পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে রয়েছে নানান রকম মানুষ এবং মানুষের সাথে সম্পর্কিত প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশ। ভূগোল পরিবেশের সকল বিষয়কেই অন্তর্ভুক্ত করে। ভূগোলকে একদিকে এই প্রকৃতির বিজ্ঞান বলা হয়, অন্যদিকে তেমনি পরিবেশ ও সমাজের বিজ্ঞানও বলা হয়।
অধ্যাপক কার্ল রিটার (Professor Carl Ritter) ভূগোলকে বলেছেন পৃথিবীর বিজ্ঞান ।
ভূগোল শব্দের অর্থ :-
ইংরেজি 'Geography' শব্দটি থেকে ভূগোল শব্দটির উৎপত্তি। গ্রীক শব্দ 'Geo' শব্দের অর্থ 'ভূ' বা পৃথিবী এবং 'graphy' শব্দের অর্থ বর্ণনা সুতরাং Geography শব্দটির অর্থ পৃথিবীর বর্ণনা। 'Geography' শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন প্রাচীন গ্রিসের ভূগোলবিদ ইরাটসথেনিস (Eratosthenes)।ভূগোল কি বা কাকে বলে :-
ভূগোল হলো এমন একটি বিষয়/শাস্ত্র যেখানে স্থানীক ও কালীক পর্যায়ে মানুষ ও পরিবেশের মধ্যে সম্পর্ক ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করা হয়। সংক্ষেপে মানুষের বাসভূমি হিসাবে পৃথিবীর বর্ণনা হলো ভূগোল। এখন প্রশ্ন হলো ভূগোল কাকে বলে? কোনো কোনো ভূগোলবিদ ভূগোলকে বলেছেন পৃথিবীর বিবরণ, কেউ কেউ বলেছেন পৃথিবীর বিজ্ঞান ।অধ্যাপক কার্ল রিটার (Professor Carl Ritter) ভূগোলকে বলেছেন পৃথিবীর বিজ্ঞান ।
অধ্যাপক ডাডলি স্ট্যাম্প (Professor Dudley Stamp) ভূগোল কি এ সম্পর্কে আরও সহজভাবে বলেছেন, পৃথিবী ও এর অধিবাসীদের বর্ণনাই হলো ভূগোল ।
ভূগোল কাকে বলে এ সম্পর্কে অধ্যাপক রিচার্ড হার্টশোন (Professor Richard Hartshorne ) বলেন, পৃথিবী পৃষ্ঠের পরিবর্তনশীল বৈশিষ্ট্যের যথাযথ যুক্তিসংগত ও সুবিন্যন্ত বিবরণের সঙ্গে সংশিরি বিষয় হলো ভূগোল ।
আলেকজান্ডার ফন হামবোল্টের ( Alexander Von Humboldt) মতে, ভূগোল হলো প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত বিজ্ঞান।
প্রকৃতিতে যা কিছু আছে তার বর্ণনা ও আলোচনা এর অন্তর্ভুক্ত। পৃথিবীর জলবায়ু, ভূ-প্রকৃতি, উদ্ভিদ, প্রাণি, নদ-নদী, সাগর, খনি সম্পদ অর্থাৎ পৃথিবীর প্রাকৃতিক পরিবেশ, পৃথিবীতে বাসকৃত মানুষের জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করে। অপরদিকে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপও প্রাকৃতিক পরিবেশে বিভিন্ন রকম পরিবর্তন ঘটায়।
বনভূমি কেটে তৈরি হয় শহর, জলাশয় ভরাট হয়, অতিরিক্ত কলকারখানাও যানবাহনের কারণে বায়ু দূষণ হয়। বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয় যেমন, বন্যা, খরা, টর্নেডো, ভূমিকম্প, সুনামী ইত্যাদি সংঘটিত হয়। অর্থাৎ মানুষ ও পরিবেশের মধ্যে এক ধরনের মিথস্ক্রিয়ার সম্পর্ক রয়েছে। এই সম্পর্কটি মূলত কার্যকারণ সম্পর্ক।
ভূগোলের প্রধান কাজ কি?
