জীবপ্রযুক্তি (Biotechnology) :-
কোন জীবকে মানবকল্যাণে প্রয়োগের যে কোনো প্রযুক্তিকে বলা হয় জীবপ্রযুক্তি।
আজ বহুল প্রচারিত এবং প্রসারিত জীবপ্রযুক্তি শব্দটি নতুন হলেও মানব কল্যাণে জীবজ প্রতিনিধির ব্যবহার অনেক আগের। মানব সভ্যতার ইতিহাসে অনেক আগে থেকেই দুধ থেকে দই, মাখন, পনির ইত্যাদি এবং গাঁজন বা চোলাইকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মদ, অ্যালকোহল, পাউরুটি প্রভৃতি উৎপাদনের ক্ষেত্রে অণুজীবের ব্যবহার এবং উন্নত জাতের গো-মহিষ ও ফসল নির্বাচনের জন্য জীবজ বা কোষীয় উপাদানের ব্যবহার হয়ে আসছে।
জীবপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে মানব কল্যাণে ব্যবহৃত জীবের এবং জৈব উপাদানের গুণগত মান বৃদ্ধির পাশাপাশি নতুন নতুন মূল্যবান উপাদান সৃষ্টি এবং এদের ব্যবহারের সহজ ও উন্নত কলাকৌশল উদ্ভাবিত হচ্ছে।
হাঙ্গেরীয় প্রকৌশলী কার্ল এরেকি (১৯১৯) সর্বপ্রথম Biotechnology শব্দটি প্রবর্তন করেন। জীবপ্রযুক্তি জীববিজ্ঞানের একটি উন্নয়নশীল ফলিত শাখা।
Biotechnology শব্দটি Biology এবং Technology এর সমন্বয়ে গঠিত। Biology শব্দের অর্থ জীব সম্পর্কিত বিদ্যা এবং Technology শব্দের অর্থ প্রযুক্তি। অর্থাৎ Biotechnology হলো Biological Science এর সাথে আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বিত বিদ্যা।
আরও পড়ুন :- জৈব বিবর্তন কাকে বলে?
১৯৭০ এর পর থেকে এ শব্দটি বর্তমান বিশ্বে ব্যাপকহারে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বিভিন্ন সময়ে বিজ্ঞানীগণ বিভিন্নভাবে Biotechnology কে সংজ্ঞায়িত করেছেন। যেমন-
US National Science Foundation এর মতে মানব কল্যাণে জৈবিক উপকরণ যথা- অণুজীব অথবা কোষীয় উপাদানের নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারই Biotechnology।
International Union of Pure and Applied Chemistry (IUPAC- 1981) এর মতে 'জীবপ্রযুক্তি হলো শিল্পে প্রক্রিয়াজাতকরণ ও উৎপাদিত দ্রব্য এবং শিল্প পরিবেশের উপর প্রাণরসায়ন, জীববিজ্ঞান, অণুজীববিজ্ঞান এবং রসায়ন প্রকৌশলের প্রয়োগ"।
জীবপ্রযুক্তির ইতিহাস :-
সভ্যতার শুরু থেকেই মানুষ তাদের কাজের জন্য জীবপ্রযুক্তির সাথে জড়িত। স্কুল অর্থে মানুষ যখন কৃষিকাজ ও পশুপালন শুরু করে তখন থেকেই জীবপ্রযুক্তির গোড়াপত্তন হয়েছিল। মানুষ তাদের সংগৃহীত জীবের উন্নয়নে নির্বাচন ও সংকরায়ন করে কাঙ্ক্ষিত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন অধিক উৎপাদনক্ষম জীব উৎপাদন করতে থাকে। এগুলো ছিল জীবপ্রযুক্তির প্রাথমিক ধাপ।আমরা গাঁজন ও চোলাইকরনের (Fermentation and Brewing) সাথে অনেকেই পরিচিত। বহুকাল পূর্ব হতেই বিয়ার তৈরিতে গাঁজন প্রক্রিয়া মেসোপটেমিয়া, মিশর, চীন ও ভারতে প্রচলিত আছে। মদশিল্পে ঈস্টের ব্যবহার একটি সাধারণ বিষয়।
গাঁজন প্রক্রিয়া সম্পর্কে লুই পাস্তুরের (১৮৫৭) কাজটি ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি সে সময় গাঁজন প্রক্রিয়ার ব্যাখ্যা দেন। গ্রেগর জোহান মেন্ডেল (১৮৬৩) কর্তৃক কৌলিতত্ত্ব (Genetics) এর সূত্রসমূহ আবিষ্কার জীবপ্রযুক্তির সম্ভাবনার নতুন পথ দেখিয়েছে।
আরও পড়ুন :- শিখন কি?
চেইম উইকম্যান (১৯১৭) কর্ণ স্টার্চে Clostridium acetobutylicum ব্যাকটেরিয়ার বিশুদ্ধ আবাদ হতে অ্যাসিটোন উৎপাদন করেন যা ইউরোপিয়ানরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বিস্ফোরক তৈরিতে ব্যবহার করেন। সেটি ছিল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় বা নিজ এলাকায় শত্রুমুক্ত করার একটি অগ্রসর পদক্ষেপ।
আলেক্সান্ডার ফ্লেমিং (১৯২৮) পেনিসিলিয়াম হতে পেনিসিলিন আবিষ্কার করেন। এটা মানুষের ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন নিরাময়ে ব্যবহৃত হয়। এ অ্যান্টিবায়োটিকটি বর্তমানে ওষুধশিল্পে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত হচ্ছে।
Watson এবং Crick (১৯৫৩) এর ডিএনএ ডবল হেলিক্স মডেল আবিষ্কারের ধারাবাহিকতায় জীবপ্রযুক্তি আধুনিকতার পথে অগ্রসর হয়েছে।
পল বার্গের (১৯৭১) জিন স্প্রাইসিং পরীক্ষা হতে আধুনিক জীবপ্রযুক্তির যাত্রা শুরু হয়।
জীবপ্রযুক্তির গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের মধ্যে রয়েছে, ১৯৮৩ সালে পলিমারেজ চেইন বিক্রিয়া (PCR) এর ব্যবহার, ১৯৮৪ সালে জেনেটিক ফিঙ্গার প্রিন্টিং পদ্ধতি উদ্ভাবন, ১৯৮৭ সাল থেকে জিন পৃথকীকরণ, ১৯৯৭ সালে প্রথম ক্লোন প্রাণীর জন্ম ( ডলি), ২০০১ সালে সম্পূর্ণ মানব জিনোম সিকুয়েন্স নির্ণয়, ২০০৪ সালে গোল্ডেন রাইস, ২০০৫ সালে সুপার রাইস উদ্ভাবন ইত্যাদি।
জীবপ্রযুক্তির পরিসর :-
জীবপ্রযুক্তি জীববিজ্ঞানের একটি শাখা সত্ত্বেও এর সম্প্রসারণ খুব দ্রুত হচ্ছে। জীবপ্রযুক্তির অন্তর্ভুক্ত শাখাগুলো হলো-(ক) টিস্যু কালচার,
(খ) মলিক্যুলার বায়োলজি,
(গ) জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এবং
(ঘ) উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব।
সম্প্রতি আণবিক জীববিজ্ঞানের গবেষণার জীবপ্রযুক্তির যে প্রসার ঘটেছে তাকে বলা হয় নতুন জীবপ্রযুক্তি।
আরও পড়ুন :- বিভিন্ন ধরনের যৌনবাহিত রোগসমূহ?
0 মন্তব্যসমূহ
Please do not enter any spam link in the comment box.