শারীরিক শিক্ষা কাকে বলে? শারীরিক শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য গুলি কি কি?

শারীরিক শিক্ষা কাকে বলে :- 

শারীরিক শিক্ষা সম্পর্কে জানতে হলে প্রথমে শিক্ষা সম্পর্কে ধারণা থাকা প্রয়োজন। শিক্ষা মানবজীবনের মৌলিক চাহিদাগুলোর অন্যতম একটি দিক। জন্মের পর থেকে মানুষ নানারকম শিক্ষার মাধ্যমে নিজেকে উপলব্ধি করে এবং উপযুক্ত হয়ে গড়ে উঠতে চায়। শিক্ষা মানুষকে মহান করে এবং মানবিক গুণাবলি অর্জনের মাধ্যমে মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটায়।

শিক্ষা অর্জনের জন্য কোনো সময় নির্ধারিত নেই। মানব জীবনে শিক্ষার ক্ষেত্র বিশাল এবং ব্যাপক। সুতরাং বলা যায় শিক্ষা জীবনব্যাপী একটি প্রক্রিয়া। শিক্ষা শুধুমাত্র প্রতিষ্ঠানের চৌহদ্দির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, শিক্ষা অর্জিত হয় বাড়িতে, পরিবারে সমাজে, বহিরাঙ্গন তথা খেলার মাঠে এবং সর্বত্র।

প্রাচীনকালে শারীরিক শিক্ষা কাকে বলে তা বলতে শুধুমাত্র দৈহিক বা শারীরিক উন্নতিকেই বোঝানো হতো। এ ধারণা সঠিক ছিল না। দৈহিক বা শারীরিক উন্নতিকে শারীরিক শিক্ষা নয়, শরীরচর্চা বলে।

মন ছাড়া শরীর এককভাবে কোনো কাজ করতে পারে না। অতএব, যে শিক্ষা দেহ ও মনের যুগপৎ পরিবর্তন সাধন করে সে শিক্ষাকেই শারীরিক শিক্ষা বলে।

শারীরিক শিক্ষার ব্যবহারিক দিক হচ্ছে খেলাধুলা। শারীরিক শিক্ষা সাধারণ শিক্ষা থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো বিষয় নয়। বস্তুত, মানুষ শারীরিক শিক্ষার মাধ্যমে সুস্বাস্থ্য অর্জন, সুন্দর মন ও পরিমিত আবেগ লাভ এবং সামাজিক কর্তব্য সচেতন হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে থাকে।

শারীরিক শিক্ষার সংজ্ঞা :-

শারীরিক শিক্ষা কাকে বলে এ সম্পর্কে সি.এ বুচার (C.A. Bucher) বলেছেন- 'শারীরিক শিক্ষা হলো শিক্ষার অবিচ্ছেদ্য অংশ, শারীরিক শিক্ষা সুনির্বাচিত শারীরিক কাজকর্মের মাধ্যমে শারীরিক, মানসিক, আবেগিক এবং সামাজিক দিক দিয়ে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে পৌঁছানোর চেষ্টা।

ডি.কে. ম্যাথস (D.K. Mathews ) বলেছেন- 'শারীরিক কার্যকলাপের দ্বারা অর্জিত শিক্ষাই শারীরিক শিক্ষা। বেসিক ও সিডেল (Resick and Seidel) বলেছেন- শারীরিক শিক্ষা হলো মানব গতিকার্যের বিজ্ঞান ও কলা।

জে.বি ন্যাশ (J. B. Nash) এর ভাষায় শারীরিক শিক্ষা কাকে বলে? তা হলো- 'শারীরিক শিক্ষা গোটা শিক্ষার এমন এক দিক যা মাংসপেশির সঠিক সঞ্চালন ও এর প্রতিক্রিয়ার ফল হিসেবে ব্যক্তির দেহের ও স্বভাবের পরিবর্তন ও পরিবর্ধন সাধন করে।"

শারীরিক শিক্ষার উদ্দেশ্য :-

লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে আমরা অনেক সময় একই অর্থে ব্যবহার করে থাকি। কিন্তু এদের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। লক্ষ্য হলো চূড়ান্ত গন্তব্যস্থল আর উদ্দেশ্য হলো সেই গন্তব্যস্থলে পৌঁছানোর সংক্ষিপ্ত ও নির্দিষ্ট কর্মকান্ড।

আরও পড়ুন :- মানষিক অবসাদ কাকে বলে?

