কোষ বিভাজন কাকে বলে? মাইটোসিস কোষ বিভাজন কাকে বলে?

এই পোস্টে আমরা কোষ বিভাজন কাকে বলে (kosh bivajon kake bole)? তা আলোচনা করবো এবং সেই সঙ্গে মাইটোসিস কোষ বিভাজন কাকে বলে? তা বিস্তারিত জানার চেষ্টা করবো।

বিভাজনের মাধ্যমে সংখ্যাবৃদ্ধি কোষের একটি স্বাভাবিক এবং অতি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। এককোষী জীব যেমন- ব্যাকটেরিয়া, ঈষ্ট, শৈবাল প্রভৃতি বার বার বিভাজনের মাধ্যমে একটি থেকে অসংখ্য এককোষী জীবে পরিণত হয়। বিশালদেহী একটি বটগাছের সূচনাও কিন্তু একটি মাত্র কোষ জাইগোট হতে।

Rudolf Virchow যথার্থই বলেছেন, গাছ থেকে যেমন গাছের সৃষ্টি হয়, প্রাণী থেকে সৃষ্টি হয় প্রাণীর, তেমন কোষ থেকে কেবল কোষেরই সৃষ্টি হতে পারে। এককোষী নিষিক্ত ডিম্বক হতে কোষ বিভাজন প্রক্রিয়ায় একটি পরিণত মানুষের সৃষ্টি হয়।

কোষ বিভাজন কাকে বলে :-

কোষ বিভাজন একটি মৌলিক ও অত্যাবশ্যকীয় প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে জীবের দৈহিক বৃদ্ধি ও বংশ বৃদ্ধি ঘটে। যে প্রক্রিয়ায় একটি কোষ বিভাজিত হয়ে একাধিক কোষের সৃষ্টি করে তাকে কোষ বিভাজন বলা হয়।

যে কোষটি বিভাজিত হয় তাকে মাতৃকোষ এবং বিভাজনের ফলে যে নতুন কোষ উৎপন্ন হয়, তাকে অপত্য কোষ বলা হয়।

আরও পড়ুন :- কোষ ঝিল্লি কাকে বলে?

Walter Fleming (১৮৮২) খ্রিস্টাব্দে সামুদ্রিক সালামান্ডার কোষে প্রথম কোষ বিভাজন প্রত্যক্ষ করেন। সাধারণত কোষের প্রধান দুটি অংশ থাকে। যেমন- নিউক্লিয়াস এবং সাইটোপ্লাজম। কোষ বিভাজন প্রক্রিয়ায় নিউক্লিয়াস এবং সাইটোপ্লাজম উভয়েই বিভাজিত হয়। কোষ বিভাজনে কোষের নিউক্লিয়াসের বিভাজনকে বলা হয় ক্যারিওকাইনেসিস এবং সাইটোপ্লাজমের বিভাজনকে বলা হয় সাইটোকাইনেসিস।

কোষ বিভাজন কত প্রকার ও কি কি :-

জীবজগতে তিন প্রকারের কোষ বিভাজন দেখা যায়। যথা- 

১. অ্যামাইটোসিস বা প্রত্যক্ষ কোষ বিভাজন (amitosis),

২. মাইটোসিস বা সমীকরণিক কোষ বিভাজন (mitosis) এবং

৩. মায়োসিস বা হ্রাসমূলক কোষ বিভাজন (meiosis)।
কোষ বিভাজন কাকে বলে

অ্যামাইটোসিস কোষ বিভাজন কাকে বলে :-

যে কোষ বিভাজন প্রক্রিয়ায় একটি মাতৃকোষের নিউক্লিয়াস এবং সাইটোপ্লাজম উভয়েই সরাসরি বিভক্ত হয়ে দুটি অপত্য কোষের সৃষ্টি করে, তাকে অ্যামাইটোসিস বা প্রত্যক্ষ কোষ বিভাজন বলা হয়।

এ প্রকার কোষ বিভাজন ব্যাকটেরিয়া, প্রোটোজোয়া (যেমন- অ্যামিবা), ঈষ্ট প্রভৃতি এককোষী জীবদেহে ঘটে।

মাইটোসিস কোষ বিভাজন কাকে বলে :-

যে কোষ বিভাজন প্রক্রিয়ায় একটি প্রকৃতকোষের নিউক্লিয়াস এবং ক্রোমোসোম উভয়ই একবার করে বিভক্ত হয় তাকে মাইটোসিস কোষ বিভাজন বলা হয়।

একে অন্যভাবেও বলা যায়- যে কোষ বিভাজনে একটি দেহকোষের নিউক্লিয়াস বিভাজিত হয়ে সমআকৃতি এবং সমগুণ সম্পন্ন দুটি অপত্য নিউক্লিয়াস সৃষ্টির মাধ্যমে দুটি অপত্য কোষ সৃষ্টি করে তাকে মাইটোসিস কোষ বিভাজন বলা হয়।

আরও পড়ুন :- ক্রসিং ওভার  কি?

