ইমিউনিটি ও ইমিউন সিস্টেম কাকে বলে? কত প্রকার ও কি কি?

ইমিউনিটি কাকে বলে :- 

মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গ, কলা ও কোষ নিয়মতান্ত্রিকভাবে একত্রে দেহের প্রতিরক্ষা (defence) ব্যবস্থাপনায় কোন ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, পরজীবী ও অন্যান্য জীবাণুর আক্রমণ থেকে মানুষকে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে তাকে বলা হয় ইমিউনিটি (immunity)।

দেহের বিভিন্ন অঙ্গ, কলা ও কোষ সমন্বয়ে গঠিত যে তন্ত্র দেহকে রোগাক্রমণের হাত থেকে এবং রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণুর ক্ষতিকারক প্রভাব থেকে রক্ষা করে তাকে ইমিউন তন্ত্র (immune system) বলা হয়।

রোগ প্রতিরোধে ইমিউনিটির প্রধান উদ্দেশ্য তিন প্রকারের। যথা-

১. অনুজীবদের (micro- organisms) বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা,

২. দেহের ক্ষতিগ্রস্ত কোষগুলোকে শনায় করা ও প্রতিস্থাপিত করা এবং

৩. পরিত্যক্ত বা নষ্ট কোষগুলোকে শনাক্ত করা এবং তাদের ধ্বংস করা।

সহজাত ইমিউনিটি প্রতিরোধ গড়ার পদ্ধতি :-

এ ধরনের ইমিউনিটি নিম্নলিখিতভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলে-

আরও পড়ুন :- টিকা কাকে বলে?

১. আগ্রাসন ভোজন (Phagocytosis) :

রেটিকিউলো এন্ডোথেলিয়াল তন্ত্রের আগ্রাসন কোষ, রঙের মনোসাইট, নিউট্রোফিল, যকৃতের ফুফার কোষ, সংযোগী কলার হিস্টিওসাইট, প্লিহা, লসিকাগ্রন্থি, থাইমাস গ্রন্থির জালককোষ সক্রিয় অগ্রাসন পদ্ধতিতে রোগ জীবাণু ধ্বংস করে।

এছাড়া প্রদাহ স্থানে আগ্রাসক কোষ প্রবেশ করে স্বাভাবিক অনাক্রম্যতায় অংশগ্রহণ করে।

২. এসিড ও উৎসেচক :

পাকস্থলীতে গৃহিত জীবাণু পাকস্থলীর হাইড্রোক্লোরিক এসিড ও পাচক উৎসেচক দ্বারা বিনষ্ট হয়।

৩. ত্বক ও শ্লেষ্মা ঝিল্পি :

ত্বক তার কঠিন বহিঃস্তরের মাধ্যমে দেহে রোগ জীবাণু প্রবেশে বাধা প্রদান করে। নাসিকার মিউকাস স্তর রোগ জীবাণুকে মুখবিবরে লালার মধ্যে ঠেলে দেয়। তখন রোগ জীবাণু গলাধাকৃত হয়ে পাকস্থলীতে আসে এবং এসিডের সংস্পর্শে বিনষ্ট হয়।

৪. রক্তস্থিত রাসায়নিক পদার্থ :

রক্তের কিছু রাসায়নিক পদার্থ জীবাণু বিনাশে অংশগ্রহণ করে। যেমন-

লাইসোজাইম : এটি এক রকম মিউকোলাইটিক পলিস্যাকারাইড জাতীয় পদার্থ, যা ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংস করে।

বেসিক পলিপেপটাইড : এই পদার্থটি কোনো কোনো গ্রাম পজিটিভ ব্যাকটেরিয়ার সঙ্গে বিক্রিয়া করে ও তাদের নিষ্ক্রিয়া ও বিনষ্ট করে।

প্রোপারডিন : এটি একটি বৃহদাকার প্রোটিন যা গ্রাম-নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়াগুলো বিনষ্ট করে।

