanthomonas oryzae pv oryzae (Ishasyama) Swings et al.।


এরা বিভিন্ন ঘাস এবং বুনো ধান গাছকে বিকল্প পোষক হিসেবে গ্রহণ করে বাঁচে। একাধিক উৎস থেকে রোগের উৎপত্তি হতে পারে। যেমন- রোগাক্রান্ত বীজ, রোগাক্রান্ত খড়, পাতার ক্ষত স্থান, কাঁটা স্থান, পানিরন্ধ্র বা পত্ররন্ধ্রের মাধ্যমে জীবাণু গাছের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে এবং সেখানে সংখ্যা বৃদ্ধি করে। পরে জীবাণু পাতার শিরার ভেতরে প্রবেশ করে। মূলের ভেতরে প্রবেশ করলে পানি প্রবাহ বন্ধ হয় এবং গাছ নেতিয়ে পড়ে।

অপেক্ষাকৃত উচ্চ তাপমাত্রা যেমন ২৫-৩০ সে, উচ্চ জলীয় বাষ্প, বৃষ্টি, জমিতে অধিক পানি ব্লাইট রোগ সৃষ্টি করতে সহায়তা করে। অধিক পরিমাণ সার প্রয়োগও রোগ বিস্তারে অনুকূল থাকে।

ধান গাছের ব্লাইট রোগের লক্ষণ -

লক্ষণ হলো রোগের বহিঃপ্রকাশ মাত্র। একটি গাছের বিশেষ কোন অংশ রোগাক্রান্ত হলে ঐ অংশের কোষগুলোর স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা লোপ পেতে থাকে। ফলে গাছে রোগের আনুষঙ্গিক লক্ষণগুলো ধীরে ধীরে প্রকাশ পায়। সাধারণত রোগ লক্ষণ পাতায় সীমিত থাকে। ধান গাছের ক্ষেত্রে ব্লাইট রোগের লক্ষণগুলো হলো-

১। গ্রীষ্মকালে সাধারণত ধানের ছড়া বের হবার সময় এ রোগ দেখা দেয়।

২। প্যাথোজেনের আক্রমণে প্রথমে পাতায় ভেজা, অর্ধস্বচ্ছ এবং লম্বা লম্বা দাগের সৃষ্টি হয়।

৩। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পাতার কিনারা দিয়ে দাগের সূচনা হয় এবং রোগের মাত্রা বাড়ার সাথে সাথে দাগগুলো পাতার নিচের দিকে প্রসারিত হয়। এ সময় দাগগুলো ঢেউ খেলানো প্রান্তবিশিষ্ট হয়।

৪। দাগগুলো ক্রমান্বয়ে হলুদ বা হলদে সাদা এবং পরবর্তীতে স্যাপ্রোফাইটিক ছত্রাকের আক্রমণে ক্ষতস্থান ধূসর হয়।

আরও পড়ুন:- প্লাস্টিড কি?

৫। সকালে আক্রান্ত স্থান থেকে দুধের ন্যায় সাদা বা অর্ধস্বচ্ছ রস ধীরে প্রবাহিত হয়।

৬। পাশাপাশি অনেকগুলো দাগ একত্রিত হলে একটি বড় দাগের সৃষ্টি হয়।

৭। আক্রমণ বেশি হলে পাতা দ্রুত শুকিয়ে যায়।

৮। চারা লাগানোর ১-৩ সপ্তাহের মধ্যে প্রাথমিকভাবে আক্রান্ত হতে পারে। এ অবস্থায় আক্রমণ বেশি হলে চারা ঢলে পড়ে ।

৯। পাতার উপর সাদা আঠালো এক প্রকার রস জমতে থাকে।

১০। ধানের ছড়া বন্ধ্যা হয় ফলে ফলন ৬০% পর্যন্ত কম হতে পারে।
ধান গাছের ব্লাইট রোগের কারণ

ধান গাছের ব্লাইট রোগের প্রতিকার :-

১। জমিতে নাইট্রোজেন সার সময়মত এবং প্রয়োজনীয় পরিমাণে প্রয়োগ করতে হবে।

২। ক্ষেতে কপার অক্সিক্লোরাইড ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দিতে হবে। এতে রোগের প্রকোপ কম হবে।

৩। ক্ষেতে পানি সেচের সময় উহার সাথে ব্লিচিং পাউডার ব্যবহার করতে হবে।

৪। ব্লিচিং পাউডার (পরিমাণ মত) এবং জিঙ্ক সালফেট দিয়ে বীজ শোধন করলে রোগাক্রমণ বহুলাংশে কমে। কারণ বীজই রোগ জীবাণুর প্রধান বাহন।

৫। অ্যান্টিবায়োটিক বা অন্যান্য রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করলে কিছুটা উপকার পাওয়া যায়।

ধান গাছের ব্লাইট রোগের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা :-

১। সবচেয়ে কার্যকরী হলো রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন এবং উন্নত জাতের প্রকরণ চাষ করা।

২। বীজ বপনের পূর্বে ক্ষেতের আগাছা বিনাশ করতে হবে। এমনকি বপনের পরও যাতে ক্ষেতে কোন প্রকার আগাছা জন্মাতে না পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে। কোন কারণে জমিতে আগাছা জন্মালে সেগুলো এমনভাবে বিনষ্ট করতে হবে যাতে ধান গাছের কোন ক্ষতি না হয়।

৩। বীজ বুনা বা চারা লাগানোর পূর্বে জমিকে ভালভাবে শুকাতে হবে এবং পরিত্যক্ত খড় ও আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলতে হবে। নিজ থেকে গজানো চারা জমি থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে।

৪। বীজতলায় পানি কম রাখতে হবে। অতিবৃষ্টির সময় পানি সরানোর ব্যবস্থা রাখতে হবে।

৫। চারা থেকে চারার দূরত্ব, লাইন থেকে লাইনের দূরত্ব, সার প্রয়োগ ইত্যাদি বিজ্ঞান সম্মতভাবে হতে হবে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