যেমন কোনো শিক্ষার্থীর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার ক্ষেত্রে ভর্তি হতে পারা হলো লক্ষ্য, আর প্রথম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত প্রতিটি শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়াটা হলো উদ্দেশ্য। লক্ষ্যের অস্তিত্ব মানুষের কল্পনায়, কিন্তু উদ্দেশ্য হলো বাস্তব।

অধিকাংশ বিশেষজ্ঞের মতামত থেকে শারীরিক শিক্ষার উদ্দেশ্যগুলো চিহ্নিত করা সম্ভব। বিভিন্ন চিন্তাবিদদের মতামত বিবেচনা করে শারীরিক শিক্ষার উদ্দেশ্যকে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা

১. শারীরিক সুস্থতা অর্জন।

২. মানসিক বিকাশ সাধন।

৩. চারিত্রিক গুণাবলি অর্জন।

৪. সামাজিক গুণাবলি অর্জন।
শারীরিক শিক্ষা কাকে বলে

১. শারীরিক সুস্থতা অর্জন :-

ক. সুস্বাস্থ্য গঠনে আগ্রহী করে তোলা।

খ. স্নায়ু ও মাংসপেশির সমন্বয় সাধনমূলক কর্মকান্ড দ্বারা কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করা।

গ. দেহ ও মনের সুষম উন্নতি সাধন করা।

ঘ. কঠোর পরিশ্রম ও অনুশীলনের মাধ্যমে কাঙ্খিত ফল লাভ করা।

ঙ. নিয়মকানুন মেনে ভালো করে খেলতে পারা।

চ. শারীরিক নিরাপত্তা বিধানের জন্য প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জন করা।

ছ. দক্ষতার সাথে অঙ্গ সঞ্চালন ও নিয়ন্ত্রণের কলাকৌশল রপ্ত করা।

আরও পড়ুন :- মানসিক স্বাস্থ্য কাকে বলে?

২. মানসিক বিকাশ সাধন :-

ক. পর্যবেক্ষণ ও বিচার ক্ষমতার উন্মেষ ঘটানো।

খ. কল্পনা ও সৃজন শক্তির বিকাশ সাধন।

গ. নীতি ও নৈতিকতা সম্পর্কে জ্ঞানার্জন।

ঘ. সেবা ও আত্মত্যাগে উদ্ধুদ্ধ হওয়া।

ঙ. বিভিন্ন দলের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ও প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব তৈরি করা।

চ. সহিষ্ণুতা ও আত্মবিশ্বাস অর্জন করা।

৩. চারিত্রিক গুণাবলি অর্জন :-

ক. শৃঙ্খলা, দায়িত্ববোধ ও দেশাত্মবোধ জাগ্রত করা।

খ. আনুগত্যবোধ ও নৈতিকতা বৃদ্ধি পাওয়া।

গ. খেলোয়াড়ি ও বন্ধুত্বসুলভ মনোভাব গড়ে ওঠা।

ঘ. জাতিয় ঐতিহ্য ও কৃষ্টির প্রতি মমত্ববোধ জাগানো।

ঙ. খেলাধুলার মাধ্যমে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া।

চ. আত্মসংযমী হওয়া ও আবেগ নিয়ন্ত্রণে সক্ষমতা অর্জন করা।

ছ. প্রতিদ্বন্দ্বীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের মনোভাব গড়ে ওঠা।

৪. সামাজিক গুণাবলি অর্জন :-

ক. খেলাধুলার মাধ্যমে বিশ্রাম ও আনন্দ উপভোগে উৎসাহিত করা।

খ. নেতৃত্বদানের যোগ্যতা অর্জন করা।

গ. সকলের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ ও সেবামূলক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করা।

ঘ. বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের যোগ্যতা অর্জন করা।

ঙ. বিনোদনমূলক কর্মকান্ডের মাধ্যমে অবসর সময় কাটানোর উপায় জানা।

আরও পড়ুন :- অপুষ্টি কাকে বলে?