ভূগোলের প্রধান কাজ হলো এই কার্যকারণ সম্পর্ক উদ্ঘাটন করা। মূলত সময় ও স্থানের আলোকে প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে মানুষের কর্মকান্ডের এই সম্পর্কই ভূগোলের মুখ্য বিষয়।
আরও পড়ুন :- খনিজ তেল কাকে বলে?
প্রাকৃতিক ভূগোলের প্রধান শাখাসমূহ হলো- ভূমিরূপ বিদ্যা, জলবায়ু বিদ্যা, সমুদ্র বিদ্যা, গাণিতিক ভূগোল এবং মানব ভূগোলের প্রধান শাখাসমূহ হলো অর্থনৈতিক ভূগোল, জনসংখ্যা ভূগোল, পরিবহণ ভূগোল, আঞ্চলিক ভূগোল, নগর ভূগোল প্রভৃতি।
এছাড়া মানুষের চিন্তা চেতনার বিকাশ, সামাজিক মূল্যবোধের পরিবর্তন এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশ ভূগোলের পরিধিকে অনেক বিস্তৃত করেছে। বর্তমানে বিভিন্ন বিষয়বস্তু যেমন- দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, প্রাণি ভূগোল, মৃত্তিকা ভূগোল এবং ভৌগোলিক তথ্য ব্যবস্থা (GIS) প্রভৃতি ভূগোলের পরিধিকে সমৃদ্ধ করেছে এবং ভবিষ্যতে ভূগোলের পরিধি আরো অধিক বিস্তৃত হবে।
১.১ ভূমিরূপবিদ্যা (Geomorphology) :
ভূমিরূপবিদ্যা পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ অবস্থা, পৃথিবীর উৎপত্তি, ভূ-আলোড়ন, বিভিন্ন প্রকার ভূমিরূপ, নদ-নদীর উৎপত্তি, ক্রমবিকাশ, ভূ-ত্বকের পরিবর্তন, খনিজ ও শিলা এবং পৃথিবীর উৎপত্তি সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করে।
আরও পড়ুন :- মানব ভূগোল কাকে বলে?
১.২ জলবায়ুবিদ্যা (Climatology) :
এ শাখায় বায়ুর গঠন, উপাদান, বায়ুর তাপ, চাপ, আর্দ্রতা, বায়ুপ্রবাহ, বায়ুপুঞ্জ, বায়ুপ্রাচীর, মেঘ, বৃষ্টি, কুয়াশা, আবহাওয়া ও জলবায়ু নিয়ে আলোচনা করে।
১.৩ সমুদ্রবিদ্যা (Oceanography) :
পৃথিবীর প্রায় তিন-চতুর্থাংশ সমুদ্র। এ শাখায় সাগর মহাসাগরের তলদেশের ভূমিরূপ, সমুদ্রস্রোত, মানব জীবনের উপর সমুদ্রস্রোতের প্রভাব, বিভিন্ন মহাদেশের মধ্যে সমুদ্র পথে যোগাযোগ প্রভৃতি বিষয় নিয়ে আলোচনা করে।
১.৪ মৃত্তিকা ভূগোল (Soil Geography) :
মৃত্তিকা ভূগোল অশ্মমণ্ডলের উপরিভাগের মৃত্তিকার গঠন, উপাদান, বণ্টন ও বিন্যাস সম্পর্কে আলোচনা করে।
১.৫ জীব ভূগোল (Biogeography) :
এ শাখা পৃথিবী পৃষ্ঠের প্রাণিজগৎ ও উদ্ভিদের বন্টন নিয়ে আলোচনা করে।
১.৬ গাণিতিক ভূগোল (Mathematical Geography) :
গাণিতিক ভূগোলে জ্যোতিষ্কমণ্ডলী, সৌরজগৎ, পৃথিবী ও এর আকৃতি, গতি, আন্তর্জাতিক তারিখ রেখা ও সময়, আহ্নিক গতি ও বার্ষিক গতির ফলাফল প্রভৃতি নিয়ে আলোচনা করা হয়।
২.১. অর্থনৈতিক ভূগোল ( Economic Geography) :
কৃষিকাজ, পশুপালন, বনজ সম্পদ, খনিজ সম্পদ, ব্যবসা বাণিজ্য ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ভূগোলের যে শাখায় অন্তর্ভুক্ত থাকে, তাকে অর্থনৈতিক ভূগোল বলে।
আরও পড়ুন:- ভূমিকম্প কাকে বলে?