শ্লাইখার ১৮৭৯ সালে লক্ষ্য করেন, একটি দেহ কোষীয় নিউক্লিয়াস বিভক্ত হয়ে দুটি অনুরূপ নিউক্লিয়াসে পরিণত হয় এবং তিনি এর নাম দেন ক্যারিওকাইনেসিস। পরবর্তীতে ওয়াল্টার ফ্লেমিং (১৮৮২) এ প্রকার বিভাজনকে মাইটোসিস নামে অভিহিত করেন।

মাইটোসিস কোষ বিভাজনে মাতৃকোষের প্রতিটি ক্রোমোসোম সেন্ট্রোমিয়ারসহ লম্বালম্বিভাবে সমান দুটি অংশে ভাগ হয় এবং প্রতিটি অংশ এর নিকটবর্তী মেরুতে গমন করে। ফলে নতুন কোষ দুটিতে ক্রোমোসোম সংখ্যা মাতৃকোষের ক্রোমোসোম সংখ্যার সমান থাকে। তাই মাইটোসিস কোষ বিভাজনকে সমীকরণিক বিভাজনও বলা হয়।

মাইটোসিস কোষ বিভাজনের বৈশিষ্ট্য :-

১. মাইটোসিস প্রতিকার প্রতিটি ক্রোমোসোম লম্বালম্বিভাবে দুটি ক্রোমাটিতে এবং শেষে দুটি অপত্য ক্রোমোসোমে বিভক্ত হয়।

২. প্রতিটি ক্রোমাটিড তার নিকটস্থ মেরুতে পৌঁছে দুটি অপত্য নিউক্লিয়াস সৃষ্টির মাধ্যমে দুটি অপত্য কোষে পরিণত হয়।

৩. অপত্য কোষগুলো মাতৃকোষের সমগুণসম্পন্ন হয়।

৪. অপত্য কোষের ক্রোমোসোম সংখ্যা মাতৃকোষের ক্রোমোসোম সংখ্যার সমান থাকে এবং

৫. অপত্য কোষগুলো বৃদ্ধি পেয়ে এক সময় মাতৃকোষের সমান আয়তনবিশিষ্ট হয়।

মাইটোসিসের গুরুত্ব বা তাৎপর্য :-

জীবদেহে মাইটোসিস কোষ বিভাজনের গুরুত্ব অনেক। নিচে এ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-

১. দৈহিক বৃদ্ধি : বহুকোষী জীব শুরু হয় এককোষী জাইগোট থেকে। মাইটোসিস বিভাজনের ফলে এককোষী জাইগোট প্রথমে বহুকোষী ভ্রণে পরিণত হয়। পরে ভ্রুণ থেকে একই প্রক্রিয়ায় পূর্ণাঙ্গ জীবের সৃষ্টি হয়।

২. বংশবৃদ্ধি : এককোষী (প্রকৃত কোষী, eukaryotic) জীব এ প্রক্রিয়ায় বংশবৃদ্ধি করে। (যেমন Chlamydomonas)

৩. ক্রোমোজোমের সমতা : এ প্রকার বিভাজনের ফলে মাতৃকোষের ডিপ্লয়েড (2n) ক্রোমোজোম সংখ্যা অপত্য কোষেও বর্তমান থাকে।

আরও পড়ুন :- কোষ কি?

৪. ক্ষতপুরণ : বহুকোষী জীবে সৃষ্ট কোন ক্ষতস্থান মাইটোসিস প্রক্রিয়ায় দ্রুত পুরণ হয়।

৫. জননাঙ্গ সৃষ্টি : এপ্রক্রিয়ায় বহুকোষী জীবের জননাঙ্গ সৃষ্টি হয়, যা বংশবৃদ্ধির ধারা বজায় রাখে।

৬. ক্রমাগত ক্ষয়পুরণ : মানবদেহের লোহিত কোষ ও কণিকার বাইরের কোষগুলি ক্রমাগত ক্ষয়হার হয় এবং মাইটোসিস প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট নতুন কোষ দ্বারা ক্ষয়পুরণ নিশ্চিত হয়।

৭. গুণগত স্থিতিশীলতা : এ প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন নতুন কোষের বৈশিষ্ট্য মাতৃকোষের হুবহু থাকে।