অ্যান্টিবডি : এরা রক্তের স্বাভাবিক অ্যান্টিবডি। অ্যান্টিজেনের উপস্থিতিতে এরা উৎপন্ন হয় এবং বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও প্রতিবিষকে ধ্বংস করে।

প্রাকৃতিক কিলার সেল : এরা এক ধরনের লিম্ফোসাইট, এরা বিভিন্ন বিজাতীয় কোষ, টিউমার কোষ প্রভৃতিকে বিনষ্ট করে।


সহজাত ইমিউনিটি-তন্ত্রের প্রধান কাজ :-

মেরুদণ্ডী প্রাণীর দেহে সহজাত ইমিউনতন্ত্রের প্রধান কাজগুলো হলো-

১. সংক্রমণ স্থানে অনাক্রমা কোষগুলোকে নিযুক্ত করে সাইটোকাইনস (cytokines)-এর মতো রাসায়নিক দূত উৎপাদন করা।

২. কমপ্লিমেন্ট তন্ত্রকে সক্রিয় করে ব্যাকটেরিয়াকে শনাক্ত করা এবং মৃত কোষ পরিষ্কার করা।

৩. অঙ্গ, কলা বা লসিকাতে উপস্থিত বহিরাগত বস্তুগুলোকে বিশেষ শ্বেতরক্তকণিকা দিয়ে শনাক্ত করা ও বর্জন করা।

৪. অর্জিত ইমিউন তন্ত্রকে সক্রিয় করে তোলা।
ইমিউন সিস্টেম কাকে বলে

অর্জিত ইমিউনিটি বা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা :-

যেসব ইমিউনিটি সহজাত নয়, জন্মের পর দেহে রোগ জীবাণু প্রবেশের ফলে সৃষ্টি হয় তাদের অর্জিত ইমিউনিটি বলে।

এ রকম ইমিউনিটি প্রাণীর জন্যের পর অর্থাৎ প্রাণির জীবদ্দশায় অর্জিত হয়। কোনো ক্ষতিকর অণুজীব কিংবা ক্ষতিকর পদার্থের প্রভাবে বা অন্য কোনো কারণে দেহে এ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সৃষ্টি হয়।

অর্থাৎ দেহের প্রয়োজনে যে ইমিউনিটি আবির্ভাব ঘটে সেটাই হচ্ছে অর্জিত ইমিউনিটি। অর্জিত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে আবার নিম্নোক্তভাবে ভাগ করা যায়-

১. নিয়ন্ত্রিত মাধ্যমের ওপর ভিত্তি করে :-

ক. কোষনির্ভর ইমিউনিটি বা কোষ নিয়ন্ত্রিত ইমিউনিটি (Cellular immunity or Cell mediated immunity)-

দেহের যে ইমিউনিটি T লিম্ফোসাইট বা T- কোষের সাহায্যে ঘটে তাকে কোষভিত্তিক ইমিউনিটি বলে।

এ ধরনের অর্জিত ইমিউনিটি T-শ্রেণির লিম্ফোসাইট সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং অনুপ্রবিষ্ট রোগ জীবাণু ধ্বংস করে। লোহিত মজ্জা থেকে T- লিম্ফোসাইট সৃষ্টিকারী কোষ থাইমাস গ্রন্থিতে প্রবেশ করে T লিম্ফোসাইটে পরিণত হয় এবং লসিকাগ্রন্থিতে আশ্রয় লাভ করে।

দেহে অ্যান্টিজেন প্রবেশ করলে তাকে ম্যাক্রোফেজ গ্রাস করে। T লিম্ফোসাইট ম্যাক্রোফেজযুক্ত অ্যান্টিজেনকে গ্রহণ করে এবং লিঙ্কোকাইনিন এনজাইমের সাহায্যে তাদের ধ্বংস করে।

খ. রসভিত্তিক ইমিউনিটি বা হিউমোরাল ইমিউনিটি বা অ্যান্টিবডি নিয়ন্ত্রিত ইমিউনিটি (Humoral immunity or Antibody mediated immunity) -

দেহে যে অনাক্রম্যতা B-লিম্ফোসাইটের B-কোষ এর সাহায্যে ঘটে তাকে রসভিত্তিক ইমিউনিটি বলে।

আরও পড়ুন :- কোলেস্টেরল কি?