২.২.জনসংখ্যা ভূগোল (Population Geography) :
জনসংখ্যার বিভিন্ন বিষয় যেমন লিঙ্গ, জন্মহার, মৃত্যুহার, বয়স কাঠামো, বৈবাহিক অবস্থা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কার্যকলাপের উপর জনসংখ্যার প্রভাব প্রভৃতি জনসংখ্যা বিষয়ক বিষয়াদি ভূগোলের যে শাখায় আলোচনা করা হয় তাকে জনসংখ্যা ভূগোল বলে।
২.৩.আঞ্চলিক ভূগোল (Regional Geography) :
আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য অনুসারে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের ভৌগোলিক বিষয়বস্তু অনুশীলন করা আঞ্চলিক ভূগোলের প্রধান বিষয়।
২.৪.রাজনৈতিক ভূগোল (Political Geography) :
রাজনৈতিক বিভাগ, পরিসীমা, বিবর্তন প্রভৃতি ভৌগোলিক বিষয় রাজনৈতিক ভূগোলের আলোচ্য বিষয়।
২.৫.পরিবহন ভূগোল (Transport Geography) :
পরিবহন ভূগোলে মানুষ ও পণ্যের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে স্থানান্তর এবং সরকারি-বেসরকারি সকল ধরনের পরিবহন ব্যবস্থা, সমস্যা ও এর সমাধান সম্পর্কে আলোচনা করে।
২.৬. নগর ভূগোল (Urban Geography) :
ভূগোলের যে শাখায় নগরের উৎপত্তি, বিকাশ, নগর ও শহরের শ্রেণিবিভাগ, নগর পরিবেশ, নগরের কেন্দ্রীয় এলাকা, নগর বস্তি, প্রভৃতি বিষয় নিয়ে আলোচনা করে তাকে নগর ভূগোল বলে।
২.৭.দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা (Disaster Management) :
বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগ ও দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হ্রাস, দুর্যোগ থেকে পরিবেশ ও সম্পদ রক্ষার কৌশল প্রভৃতি বিষয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার আলোচ্য বিষয়।
২.৮.ভৌগোলিক তথ্য ব্যবস্থাপনা ( Geographic Information System) :
ভৌগোলিক তথ্য ও উপাত্ত ব্যবহার করে যে প্রক্রিয়ায় ডাটা সংগ্রহ, সংরক্ষণ, বিশ্লেষণ এবং মানচিত্রের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয় তাকে বলা হয়, ভৌগোলিক তথ্য ব্যবস্থাপনা বা Geographic Information System (GIS)। এটি মূলত ভৌগোলিক তথ্য বিশ্লেষণের জন্য নির্মিত সফ্টওয়্যার।
অপরদিকে এই সকল বিষয়ের সাথে মানুষ কীভাবে খাপ খাওয়ায় এবং পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপন করে তারও বিস্তারিত জানা যায় ভূগোল ও পরিবেশ বিষয়টি পাঠের মাধ্যমে। নিম্নে ভূগোল ও পরিবেশ পাঠের গুরুত্ব বর্ণনা করা হলো।
• ভূগোল ও পরিবেশ বিষয়টি অধ্যয়নের মাধ্যমে পৃথিবীর জন্মলগ্ন থেকে কীভাবে জীবজগতের উদ্ভব হয়েছে এই বিষয়ক বিজ্ঞান সম্মত ধারণা পাওয়া যায়।
• পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ অবস্থা, ভূ-ত্বক, ভূ-আলোড়ন, বিভিন্ন প্রকার ভূমিরূপ, নদ-নদীর উৎপত্তি, ক্রমবিকাশ, খনিজ ও শিলার উৎপত্তি প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় ।
• পৃথিবীর যে কোনো স্থানের প্রকৃতি ও পরিবেশ সম্পর্কে জানা যায়।
• পাহাড়, পর্বত, সাগর, মালভূমি, সমভূমি, মরুভূমি প্রভৃতির উৎপত্তির কারণ ও বৈশিষ্ট্য জানা যায়।
