খনিজ তেল কাকে বলে? খনিজ তেলের ব্যবহার ও গুরুত্ব?

খনিজ তেল এক প্রকার তরল খনিজ পদার্থ। খনি থেকে যে তেল প্রথমে উত্তোলন করা হয় তার মধ্যে কার্বন, অঙ্গার, হাইড্রোজেন, গন্ধক ইত্যাদি রাসায়নিক পদার্থের মিশ্রন থাকে। এগুলি তরল কাঁদার ন্যায় থাকে, যার রং কালো বা ধূসর বর্ণের হয়ে থাকে। এ তরল কাদা জাতীয় আকরিক তৈলকে আধুনিক প্রক্রিয়ায় পরিশোধন করে বিভিন্ন প্রকার উপজাত সংগ্রহ করা হয়।

পরিশোধনের মাধ্যমে বিভিন্ন উপজাতগুলোর মধ্যে গ্যাস, নেপথা, পেট্রোল, ডিজেল, কেরোসিন, লুব্রিকেন্ট অয়েল প্যারাফিন, এ্যাসপ্যান্ট, গ্যাসোলিন, মোম ইত্যাদি প্রধান।


খনিজ তেল কাকে বলে :-

ভূ-গর্ভের বিভিন্ন শিলাস্তর থেকে উত্তোলিত তেলকে খনিজ তেল বা পেট্রোলিয়াম বলা হয়।

অনেকের অভিমত ভূ-গর্ভে নিমজ্জিত জলজ উদ্ভিদ এবং সামুদ্রিক জীবদেহের রাসায়নিক পরিবর্তনের ফলে তেলের উৎপত্তি হয়। উদ্ভিদ বা জীবদেহ হতে তেল জাতীয় খনিজ পদার্থ সৃষ্টি হবার সময় রাসায়নিক ক্রিয়ার সময় গ্যাসের সৃষ্টি হয়। তাই দেখা যায় যে বেশীর ভাগ তেল ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক গ্যাস থাকে।

সাধারনত: খনিতে প্রথম স্তরে গ্যাস, তারপর তেল এবং সর্বনিম্নে পানি থাকে। খনি থেকে পাইপের সাহায্যে তেল আহরিত হয়। খনিতে যে তেল পাওয়া যায় তা অপরিশোধিত অবস্থায় থাকে। একে আকরিক তেল বলে, যা পরে পরিশোধনের মাধ্যমে ব্যবহার উপযোগী করা হয়।
খনিজ তেল কাকে বলে

খনিজ তেলের ব্যবহার :-

খনিজ তৈল আমরা সরাসরি ব্যবহার করতে পারিনা। পরিশোধনের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রকার উপজাত দ্রব্য প্রস্তুত করে তা ব্যবহার করা হয়। নিম্নে খনিজ তৈল থেকে প্রস্ততকৃত বিভিন্ন ব্যবহার উপযোগী উপজাত বর্ণিত হলো।

১. গ্যাস :

আকরিক তৈল পরিশোধনের প্রাথমিক পর্যায়ে পেট্রোগ্যাস পাওয়া যায় যা গৃহস্থালির ব্যবহার ও আলো জ্বালাতে ব্যবহৃত হয়। এটি গ্যাসলিন তৈরীতেও ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়াও কার্বন, রাসায়নিক সার তৈরীর কাজে শিল্পে এ গ্যাস ব্যবহৃত হয়।

২. নেপথা :

খনিজ তেল পরিশোধনের দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রাপ্ত নেপথা শিল্প কারখানায় ব্যবহৃত হয়ে থাকে ।

আরও পড়ুন :- খনিজ কাকে বলে?

৩. পেট্রোল ও ডিজেল :

খনিজ তেলের প্রধান উপজাত হলো পেট্রোল ও ডিজেল যা বিভিন্ন ধরনের পরিবহন চালাতে, শিল্পের যন্ত্রপাতি চালাতে এবং তাপ বিদ্যুৎ উৎপাদনে বহুলভাবে ব্যবহৃত হয়।

৪. কেরোসিন :

কেরোসিন খনিজ তৈলের আর একটি অন্যতম প্রধান উপজাত যা আলো জ্বালাতে, ট্রাকটর পরিচালনা, রন্ধন কাজে ও কিটনাশক তৈরীতে ব্যবহৃত হয়।

৫. পিচ্ছিল তৈল :

এটি কলকারখানার যন্ত্রপাতি, রেল, স্টিমার, মোটরগাড়ী, বিমান পোত ইত্যাদির ইঞ্জিন পিচ্ছিল করার জন্য ব্যবহার করা হয়।

৬. পিচ বা এ্যাসফান্ট :

এটি রাস্তা তৈরী, দালান কোঠার ছাদের কার্পেটিং ও মেরামত করার জন্য ব্যবহৃত হয়।

৭. প্যারাফিন :

মোম ও বিভিন্ন প্রকার ঔষুধ তৈরীর কাজে এটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

৮. অন্যান্য উপজাত দ্রব্যাদি :

উপরে উল্লিখিত উপজাত ছাড়াও খনিজ তেল থেকে বিভিন্ন উপজাত যেমন- প্লাষ্টিক, বারনিশ, কিটনাশক ঔষুধ, রং, কালি, সাবান এবং নানা ধরনের সুগন্ধি প্রসাধনী দ্রব্যাদি প্রস্তুত করা হয়।

আরও পড়ুন :- কয়লা কাকে বলে?