B-লিম্ফোসাইট এ ধরনের ইমিউনিটির সঙ্গে যুক্ত। রক্তে অ্যান্টিজেন প্রবেশ করার পর B- লিম্ফোসাইট তার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হয়। অ্যান্টিজেনের প্রভাবে B-লিম্ফোসাইট কোষ ব্লাস্ট কোষে পরিণত হয় এবং ব্লাস্ট কোষ থেকে প্লাজমা কোষ তৈরি হয়। প্লাজমা কোষ অ্যান্টিবডি বা ইমিউনোগ্লোবিউলিন সৃষ্টি করে।

২. সক্রিয়তার ওপর নির্ভর করে-

ক. সক্রিয় বা প্রত্যক্ষ ইমিউনিটি (Active immunity) :

মেরুদণ্ডী প্রাণিদেহে (যেমন- মানুষ) এমন কিছু ব্যবস্থা থাকে, যা দেহে জীবাণু অনুপ্রবেশের পরে সক্রিয় হয়ে ওঠে। ফলে জীবাণু ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এ ধরনের প্রতিরোধ ব্যবস্থা সক্রিয় ইমিউনিটি অন্তর্ভুক্ত।

এই অনাক্রম্যতার পরিচায়ক হচ্ছে T লিম্ফোসাইট দ্বারা জীবাণু দমন কিংবা B-লিম্ফোসাইট কর্তৃক অ্যান্টিবডি ক্ষরণের মাধ্যমে জীবাণু দমন। এ ইমিউনিটি আবার দুই শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। যথা-

i. প্রাকৃতিকভাবে লব্ধ সক্রিয় ইমিউনিটি (Naturally acquired active immunity):

আমাদের দেহে কোনো রোগের জীবাণু প্রবেশ করলে তা অ্যান্টিজেন নামক পদার্থের প্রভাবে রক্তের T ও B-লিম্ফোসাইট সক্রিয় হয়ে ওঠে। সক্রিয় লিম্ফোসাইটগুলোর প্রভাবে ফ্যাগোসাইটোসিস (phagocytosis) প্রক্রিয়ায় জীবাণুর সংক্রমণ প্রতিহত হয়।

আরও পড়ুন :- কোষ রস কাকে বলে?

তাছাড়াও সক্রিয় লিম্ফোসাইটগুলোর সংখ্যা বৃদ্ধির মাধ্যমে স্মৃতিকোষ (memory cell) সৃষ্টি করে, যেগুলো রক্তের মধ্যে দীর্ঘদিন মজুদ থাকে ও ভবিষ্যতে আগের মতো জীবাণু দেহে প্রবেশ করলে তাদের সহজে ও দ্রুত দমন করে ফেলে।

ii. কৃত্রিম উপায়ে লব্ধ সক্রিয় ইমিউনিটি (Artificially acquired active immunity):

এ রকম ইমিউনিটি প্রতিষেধক প্রয়োগ দ্বারা (vaccination) সৃষ্টি করা যায়। ভ্যাক্সিন (vaccine) বা টিকা হলো নিষ্ক্রিয় জীবাণু বা অ্যান্টিজেন (attenuated antigens) দেহে ভ্যাক্সিন প্রয়োগ করলে, নিষ্ক্রিয় জীবাণু বা অ্যান্টিজেন কোনো রোগ সৃষ্টি করতে পারে না, কিন্তু অ্যান্টিজেনের সংস্পর্শে দেহের T ও B লিম্ফোসাইট সক্রিয় হয়ে ওঠে ও বিশেষ জীবাণুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধমূলক সব ব্যবস্থাই জেগে ওঠে।

সক্রিয় ইমিউনিটির প্রধান বৈশিষ্ট্য :-

১. দেহে সরাসরি সক্রিয়ভাবে উৎপন্ন হয়।

২. সক্রিয় ইমিউনিটির প্রভাব সুদূরপ্রসারী।

৩. এ ধরনের ইমিউনিটি নির্দিষ্ট অ্যান্টিবডি উৎপাদনের মাধ্যমে দীর্ঘ সময় পরে উপশম ঘটে।