• ভূ-পৃষ্ঠের পরিবর্তনের বিভিন্ন শক্তিসমূহ যেমন- ভূমিকম্প, আগ্নেয়গিরি, বিচূর্ণীভবন, নগ্নীভবন ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়।
• বায়ুমন্ডলের গভীরতা, বায়ুর স্তরবিন্যাস, বায়ুর উপাদান, তাপ, চাপ, আর্দ্রতা বায়ুপ্রবাহের কারণ, বৃষ্টিপাত, আবহাওয়া, জলবায়ু প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়। এই সকল বিষয় ভূগোলের জলবায়ুবিদ্যা নামক শাখায় আলোচনা করা হয়।
• পৃথিবীর মহাসাগরসমূহের অবস্থান, আকৃতি, তলদেশীয় ভূমিরূপ, জোয়ার-ভাটা, সমুদ্রস্রোত প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে জানা যায়।
• পৃথিবীর বিভিন্ন পরিবেশের উদ্ভিদ ও প্রাণি এবং এদের আচার-আচরণ, খাদ্যাভাস ও জীবন ধারার বৈচিত্র্য সম্পর্কে জানা যায়।
• কৃষি, শিল্প, ব্যবসা, বাণিজ্য, পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশের কী ধরনের পরিবর্তন হচ্ছে এবং পরিবর্তনের ধারা কীরূপ তা জানা যায়।
• প্রাকৃতিক ভূগোলের বিভিন্ন নিয়ামকের উপর নির্ভর করে প্রাকৃতিক দুর্যোগ সৃষ্টির কারণ এবং দুর্যোগ পূর্বাভাস নিরূপণ করা যায়। এছাড়া ক্ষয়ক্ষতি নিয়ন্ত্রণপূর্বক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সিস্টেম প্রণয়ন করা যেতে পারে।
• পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের ভূ-প্রকৃতি এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার গুরুত্ব অনুযায়ী ভূমি ব্যবস্থাপনার কৌশল প্রণয়ন করা যায়।
• পৃথিবীর প্রায় তিন-চতুর্থাংশ সমুদ্র। বিভিন্ন মহাদেশের মধ্যে সমুদ্র পথে যোগাযোগ, সমুদ্রপৃষ্ঠের উত্থান, অবনমন, সমুদ্রের পানির রাসায়নিক গুণাগুন ও লবণাক্ততা নির্ধারণ, সামুদ্রিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রভৃতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায় ।
• ভৌগোলিক তথ্য ব্যবস্থাপনা (GIS) সফটওয়্যারটি ব্যবহারের মাধ্যমে যে কোনো স্থানের তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহ করে সংগৃহীত তথ্য ও উপাত্ত বিশ্লেষণপূর্বক সংশিষ্ট স্থানের বিস্তারিত বিষয়াদি মানচিত্রের মাধ্যমে উপস্থাপন করা যায়।
• প্রাকৃতিক সম্পদকে কাজে লাগিয়ে মানুষের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করা যায়।
সুতরাং বলা যায়, ভূগোল ও পরিবেশ বিষয়টি পাঠের গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা এখানে মানুষ এবং মানুষের সাথে সম্পর্কিত প্রাকৃতিক, মানবিক এবং সামাজিক পরিবেশের সকল বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়।
ভূগোল কাকে বলে এ সম্পর্কে অধ্যাপক রিচার্ড হার্টশোন (Professor Richard Hartshorne ) বলেন, পৃথিবী পৃষ্ঠের পরিবর্তনশীল বৈশিষ্ট্যের যথাযথ যুক্তিসংগত ও সুবিন্যন্ত বিবরণের সঙ্গে সংশিরি বিষয় হলো ভূগোল ।
আলেকজান্ডার ফন হামবোল্টের ( Alexander Von Humboldt) মতে, ভূগোল হলো প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত বিজ্ঞান।
