প্রোটিন কাকে বলে? প্রোটিন কত প্রকার? প্রোটিন এর কাজ কি?

প্রোটিন কি বা কাকে বলে:-

প্রাণি ও উদ্ভিদের দেহকণা ও পেশিকোষের অন্যতম উপাদান হল প্রোটিন। সর্বপ্রথম প্রাণি ও উদ্ভিদ কোষের নাইট্রোজেন সম্বলিত রাসায়নিক পদার্থকে প্রোটিন নামে অভিহিত করা হয়।

দুধ, ডিম, মাছ, মাংস, ছানা ইত্যাদিতে প্রায় সব ক্যাটি অত্যাবশ্যকীয় অ্যামাইনো এসিড পাওয়া যায়। এজন্য এসব খাদ্যের প্রোটিনকে উৎকৃষ্ট বা সম্পূর্ণ প্রোটিন বলে। 

অত্যাবশ্যকীয় অ্যামাইনো এসিডগুলো হল:
  • লাইসিন
  • আইসোলিউসিন
  • লিউসিন
  • মিনোইন
  • ট্রিপটোফ্যান
  • প্রিওনাইন
  • ভেনিল এবং
  • ফিনাইলএলানিন।

প্রোটিন জীবদেহের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জৈব রাসায়নিক পদার্থ। বিভিন্ন অ্যামাইনো অ্যাসিড বিভিন্নভাবে শৃঙ্খলিত হয়ে এক একটি প্রোটিন গঠন করে। আর অ্যামাইনো অ্যাসিড হলো প্রোটিনের মূল গাঠনিক একক।

প্রোটিন অণু বহু সংখ্যক অ্যামাইনো অ্যাসিডের সমন্বয়ে তৈরি।

প্রোটিন শব্দটি সর্বপ্রথম প্রয়োগ করেন জি. মুলার ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে।

প্রোটিন অসংখ্য অ্যামাইনো অ্যাসিড নিয়ে গঠিত বৃহদাকার যৌগিক জৈব অণু। একটি কোষের অভ্যন্তরে সারাক্ষণ শত শত প্রকার প্রোটিন তৈরি হয়।

আরও পড়ুন :- শৈবাল কাকে বলে?

জীবদেহের প্রায় সর্বত্রই প্রোটিন বিরাজমান। জৈব ক্রিয়া-বিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে এনজাইম, অ্যান্টিবডি, হরমোন। এগুলো সবই প্রোটিন। সব এনজাইম প্রোটিন কিন্তু সব প্রোটিন এনজাইম নয় ।

প্রোটিনের গঠন :-

প্রোটিনের মৌলিক উপাদান হচ্ছে কার্বন (C), হাইড্রোজেন (H), অক্সিজেন (O2) এবং নাইট্রোজেন (N) ১৬% থাকে। এই মৌলগুলি দিয়ে প্রথমে অ্যামাইনো এসিড তৈরি হয়।

প্রোটিনের রাসায়নিক ভাঙনের ফলে বিভিন্ন প্রকার অ্যামাইনো এসিড পাওয়া যায়। প্রায় ২৫টি অ্যামাইনো এসিডের সন্ধান এ পর্যন্ত পাওয়া গেছে একাধিক অ্যামাইনো এসিডের সংযোগের ফলে প্রোটিন গঠিত হয়।

এক এক ধরনের অ্যামাইনো এসিড এক এক ধরনের প্রোটিন তৈরি করে। দুধের প্রোটিন থেকে ডালের প্রোটিনের অ্যামাইনো এসিডের সংগঠন ভিন্ন। আবার ডিমের প্রোটিনের থেকে মাছের প্রোটিন ভিন্ন বিভিন্ন অ্যামাইনো এসিড বিভিন্ন সংখ্যায় ও নানাভাবে যুক্ত হয়ে এক প্রকারের প্রোটিন তৈরি করে।

প্রোটিন গঠনকারী প্রায় ২৫টি অ্যামাইনো এসিড বিদ্যমান। এদের মধ্যে ৮টি মানবদেহের জন্য অত্যাবশ্যক। এই অ্যামাইনো এসিডগুলো দেহে অন্যান্য খাদ্য হতে তৈরি হতে পারে না। অথচ দেহে প্রোটিন তৈরিতে সব কয়টি অ্যামাইনো এসিড থাকা প্রয়োজন। সেজন্য বিশেষ বিশেষ প্রোটিন জাতীয় খাদ্য হতে এই এসিডগুলো মানবদেহে সরবরাহ করতে হয়।
প্রোটিন কাকে বলে