৮. নির্দিষ্ট আয়তন : এ বিভাজন প্রক্রিয়ার ফলে কোষের স্বাভাবিক আকার, আকৃতি ও আয়তন বজায় থাকে।

মাইটোসিস কোষ বিভাজন কোথায় ঘটে :-

প্রকৃত নিউক্লিয়াসযুক্ত উদ্ভিদ ও প্রাণীদের দৈহিক কোষে মাইটোসিস ঘটে থাকে। উদ্ভিদের বর্ধনশীল অংশ, যথা- উদ্ভিদের কান্ড বা শাখা প্রশাখার শীর্ষ, মূলের অগ্রভাগ, ভ্রূণমুকুল, ভ্রূণমূল, পুষ্পমুকুল, অগ্রমুকুল, বর্ধনশীল পত্র, ক্যাম্বিয়াম ইত্যাদি ভাজক টিস্যুর কোষ এ প্রক্রিয়ায় বিভাজিত হয়। জীবদেহের সকল অঙ্গ-প্রতঙ্গ মাইটোসিস প্রক্রিয়ারই ফল। জননাঙ্গের গঠন ও বৃদ্ধিও মাইটোসিস প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই হয়ে থাকে।

মাইটোসিস পদ্ধতি :-

মাইটোসিস বলতে সমগ্র কোষের বিভাজনকে বুঝালেও প্রকৃতপক্ষে মাইটোসিস বলতে নিউক্লিয়াসের বিভাজন বা ক্যারিওকাইনেসিসকে বুঝায়।

মাইটোসিস একটি পর্যায়ক্রমিক ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। প্রক্রিয়াটি শুরুর আগেই নিউক্লিয়াসকে কিছু প্রস্তুতিমূলক কাজ সম্পন্ন করতে হয়। এ অবস্থাকে ইন্টারফেজ (interphase) বলে।

মাইটোসিসের বিভিন্ন পর্যায়সমূহ :-

কোষবিভাজন একটি অবিচ্ছিন্ন বা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। বর্ণনার সুবিধার্থে মাইটোসিস প্রক্রিয়াকে পাঁচটি পর্যায়ে বিভক্ত করা হয়। যথা

১. প্রোফেজ বা আদ্যপর্যায়

২. প্রোমেটাফেজ বা প্রাক-মধ্যপর্যায়

৩. মেটাফেজ বা মধ্যপর্যায়

৪. অ্যানাফেজ বা গতিপর্যায় এবং

৫. টেলোফেজ বা শেষ পর্যায়

মায়োসিস কাকে বলে :-

যে কোষ বিভাজন প্রক্রিয়ায় ক্রোমোজোমসমূহ একবার এবং নিউক্লিয়াস দুবার বিভক্ত হয়, ফলে সৃষ্ট চারটি কোষে ক্রোমোজোম সংখ্যা (n) মাতৃকোষের ক্রোমোজোম (2n) সংখ্যার অর্ধেক হয়ে যায়, তাকে মায়োসিস বলে।

মায়োসিস বা হ্রাসমূলক বিভাজন সৃষ্টি :-

মায়োসিস একটি বিশেষ ধরণের কোষ বিভাজন, যার মাধ্যমে জনন মাতৃকোষ হতে জননকোষ উৎপন্ন হয়। গ্রীক শব্দ "meioun" (হ্রাস করা) হতে "meiosis" শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে। স্ট্রাসবুর্গার ( Strashburger) ১৮৮৩ সালে সর্বপ্রথম মায়োসিস প্রক্রিয়া আবিষ্কার করেন। এটি আবিষ্কৃত হবার বহু বছর পর ফার্মার (J. B. Farmer) ও মুর (JE. Moore) ১৯০৫ সালে একে মায়োসিস নাম দেন।

মায়োসিস কোথায় হয় :-

মায়োসিস সর্বদা যৌন জননকারী জীবের জনন মাতৃকোষে তথ্য মায়োসাইটে (meiocyte ) সম্পন্ন হয়। দৈহিক কোষে কখনও মায়োসিস ঘটে না, সর্বদাই ডিপ্লয়েড (2n) সংখ্যক ক্রোমোজোম বিশিষ্ট কোষে হয়।

নিম্নশ্রেণীর উদ্ভিদে হ্যাপ্লয়েড উদ্ভিদে, (n)) মায়োসিস ঘটে নিষেকের পর জাইগোটে। উচ্চ শ্রেণীর উদ্ভিদে (ডিপ্লয়েড উদ্ভিদে (2nn)] মায়োসিস ঘটে নিষেক ক্রিয়ার পূর্বে অর্থাৎ গ্যামেট সৃষ্টির সময়।

আরও পড়ুন:- জেনেটিক কোড কি?