প্রকৃতিতে যা কিছু আছে তার বর্ণনা ও আলোচনা এর অন্তর্ভুক্ত। পৃথিবীর জলবায়ু, ভূ-প্রকৃতি, উদ্ভিদ, প্রাণি, নদ-নদী, সাগর, খনি সম্পদ অর্থাৎ পৃথিবীর প্রাকৃতিক পরিবেশ, পৃথিবীতে বাসকৃত মানুষের জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করে। অপরদিকে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপও প্রাকৃতিক পরিবেশে বিভিন্ন রকম পরিবর্তন ঘটায়।
বনভূমি কেটে তৈরি হয় শহর, জলাশয় ভরাট হয়, অতিরিক্ত কলকারখানাও যানবাহনের কারণে বায়ু দূষণ হয়। বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয় যেমন, বন্যা, খরা, টর্নেডো, ভূমিকম্প, সুনামী ইত্যাদি সংঘটিত হয়। অর্থাৎ মানুষ ও পরিবেশের মধ্যে এক ধরনের মিথস্ক্রিয়ার সম্পর্ক রয়েছে। এই সম্পর্কটি মূলত কার্যকারণ সম্পর্ক।
ভূগোলের প্রধান কাজ কি?
ভূগোলের প্রধান কাজ হলো এই কার্যকারণ সম্পর্ক উদ্ঘাটন করা। মূলত সময় ও স্থানের আলোকে প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে মানুষের কর্মকান্ডের এই সম্পর্কই ভূগোলের মুখ্য বিষয়।
আরও পড়ুন :- খনিজ তেল কাকে বলে?
ভূগোলের পরিধি ও বিষয়বস্তু :-
ভূগোল চর্চা মূলত দুইটি মূল ধারায় বিভক্ত। যথা- প্রাকৃতিক ও মানব ভূগোলে। প্রাকৃতিক ভূগোলে প্রাকৃতিক বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করা হয় এবং মানব ভূগোলে মানুষ ও তার কর্মকান্ড সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়।প্রাকৃতিক ভূগোলের প্রধান শাখাসমূহ হলো- ভূমিরূপ বিদ্যা, জলবায়ু বিদ্যা, সমুদ্র বিদ্যা, গাণিতিক ভূগোল এবং মানব ভূগোলের প্রধান শাখাসমূহ হলো অর্থনৈতিক ভূগোল, জনসংখ্যা ভূগোল, পরিবহণ ভূগোল, আঞ্চলিক ভূগোল, নগর ভূগোল প্রভৃতি।
এছাড়া মানুষের চিন্তা চেতনার বিকাশ, সামাজিক মূল্যবোধের পরিবর্তন এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশ ভূগোলের পরিধিকে অনেক বিস্তৃত করেছে। বর্তমানে বিভিন্ন বিষয়বস্তু যেমন- দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, প্রাণি ভূগোল, মৃত্তিকা ভূগোল এবং ভৌগোলিক তথ্য ব্যবস্থা (GIS) প্রভৃতি ভূগোলের পরিধিকে সমৃদ্ধ করেছে এবং ভবিষ্যতে ভূগোলের পরিধি আরো অধিক বিস্তৃত হবে।
ভূগোলের শাখা :-
ভূগোলের প্রধান দুইটি শাখা রয়েছে। যথা১. প্রাকৃতিক ভূগোল (Physical Geography) :
ভূগোলের যে শাখা পৃথিবীর জন্ম, ভূ-প্রকৃতি অর্থাৎ পাহাড়, পর্বত, বায়ুমণ্ডল ও বারিমন্ডল প্রভৃতি বিষয় নিয়ে আলোচনা করে এবং ভৌত পরিবেশ ও এর মধ্যে কার্যরত বিভিন্ন প্রক্রিয়াকে অন্তর্ভুক্ত করে তাকে প্রাকৃতিক ভূগোল বলে। প্রাকৃতিক ভূগোলের অন্তর্ভুক্ত বিষয়সমূহ নিম্নরূপ।১.১ ভূমিরূপবিদ্যা (Geomorphology) :
ভূমিরূপবিদ্যা পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ অবস্থা, পৃথিবীর উৎপত্তি, ভূ-আলোড়ন, বিভিন্ন প্রকার ভূমিরূপ, নদ-নদীর উৎপত্তি, ক্রমবিকাশ, ভূ-ত্বকের পরিবর্তন, খনিজ ও শিলা এবং পৃথিবীর উৎপত্তি সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করে।
আরও পড়ুন :- মানব ভূগোল কাকে বলে?