শারীরিক শিক্ষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা :-

মানবসত্তার দুটি মূল দিক হলো শরীর ও মন। এই দুটির সর্বোচ্চ ও সুষম উন্নয়ন ঘটে শারীরিক শিক্ষার মাধ্যমে। আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা শিক্ষার্থীর দৈহিক ও মানসিক বিকাশের উপর সমভাবে গুরুত্ব আরোপ করেছে।  শারীরিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা বর্ণনা করা হলো:

১. শারীরিক সুস্থতা রক্ষা ও দেহের সুষম বৃদ্ধি :

আমাদের দেহ অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যেমন- হৃদপিণ্ড, ফুসফুস, পাকস্থলী, যকৃত কিডনি, ক্ষুদ্রান্ত্র, বৃহদান্ত, অগ্নাশয়

ইত্যাদি নিয়ে গঠিত। এছাড়াও রয়েছে হাড়, মাংসপেশি, শিরা ও ধমনী। মাংসপেশির প্রধান কাজ হচ্ছে শরীর নড়াচড়া ও গতি প্রদান করা। গতি হলো প্রাণের ভিত্তি। নিয়মিত ব্যায়াম ও খেলাধুলায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে দৈহিক তন্ত্রসমূহের সুস্থতা বৃদ্ধি ও কর্মক্ষমতা বজায় থাকে। পেশিসমূহ শক্তিশালী হয়ে ওঠে।

ফলে শিক্ষার্থীরা অধিকতর শক্তি, দম ও উৎসাহের সাথে প্রাত্যহিক সমস্ত কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পারে। দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সঠিক বৃদ্ধির জন্য সুষম আহার, সঠিক স্বাস্থ্যবিধি পালন, বিশ্রাম ও নিদ্রা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করে সুস্থতার সাথে জীবনযাপন করা যায়। শারীরিক শিক্ষার মাধ্যমেই কেবলমাত্র তা সম্ভব হয়।

২. মানসিক উন্নতি :

স্বাস্থ্য ভালো না থাকলে মন ভালো থাকে না। মন ভালো না থাকলে কোন কাজে আগ্রহ জন্মায় না। মানবদেহের সার্বিক উন্নতির জন্য শরীর ও মন উভয়ই যেমন ভালো থাকা দরকার, তেমনি উভয়ের সুষম উন্নতিও প্রয়োজন।

শারীরিক শিক্ষা তথা খেলাধুলার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর মানসিক জড়তা, অশান্তি, একাকীত্ব ও পড়াশোনার একঘেয়েমি দূর হয়ে যায়; পরিবেশের সাথে মানিয়ে চলার মানসিকতা, আত্মসচেতনতা, আত্মনির্ভরতা এবং আত্মপোলব্ধি বাড়িয়ে তোলে।

৩. আবেগ-অনুভূতির উন্নতি :

শারীরিক শিক্ষার ব্যবহারিক দিক তথা খেলাধুলার ক্ষেত্রে জয় বা কৃতকার্যতা সকলের মনে তৃপ্তি, উদাম ও বিপুল আনন্দ এনে দেয়। কোনো কোনো সময় আনন্দ উল্লাসে মেতে ওঠে। আবার পরাজয় বা ব্যর্থতা এনে দেয় হতাশা। কারণ, একজন শিক্ষার্থী জানে খেলাধুলায় জয় ও পরাজয় আছে। বিজয়ে অতি উল্লসিত হয়ে খেলোয়াড়রা দিশেহারা হয়ে যায় না। এমনিভাবে শিক্ষার্থী বিভিন্ন সময়ে খেলাধুলার ফলাফলের উপর ভিত্তি করে তার আবেগকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে শেখে। পরবর্তীতে পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে তার এই আবেগ নিয়ন্ত্রণের অভ্যাস কাজে লাগাতে পারে।

৪. সামাজিক উন্নতি :