প্রোটিনের বৈশিষ্ট্য :-

প্রোটিন কলয়েড প্রকৃতির, অধিকাংশ কেলাসিত বহুবিধ ভৌত ও রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় প্রোটিনের প্রকৃতির পরিবর্তন ঘটানো যায়। প্রোটিন পানিতে, লঘু অ্যাসিডে, ক্ষার ও মৃদু লবণের দ্রবণে দ্রবণীয়। এটি কার্বন, হাইড্রোজেন ও নাইট্রোজেন দ্বারা গঠিত। এতে সালফার, আয়রন ও তামা থাকে, অ্যাসিড প্রয়োগ করলে প্রোটিন তঞ্চিত হয়। এতে প্রোটিনের আণবিক গঠনের পরিবর্তন হয় এবং প্রোটিনকে আর্দ্রবিশ্লেষণ করলে অ্যামাইনো অ্যাসিড পাওয়া যায়।

প্রোটিন এর কাজ কি :-

১. কোষে প্রোটিন সঞ্চিত খাদ্য হিসেবে কাজ করে এবং দরকারে শক্তি উৎপাদন করে।

২. কোষের বিভিন্ন অঙ্গাণু এবং কোষ ঝিল্লী গঠনে সহায়তা করে।

৩. এনজাইম হিসেবে জীবদেহের ক্রিয়া-বিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে তথা জীবদেহকে সচল রাখে।

৪. অ্যান্টিবডির গাঠনিক উপাদান হিসেবে দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টি করে এবং দেহকে রোগ মুক্ত রাখে।

আরও পড়ুন :- পুষ্টি কাকে বলে?

৫. জীবদেহের প্রয়োজনীয় হরমোন উৎপাদন করে।

৬. নিউক্লিয়াস এবং নিউক্লিক অ্যাসিডকে হিস্টোন প্রোটিন কার্যকর রাখে।

৭. কিছু প্রোটিন বিষাক্ত। এগুলো খেলে অনেক জীব মরে যায়। যেমন- সাপের বিষ এক প্রকার প্রোটিন। অনেক উদ্ভিদে বিষাক্ত প্রোটিন থাকে। ফলে এরা অনেক পশু-পাখির আক্রমণ থেকে রক্ষা পায়।

৯. হিমোগ্লোবিন প্রোটিন প্রাণী দেহের সমস্ত কোষে অক্সিজেন সঞ্চালন করে।

১০. মানবদেহের পেপটাইড থেকে এক প্রকার প্রোটিন উৎপাদিত হয়। এটি ডিফেনসিভ অ্যান্টিবডি হিসেবে কাজ করে।

১১. ইন্টারফেরন একটি কোষীয় প্রোটিন। দেহে ভাইরাস আক্রমণ করলে এটি স্বতঃস্ফুর্তভাবে তৈরি হয়। ধারণা করা হচ্ছে ইন্টারফেরন ক্যান্সার ও ভাইরাসজনিত রোগে ব্যবহার করা যাবে।

প্রোটিন কত প্রকার ও কি কি :-

ভৌত, রাসায়নিক গুণাবলি এবং দ্রবণীয়তার উপর নির্ভর করে প্রোটিনকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়। যথা-

ক) সরল প্রোটিন,

খ) যুগ্ম প্রোটিন এবং

গ) উৎপাদিত প্রোটিন।

ক) সরল প্রোটিন :-

যে সব প্রোটিনকে অ্যাসিড বা এনজাইম দ্বারা আর্দ্রবিশ্লেষণ করলে শুধুমাত্র অ্যামাইনো অ্যাসিড পাওয়া যায় তাদেরকে বলা হয় সরল প্রোটিন।

দ্রবণীয়তার উপর ভিত্তি করে এদেরকে সাত ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা-

১. অ্যালবিউমিন :

যে সকল সরল প্রোটিন পানিতে সহজে দ্রতীভূত হয় এবং ঘোলাটে দ্রবণ তৈরি করে তাদেরকে বলা হয় অ্যালবিউমিন।

আরও পড়ুন :- অপুষ্টি কাকে বলে?