১.২ জলবায়ুবিদ্যা (Climatology) :
এ শাখায় বায়ুর গঠন, উপাদান, বায়ুর তাপ, চাপ, আর্দ্রতা, বায়ুপ্রবাহ, বায়ুপুঞ্জ, বায়ুপ্রাচীর, মেঘ, বৃষ্টি, কুয়াশা, আবহাওয়া ও জলবায়ু নিয়ে আলোচনা করে।
১.৩ সমুদ্রবিদ্যা (Oceanography) :
পৃথিবীর প্রায় তিন-চতুর্থাংশ সমুদ্র। এ শাখায় সাগর মহাসাগরের তলদেশের ভূমিরূপ, সমুদ্রস্রোত, মানব জীবনের উপর সমুদ্রস্রোতের প্রভাব, বিভিন্ন মহাদেশের মধ্যে সমুদ্র পথে যোগাযোগ প্রভৃতি বিষয় নিয়ে আলোচনা করে।
১.৪ মৃত্তিকা ভূগোল (Soil Geography) :
মৃত্তিকা ভূগোল অশ্মমণ্ডলের উপরিভাগের মৃত্তিকার গঠন, উপাদান, বণ্টন ও বিন্যাস সম্পর্কে আলোচনা করে।
১.৫ জীব ভূগোল (Biogeography) :
এ শাখা পৃথিবী পৃষ্ঠের প্রাণিজগৎ ও উদ্ভিদের বন্টন নিয়ে আলোচনা করে।
১.৬ গাণিতিক ভূগোল (Mathematical Geography) :
গাণিতিক ভূগোলে জ্যোতিষ্কমণ্ডলী, সৌরজগৎ, পৃথিবী ও এর আকৃতি, গতি, আন্তর্জাতিক তারিখ রেখা ও সময়, আহ্নিক গতি ও বার্ষিক গতির ফলাফল প্রভৃতি নিয়ে আলোচনা করা হয়।
২. মানব ভূগোল (Human Geography) :-
স্থান এবং কালের ভিত্তিতে মানুষ কীভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে, বিভিন্ন পরিবেশের সাথে জীবনযাত্রা নির্বাহ করছে তার কার্যকারণ অনুসন্ধান মানবিক ভূগোলের প্রধান আলোচ্য বিষয়।২.১. অর্থনৈতিক ভূগোল ( Economic Geography) :
কৃষিকাজ, পশুপালন, বনজ সম্পদ, খনিজ সম্পদ, ব্যবসা বাণিজ্য ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ভূগোলের যে শাখায় অন্তর্ভুক্ত থাকে, তাকে অর্থনৈতিক ভূগোল বলে।
আরও পড়ুন:- ভূমিকম্প কাকে বলে?