মায়োসিসের বৈশিষ্ট্য :-

১. মায়োসিস সাধারণত ডিপ্লয়েড জীবের জনন মাতৃকোষে এবং হ্যাপ্লয়েড জীবে নিষেকের পর জাইগোটে ঘটে থাকে।

২. এ বিভাজনে ক্রোমোজোম মাত্র একবার কিন্তু নিউক্লিয়াস দুবার বিভক্ত হয়।

৩. মায়োসিস বিভাজনকে মায়োসিস- ১ ও মায়োসিস- ২ দুটি পর্বে ভাগ করা হয়।

৪. মায়োসিস- ১ এর প্রফেজ-১ দীর্ঘস্থায়ী বিধায়, একে পাঁচটি উপ-পর্যায়ে ভাগ করা হয়।

৫. এক্ষেত্রে হোমোলোগাস ক্রোমোজোম জোড়া বেঁধে বাইভেলেন্ট সৃষ্টি করে।

৬. দুটি নন-সিস্টার ক্রোমাটিডের মধ্যে ক্রসিং ওভারের ফলে কায়েজমা সৃষ্টি হয়। ফলে হোমোলোগাস ক্রোমোসোমের মধ্যে 'জিন' বিনিময় ঘটে।

৭. একটি ডিপ্লয়েড (2n) কোষ থেকে চারটি হ্যাপ্লয়েড (n) কোষ উৎপন্ন হয়।

৮. কোষের দুমেরুতে ক্রোমোজোমের সম বিন্যাস ঘটে।

৯. ক্রসিং ওভার ও ক্রোমোজোমের স্বতন্ত্র বিন্যাসের জন্য উৎপন্ন কোষগুলিতে মাতৃকোষের একই বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। না। জেনেটিক্সে নতুন সদস্য বা প্রকরণ উৎপত্তিতে এটি তাৎপর্যপূর্ন।

মায়োসিসের গুরুত্ব বা তাৎপর্য :-

জীবজগতে মায়োসিসের গুরুত্ব অপরিসীম। নিচে এসম্পর্কে আলোচনা করা হলো-

১. ক্রোমোজোম সংখ্যা হ্রাস :

যৌন জননকারী জীবে মায়োসিস বিভাজন গুরুত্বপূর্ণ। এ বিভাজনের ফলে জননকোষ তথা গ্যামেটে ক্রোমোজোম হ্রাস পেয়ে n সংখ্যক হয়। মায়োসিস না ঘটলে জীবের ক্রোমোজোম সংখ্যা দ্বিগুণ (2n), চারগুন (4n), আটগুন (8n) ইত্যাদি গুণিতকে বৃদ্ধি পেত। ফলে জীব জগতে একটি বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে যেত।

২. প্রজাতির স্বকীয়তা বজায় :

ক্রোমোজোম সংখ্যা সঠিক রাখার ফলে বংশানুক্রমে প্রতিটি প্রজাতির স্বকীয়তা রক্ষিত হচ্ছে।

৩. বৈচিত্র্যের সৃষ্টি :

যৌন জনন সম্পন্ন দুটি জীব কখনও হুবহু একই রকম হয় না। মায়োসিস প্রক্রিয়ায় গ্যামেট সৃষ্টিকালে ক্রোমোজোমের ক্রসিং ওভার ও স্বাধীনভাবে বিন্যস্ত হবার ফলে পৃথিবীতে এ বৈচিত্র্যের সৃষ্টি হয়েছে।

৪. বংশবৃদ্ধি :

ডিপ্লয়েড জীবে মায়োসিস প্রক্রিয়ায় গ্যামেট সৃষ্টি হয়। পরে গ্যামেটের মিলনে যৌন জনন প্রক্রিয়ায় জীবের বংশবৃদ্ধি ঘটে।

৫. অভিব্যক্তি ধারা :

মায়োসিসের মাধ্যমে জীবে বৈচিত্র্যের সৃষ্টি হয়। আর এ বৈচিত্র্য থেকে অভিব্যক্তির ধারা বজায় থাকে।

৬. মায়োসিস প্রক্রিয়ার কারণে পৃথিবীতে একটি মানুষ অন্য মানুষ থেকে আলাদা।

৭. মায়োসিসের মাধ্যমে পিতা ও মাতার গুণাবলী মিশ্রনের সুযোগ থাকে।

আরও পড়ুন:- DNA কাকে বলে? 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