এরা পানিতে এবং লঘু লবণ দ্রবণে দ্রবণীয়। তাপ দিলে এরা জমাট বাধে। বার্লি ও বিটা-অ্যামাইলোজ একটি অ্যালবিউমিন। ডিমের সাদা অংশে রক্তরসে ও দুধে অ্যালবিউমিন থাকে। অ্যালবিউমিন এর অপর নাম লিউকোসিন, ল্যাকটালবুমিন।

২. গ্লোবিউলিন :

গ্লোবিউলিন পানিতে সাধারণত অদ্রবণীয়, তবে লঘু লবণ দ্রবণে দ্রবণীয়। গ্লোবিউলিনও তাপে জমাট বাঁধে। বীজে এ ধরনের প্রোটিন বেশি পরিমাণে থাকে। এছাড়াও ডিমের কুসুম এবং রক্তরসে গ্লোবিউলিন থাকে।

৩. গ্লুটেলিন :

গ্লুটেলিন পানিতে অদ্রবণীয়, তবে লঘু অ্যাসিড বা লঘু ক্ষার দ্রবণে দ্রবণীয়। গ্লুটেলিন তাপে জমাট বাঁধে না।

শস্য দানায় এ জাতীয় প্রোটিন বেশি থাকে। গমের গ্লুটেলিন এবং চালের অরাইজেনিন গ্লুটেলিন প্রোটিনের উদাহরণ।

৪. প্রোলামিন :

যে সকল সরল প্রোটিন অ্যালকোহলে ( ৭০-৮০%) দ্রবীভূত হয় তাদেরকে বলা হয় প্রোলামিন।

প্রোলামিন তাপে জমাট বাঁধে না। হাইড্রোলাইসিস শেষে এরা বেশি পরিমাণে প্রোলিন ও অ্যামোনিয়া উৎপন্ন করে। ভুট্টার জেইন, গম ও রাইয়ের গ্লিয়াডিন এবং বার্লিন হর্ডিন ইত্যাদি প্রোলামিনের উদাহরণ।

৫. হিস্টোন :

এ জাতীয় প্রোটিন পানিতে দ্রবনীয়। এদের মধ্যে বেশি পরিমাণে ক্ষারীয় অ্যামাইনো অ্যাসিড যেমন আরজিনিন, লাইসিন থাকে। এরা তাপে জমাট বাঁধে না। এদেরকে নিউক্লিয়াসে এবং নিউক্লিক অ্যাসিডের সাথে বেশি দেখা যায়। যেমন- নিউক্লিয়োহিস্টোন।

৬. প্রোটামিন :

এরা সবচেয়ে ক্ষুদ্র প্রোটিন। প্রোটামিনগুলো পানিতে এবং অ্যামোনিয়াম হাইড্রোক্সাইড এ দ্রবর্ণীয়। যেমন কুপিন, স্যামিন। এতে ক্ষারীয় অ্যামাইনো অ্যাসিড যেমন- আরজিনিন বেশি থাকে। এদেরকে নিউক্লিয়াসে পাওয়া যায় এবং নিউক্লিক অ্যাসিডের সাথেও দেখা যায়। প্রোটামিনে কোন সালফার থাকে না এবং টাইরোসিন, ট্রিপ্টোফ্যানও থাকে না। এরা তাপে জমাট বাঁধে না।

৭. স্ক্লেরোপ্রোটিন :

এরা পানি এবং মৃদু লবণ দ্রবণে অদ্রবণীয়। প্রাণীদেহের হাড়, চুল, নখ, ত্বক, সংযোগ টিস্যুতে এ প্রোটিন বেশি থাকে। হাড়ে কোলাজিন, ইলাস্টিন এবং চুলে কেরাটিন থাকে।

খ) যুগ্ম প্রোটিন :-

যে সকল প্রোটিনের সাথে কোন অপ্রোটিন অংশ যেমন প্রোসথেটিক গ্রুপ যুক্ত থাকে তাকে যুগ্ম প্রোটিন বলা হয়। এর অপর নাম কনজুগেটেড প্রোটিন। একে প্রোসথেটিক গ্রুপের প্রকৃতিভেদে ছয় ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা

আরও পড়ুন:- কার্বোহাইড্রেট কাকে বলে?