২.২.জনসংখ্যা ভূগোল (Population Geography) :
জনসংখ্যার বিভিন্ন বিষয় যেমন লিঙ্গ, জন্মহার, মৃত্যুহার, বয়স কাঠামো, বৈবাহিক অবস্থা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কার্যকলাপের উপর জনসংখ্যার প্রভাব প্রভৃতি জনসংখ্যা বিষয়ক বিষয়াদি ভূগোলের যে শাখায় আলোচনা করা হয় তাকে জনসংখ্যা ভূগোল বলে।
২.৩.আঞ্চলিক ভূগোল (Regional Geography) :
আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য অনুসারে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের ভৌগোলিক বিষয়বস্তু অনুশীলন করা আঞ্চলিক ভূগোলের প্রধান বিষয়।
২.৪.রাজনৈতিক ভূগোল (Political Geography) :
রাজনৈতিক বিভাগ, পরিসীমা, বিবর্তন প্রভৃতি ভৌগোলিক বিষয় রাজনৈতিক ভূগোলের আলোচ্য বিষয়।
২.৫.পরিবহন ভূগোল (Transport Geography) :
পরিবহন ভূগোলে মানুষ ও পণ্যের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে স্থানান্তর এবং সরকারি-বেসরকারি সকল ধরনের পরিবহন ব্যবস্থা, সমস্যা ও এর সমাধান সম্পর্কে আলোচনা করে।
২.৬. নগর ভূগোল (Urban Geography) :
ভূগোলের যে শাখায় নগরের উৎপত্তি, বিকাশ, নগর ও শহরের শ্রেণিবিভাগ, নগর পরিবেশ, নগরের কেন্দ্রীয় এলাকা, নগর বস্তি, প্রভৃতি বিষয় নিয়ে আলোচনা করে তাকে নগর ভূগোল বলে।
২.৭.দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা (Disaster Management) :
বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগ ও দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হ্রাস, দুর্যোগ থেকে পরিবেশ ও সম্পদ রক্ষার কৌশল প্রভৃতি বিষয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার আলোচ্য বিষয়।
২.৮.ভৌগোলিক তথ্য ব্যবস্থাপনা ( Geographic Information System) :
ভৌগোলিক তথ্য ও উপাত্ত ব্যবহার করে যে প্রক্রিয়ায় ডাটা সংগ্রহ, সংরক্ষণ, বিশ্লেষণ এবং মানচিত্রের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয় তাকে বলা হয়, ভৌগোলিক তথ্য ব্যবস্থাপনা বা Geographic Information System (GIS)। এটি মূলত ভৌগোলিক তথ্য বিশ্লেষণের জন্য নির্মিত সফ্টওয়্যার।
ভূগোল পাঠের প্রয়োজনীয়তা কি :-
ভূগোলের প্রধান আলোচ্য বিষয় স্থানিক বিন্যাস ( Areal arrangement)। এর প্রধান কার্যক্ষেত্র ভূ পৃষ্ঠের উপরিভাগ এবং লক্ষ প্রাকৃতিক সাংস্কৃতিক বিষয়সমূহের বণ্টনগত তারতম্যের বিন্যাস, এর সাথে যুক্ত নিয়ামকসমূহ চিহ্নিত করে এগুলোর প্রভাব ব্যাখ্যা করা এবং তাদের আস্ত সম্পর্ক তুলে ধরা। ভৌগোলিক জ্ঞান চর্চার মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন প্রপঞ্চের (Phenomena) আপাত: বিশৃঙ্খল বিন্যাসের মধ্যে একটি শৃঙ্খল বিন্যাস প্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা করে। ভূগোল বিবিধের মধ্যে ঐক্য (Unity in Diversity) খুঁজে পেতে সাহায্য করে।আরও পড়ুন :- প্রাকৃতিক ভূগোল কাকে বলে?