খনিজ তৈলের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক গুরুত্ব :-

খনিজ তেল প্রাচীন কাল থেকে ব্যবহৃত হয়ে এলেও বিশেষ করে ১৮৫৭ সালের পর থেকে এর ব্যবহার ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে অতিতের কয়লা নির্ভর অর্থনীতি বর্তমানে খনিজ তেল নির্ভর হয়ে পড়েছে। নিম্নে খনিজ তেলের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা বর্ণনা করা হলো:

১. কৃষি ক্ষেত্রে :

আধুনিক কৃষি ব্যবস্থা যান্ত্রিক নির্ভর। আর কৃষিতে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতিগুলো পরিচালনা ও সংরক্ষনে পেট্রোল, ডিজেল, মোবিল, পিচ্ছিল তৈল, কেরসিন ইত্যাদির ব্যবহার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

২. শিল্প কারখানায় :


বর্তমানে প্রতিটি শিল্প কারখানায় প্রত্যক্ষ বা পরক্ষভাবে খনিজ তৈল ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বিভিন্ন প্রকার রাসায়নিক শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে খনিজ তেলের উপজাত ব্যবহৃত হয়।

যেমন পিচ, মোম, প্যারাফিন, বারনিশ, রং, কালি, ঔষুধ, প্রসাধনী, কৃত্রিম রাবার, কৃত্রিমবস্ত্র ও তন্ত্র, ফিল্ম, রাসায়নিক সার ইত্যাদি শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে খনিজ তৈলের উপজাত ব্যবহৃত হয়।

তাছাড়া শিল্পের যন্ত্রপাতি পরিচালনা ও রক্ষনা বেক্ষনে পিচ্ছিল তৈল, ডিজেল, পেট্রোল প্রভৃতি ধরনের তৈল ব্যবহৃত হয়।

৩. শক্তি উৎপাদনে :

আধুনিক সভ্যতার অন্যতম উপাদান খনিজ সম্পদ। আর খনিজ তেল শক্তি সম্পদ উৎপাদনের প্রধান উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বর্তমানে জল বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লার পরিবর্তে খনিজ তেল ব্যবহৃত হচ্ছে।

৪. পরিবহন ক্ষেত্রে :

বিভিন্ন ধরনের পরিবহন চালাতে পেট্রোল, ডিজেল, অকটেন, মোবিল ও গ্যাসলিন ব্যবহার করা হয়। তাছাড়াও সাবমেরিন, ড্রেজার, ট্যাংক ও জঙ্গি বিমান প্রভৃতি আধুনিক যুদ্ধযানগুলোতেও বিভিন্ন ধরনের ডিজেল, মৰিল, প্রেট্রোল ও গ্যাসলিন ব্যবহৃত হয়।

এ ছাড়াও যান বাহনের ইঞ্জিন ও কলকব্জা মরিচামুক্ত ও পিচ্ছিল করার জন্য পিচ্ছিল তেল ব্যবহার হয়। খনিজ তেল ব্যাতিত আধুনিক যুদ্ধ পরিচালনা করা যায় না বলে বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলো খনিজ তেল নিয়ন্ত্রনে সদা সচেষ্ট রয়েছে।

৫. ঔষুধ ও প্রসাধনী :

বিভিন্ন প্রকার ঔষুধ ও প্রসাধনী তৈরীতে খনিজ তেলের ব্যবহার দিন দিন বেড়ে চলেছে। উদাহরনস্বরূপ বলা যায় যেমন পারফিউম জাতীয় ঔষুধ তৈরীতে প্যারাফিন এবং লিপিষ্টিক, কোল্ডক্রীম, হ্যাজলিন, ভ্যাজলিন, স্নো, সুগন্ধি কেশ তৈল, সেন্ট ইত্যাদি তৈরীতেও খনিজতেলের উপজাত ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

৬. কীট নাশক :

কীট নাশক ঔষধ তৈরীতে খনিজ তেলের উপজাত ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

৭. গৃহ কাজের ক্ষেত্রে :

গ্রামের লোক রান্নার কাজে, বাতি জ্বালাতে, পাওয়ার পাম্প, চাউল ও আটার কল প্রভৃতি চালাতে কেরোসিন ও ডিজেল ব্যবহার করে থাকে।

তাই পরিশেষে বলা যায় যে, আধুনিক বিশ্বের সামাগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নে খনিজ তেলের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা খুব বেশী। কারন যুদ্ধ ও শক্তি উভয় ক্ষেত্রেই খনিজ তেল অপরিহার্য। তাছাড়াও রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও তেলের প্রভাব ও প্রয়োগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তাই অর্থনীতির পাশাপাশি রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও খনিজ তেলের গুরুত্ব অপরিসিম।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