১. নিউক্লিয়োপ্রোটিন :

প্রোটামিন ও হিস্টোন জাতীয় ক্ষারীয় প্রোটিনের সাথে নিউক্লিক অ্যাসিড যুক্ত হয়ে তৈরি হয় নিউক্লিয়োপ্রোটিন।

যেমন- নিউক্লিয়োপ্রোটামিন ও নিউক্লিয়োহিস্টোন। নিউক্লিয়োপ্রোটিন পানিতে দ্রবণীয়। এক্ষেত্রে নিউক্লিক অ্যাসিড প্রসথেটিক গ্রুপ। যেমন- নিউক্লিয়োপ্রোটামিন ও নিউক্লিয়োহিস্টোন।

২. লিপোপ্রোটিন :

লিপোপ্রোটিনে সরল প্রোটিন ও বিভিন্ন প্রকার লিপিড তথ্য ফ্যাটি অ্যাসিড, কোলেস্টেরল, ফসফোলিপিড যুক্ত থাকে। এক্ষেত্রে ফ্যাটি অ্যাসিড, কোলেস্টেরল, ফসফোলিপিড প্রোসথেটিক গ্রুপ। বিভিন্ন ঝিল্লীর গাঠনিক উপাদান হিসেবে লিপোপ্রোটিন পাওয়া যায়। ডিমের কুসুম, দুধ ও কোষের বিভিন্ন ধরনের বিল্লীতে লিপোপ্রোটিন পাওয়া যায়।

৩. গ্লাইকোপ্রোটিন :

গ্লাইকোপ্রোটিনে সরল প্রোটিনের সাথে প্রোসথেটিক গ্রুপ হিসেবে কার্বোহাইড্রেট যুক্ত থাকে। তার মানে সরল প্রোটিন ও শর্করা যুক্ত হয়ে গ্লাইকোপ্রোটিন হয়।

যেমন- গ্লুকোস্যামাইন (Glucosamine), গ্যালাকটোস্যামাইন (Galactosamine)। কোষের ঝিল্পীর বা কোষ মেমব্রেনে বিশেষত মিউকাস মেমব্রেনে গ্লাইকোপ্রোটিন পাওয়া যায়, তাই একে মিউকোপ্রোটিন বলা হয়।

৪. ক্রোমোপ্রোটিন :

ক্রোমোপ্রোটিনে সরল প্রোটিনের সাথে প্রোসথেটিক গ্রুপ হিসেবে রঞ্জক পদার্থ যুক্ত থাকে। যথা ফাইকোবিলিন, ইহা নীলাভ সবুজ শৈবাল ও লাল শৈবালে থাকে। সরল প্রোটিন ও রাইবোফ্ল্যাভিন মিলে ফ্ল্যাভোপ্রোটিন তৈরি হয়। ক্রোমোপ্রোটিন উদ্ভিদের ফুল ও ফলের রং সৃষ্টিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।

৫. ফসফোপ্রোটিন :

ফসফোপ্রোটিনে সরল প্রোটিনের সাথে প্রোসথেটিক গ্রুপ হিসেবে ফসফোরিক অ্যাসিড যুক্ত থাকে। যেমন- দুধে উপস্থিত ক্যাসিনোজেন বা দুগ্ধ প্রোটিন, ডিমের কুসুমের ভাইটেলিন (Vitelline) ইত্যাদি।

৬. মেটালোপ্রোটিন :

মেটালোপ্রোটিনের প্রোসথেটিক গ্রুপটি লৌহ, দস্তা, তামা, কোবাল্ট, ম্যাঙ্গানিজ, ম্যাগনেসিয়াম প্রভৃতি ধাতুর আয়ন। এরা প্রধানত এনজাইমের অ্যাকটিভেটর।

গ) উৎপাদিত প্রোটিন :-

এসব প্রোটিন প্রকৃতিতে মুক্ত অবস্থায় থাকে না। তাপের প্রভাবে এনজাইমের বা রাসায়নিক পদার্থের ক্রিয়া-বিক্রিয়ায় অথবা কৃত্রিম উপায়ে প্রোটিন অণু থেকে তৈরি হয়। যেমন- পেপটাইড, প্রোটিয়েজ ইত্যাদি।

আরও পড়ুন:- লিপিড কাকে বলে?

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