ভূগোল ও পরিবেশ পাঠের গুরুত্ব :-
ভূগোল ও পরিবেশ পাঠের গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ পৃথিবীর জন্ম এবং এর ভৌত পরিবেশ যেমন পাহাড়-পর্বত, নদ-নদী, সাগর, মহাসাগর, বায়ুমন্ডল এবং মানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশের প্রায় সকল বিষয় নিয়ে বিস্তারিতভাবে জানা যায় ভূগোল অধ্যয়নের মাধ্যমে।অপরদিকে এই সকল বিষয়ের সাথে মানুষ কীভাবে খাপ খাওয়ায় এবং পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপন করে তারও বিস্তারিত জানা যায় ভূগোল ও পরিবেশ বিষয়টি পাঠের মাধ্যমে। নিম্নে ভূগোল ও পরিবেশ পাঠের গুরুত্ব বর্ণনা করা হলো।
• ভূগোল ও পরিবেশ বিষয়টি অধ্যয়নের মাধ্যমে পৃথিবীর জন্মলগ্ন থেকে কীভাবে জীবজগতের উদ্ভব হয়েছে এই বিষয়ক বিজ্ঞান সম্মত ধারণা পাওয়া যায়।
• পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ অবস্থা, ভূ-ত্বক, ভূ-আলোড়ন, বিভিন্ন প্রকার ভূমিরূপ, নদ-নদীর উৎপত্তি, ক্রমবিকাশ, খনিজ ও শিলার উৎপত্তি প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় ।
• পৃথিবীর যে কোনো স্থানের প্রকৃতি ও পরিবেশ সম্পর্কে জানা যায়।
• পাহাড়, পর্বত, সাগর, মালভূমি, সমভূমি, মরুভূমি প্রভৃতির উৎপত্তির কারণ ও বৈশিষ্ট্য জানা যায়।
• ভূ-পৃষ্ঠের পরিবর্তনের বিভিন্ন শক্তিসমূহ যেমন- ভূমিকম্প, আগ্নেয়গিরি, বিচূর্ণীভবন, নগ্নীভবন ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়।
• বায়ুমন্ডলের গভীরতা, বায়ুর স্তরবিন্যাস, বায়ুর উপাদান, তাপ, চাপ, আর্দ্রতা বায়ুপ্রবাহের কারণ, বৃষ্টিপাত, আবহাওয়া, জলবায়ু প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়। এই সকল বিষয় ভূগোলের জলবায়ুবিদ্যা নামক শাখায় আলোচনা করা হয়।
• পৃথিবীর মহাসাগরসমূহের অবস্থান, আকৃতি, তলদেশীয় ভূমিরূপ, জোয়ার-ভাটা, সমুদ্রস্রোত প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে জানা যায়।
• পৃথিবীর বিভিন্ন পরিবেশের উদ্ভিদ ও প্রাণি এবং এদের আচার-আচরণ, খাদ্যাভাস ও জীবন ধারার বৈচিত্র্য সম্পর্কে জানা যায়।
• কৃষি, শিল্প, ব্যবসা, বাণিজ্য, পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশের কী ধরনের পরিবর্তন হচ্ছে এবং পরিবর্তনের ধারা কীরূপ তা জানা যায়।
• প্রাকৃতিক ভূগোলের বিভিন্ন নিয়ামকের উপর নির্ভর করে প্রাকৃতিক দুর্যোগ সৃষ্টির কারণ এবং দুর্যোগ পূর্বাভাস নিরূপণ করা যায়। এছাড়া ক্ষয়ক্ষতি নিয়ন্ত্রণপূর্বক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সিস্টেম প্রণয়ন করা যেতে পারে।
• পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের ভূ-প্রকৃতি এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার গুরুত্ব অনুযায়ী ভূমি ব্যবস্থাপনার কৌশল প্রণয়ন করা যায়।
• পৃথিবীর প্রায় তিন-চতুর্থাংশ সমুদ্র। বিভিন্ন মহাদেশের মধ্যে সমুদ্র পথে যোগাযোগ, সমুদ্রপৃষ্ঠের উত্থান, অবনমন, সমুদ্রের পানির রাসায়নিক গুণাগুন ও লবণাক্ততা নির্ধারণ, সামুদ্রিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রভৃতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায় ।
• ভৌগোলিক তথ্য ব্যবস্থাপনা (GIS) সফটওয়্যারটি ব্যবহারের মাধ্যমে যে কোনো স্থানের তথ্য ও উপাত্ত সংগ্রহ করে সংগৃহীত তথ্য ও উপাত্ত বিশ্লেষণপূর্বক সংশিষ্ট স্থানের বিস্তারিত বিষয়াদি মানচিত্রের মাধ্যমে উপস্থাপন করা যায়।
• প্রাকৃতিক সম্পদকে কাজে লাগিয়ে মানুষের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করা যায়।
সুতরাং বলা যায়, ভূগোল ও পরিবেশ বিষয়টি পাঠের গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা এখানে মানুষ এবং মানুষের সাথে সম্পর্কিত প্রাকৃতিক, মানবিক এবং সামাজিক পরিবেশের সকল বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়।
আরও পড়ুন:- সৌরজগৎ কাকে বলে?
0 মন্তব্যসমূহ
Please do not enter any spam link in the comment box.