শারীরিক শিক্ষা তথা খেলাধুলার মাধমে শিক্ষার্থীরা বহুবিধ সামাজিক গুণাবলি অর্জন করে থাকে। দলবদ্ধ হয়ে খেলাধুলা ও শারীরিক শিক্ষার কর্মসূচি পালনের সময় স্বীয় দলকে বিজয়ী করার জন্য সহযোগিতা, সমন্বয়, সহমর্মিতা, দলীয় একাত্মতা ও সদ্ভাব রক্ষা করে চলতে শেখে।

খেলাধুলার মাধ্যমে নেতৃত্বদানের ক্ষমতার বিকাশ ঘটে। কারণ, খেলাধুলার সময় দলীয় নেতৃত্বের প্রয়োজন হয়। পরবর্তীকালে সমাজ জীবনের বিভিন্ন পরিস্থিতিতে অন্যদের সাথে চলাফেরা, ওঠাবসা, আচার আচরণে এবং সামাজিক কোনো কর্মকান্ডে এই গুণগুলো প্রতিফলিত হয়। এছাড়াও শারীরিক শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর মাঝে দেশপ্রেম, জাতীয় চেতনাবোধ, দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ জাগ্রত হয়।

৫. নৈতিক উন্নতি :

শারীরিক শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা বহুবিধ কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করে শৃংঙ্খলা এবং বিভিন্ন নিয়মকানুন মেনে চলতে শেখে। ফলে শিক্ষার্থী মিথ্যার আশ্রয় নিতে পারে না। ন্যায় ও অন্যায় বিচার করে সে কাজ করতে অভ্যস্ত হয়। শিক্ষক ও বড়দের কথা মেনে চলে। নিয়ম মেনে খেলতে গিয়ে বিপক্ষ দলের সাথে খারাপ আচরণ করার সুযোগ থাকে না। এ অভ্যাসের কারণে অপরাধ প্রবণতা থেকে সরে গিয়ে শিক্ষার্থী উন্নত নৈতিক চরিত্রের অধিকারী হয়।

৬. অঙ্গ সঞ্চালন ও খেলাধুলার কলাকৌশল অর্জন :

শারীরিক শিক্ষার ক্লাসে শিক্ষার্থীদের সঠিকভাবে বসা, দাঁড়ানো, হাঁটা, দৌড়ানো, লাফানো এবং খেলাধুলার বিভিন্ন কলাকৌশল শেখানো হয়। খেলাধূলার পূর্বে ওয়ার্ম-আপ করা খুবই জরুরী। শরীরকে ব্যায়ামের মাধ্যমে নির্দিষ্ট খেলার জন্য শারীরিক ও মানসিকভাবে উপযুক্ত করার নাম ওয়ার্ম-আপ। এর ফলে অঙ্গ সঞ্চালনের সঠিক পদ্ধতি সম্পর্কে জানা যায়। খেলাধুলার কৌশল শেখার মাধ্যমে খেলাধুলায় পারদর্শিতা অর্জন করা সম্ভব হয়।

৭. সৃজনশীলতার উন্মেষ ঘটে :

খেলার সময়কালীন সহযোগী ও প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়দের অবস্থানের দ্রুত পরিবর্তন হয়। প্রতিযোগিতায় কাঙ্খিত ফল লাভের জন্য প্রত্যেক খেলোয়াড়কে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়।

খেলাধুলার মাধ্যমে অর্জিত এই অভ্যাসের ফলে তার সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বিকাশ লাভ করে।

৮. অবসর ও চিত্তবিনোদন :

শারীরিক শিক্ষার কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীরা দৈনন্দিন জীবনে বিভিন্ন প্রকারের ব্যায়াম ও খেলাধুলা করে অফুরন্ত আনন্দ লাভ করে। ফলে তারা প্রতিটি মুহূর্তকে সঠিকভাবে ব্যবহার এবং বিভিন্ন খেলাধুলার মাধ্যমে অবসর সময়গুলোকে আনন্দদায়ক করে তুলতে পারে।

খেলাধুলাবিহীন তরুণ সমাজ অবসর সময়ে বিভিন্নভাবে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। একমাত্র আনন্দময় খেলাধুলাই পারে এ অবস্থা থেকে তরুণ সমাজ তথা জাতিকে মুক্ত করতে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