৪  এ ধরনের ইমিউনিটিতে কোনো পার্শ্বীয় প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না।

খ. নিষ্ক্রিয় বা পরোক্ষ ইমিউনিটি (Passive immunity ) :-

এই প্রতিরক্ষা প্রাণী নিজ দেহে সক্রিয়ভাবে অ্যান্টিবডি সৃষ্টি না করে জীবাণু দমনের জন্য অন্য কোনো প্রাণী থেকে অ্যান্টিবডি লাভ করে। এ ধরনের অনাক্রম্যতা দুই শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। যথা-

আরও পড়ুন:- অ্যান্টিবডি কাকে বলে?

১. প্রাকৃতিগতভাবে লব্ধ পরোক্ষ/নিষ্ক্রিয় ইমিউনিটি (Artificially acquired passive immunity):

মাতৃগর্ভে শিশু অমরার (placenta) মাধ্যমে মাতৃদেহ থেকে অ্যান্টিবডি (IgG) অর্জন করতে পারে ও এর সাহায্যে অপরিণত শিশু জীবাণুর সংক্রমণ প্রতিরোধে সক্ষম হয়।

এটা ছাড়াও শিশু মাতৃদুগ্ধের মাধ্যমে (বিশেষতঃ কলোস্ট্রামের মাধ্যমে) IgG জাতীয় অ্যান্টিবডি প্রাপ্ত হয়। এটা শিশুর দেহে জীবাণু দমনে সহায়তা করে।

২. কৃত্রিম উপায়ে লব্ধ পরোক্ষ ইমিউনিটি (Artificially acquired passive immunity):

এ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় কৃত্রিম উপায়ে অন্য প্রাণীর দেহে রোগ জীবাণু প্রবেশ করিয়ে অনেক ক্ষেত্রে রোগ জীবাণু প্রতিরোধের জন্য প্রতিষেধক (vaccine) তৈরি করা হয়। এই প্রতিষেধক দ্বারা মানবদেহে রোগ সংক্রমণ প্রতিরোধ করা যায়।

এ প্রতিরোধ ব্যবস্থার উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, জলাতঙ্ক প্রতিরোধের জন্য অ্যান্টিরাবিজ (antirabies) প্রতিষেধকের ব্যবহার। সাম্প্রতিক সময়ে অধিক শক্তিশালী, নিরাপদ ও উন্নত প্রতিষেধক (vaccine) তৈরির চেষ্টা চলছে। যার একটি সাফল্য হচ্ছে- কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে হেপাটাইটিস ভাইরাসের (hepatitis virus) সফল ভ্যাকসিন প্রস্তুত।

নিষ্ক্রিয় ইমিউনিটির প্রধান বৈশিষ্ট্য :-

১. যে ইমিউনিটি দেহের বাইরে থেকে কোনো উপাদান দেহে প্রবেশ করিয়ে সৃষ্টি করা হয়, তাকে নিষ্ক্রিয় ইমিউনিটি বলে।

২. নিষ্ক্রিয় অনাক্রম্যতার প্রভাব স্বল্পস্থায়ী।

৩. এ ধরনের অনাক্রম্যতায় পার্শ্বীয় প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে।

অর্জিত অনাক্রম্যতাতন্ত্রের প্রধান কাজ :-

মেরুদণ্ডী প্রাণিদেহে অর্জিত অনাক্রম্যতাতন্ত্রের প্রধান কাজগুলো হলো-

১. বিশেষ কোষের মাধ্যমে জীবাণুর সংক্রমণ প্রতিরোধ করা।

২. একদা সংক্রমিত নির্দিষ্ট জীবাণুকে মনে রাখা ও পরবর্তীকালে সেই জীবাণুর আক্রমণকে প্রতিহত করা।

৩. জীবাণুর ভবিষ্যৎ আক্রমনের জন্য দেহকে প্রস্তুত রাখা।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