সমুদ্রস্রোত কাকে বলে? সমুদ্রস্রোত কত প্রকার ও কি কি? সমুদ্রস্রোতের বৈশিষ্ট্য? সমুদ্রস্রোতের কারণ, প্রভাব ও ফলাফল?

সমুদ্রস্রোত কাকে বলে :-

একস্থান থেকে অন্যস্থানে মহাসাগর ও সাগরের পানির নির্দিষ্ট ও নিয়মিত প্রবাহকে মহাসাগরীয় স্রোত বা সমুদ্রস্রোত (Ocean Current) বলে।

বায়ুপ্রবাহ সমুদ্রের উপরিভাগের পানির সঙ্গে ঘর্ষণ তৈরি করে এবং ঘর্ষণের জন্য পানিতে ঘূর্ণন তৈরি করে এবং সমুদ্র স্রোতের সৃষ্টি হয়।

সমুদ্রস্রোত কত প্রকার ও কি কি :-

স্রোতের বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে সমুদ্রস্রোতকে নিম্নোক্তভাগে ভাগ করা যায়। যথা

১. সময়ভিত্তিক স্রোত :

ক) স্থায়ী স্রোত (Permanent Current) এবং
খ) ঋতুভিত্তিক বা মৌসুমী স্রোত (Seasonal Current)

আরও পড়ুন :- জল দূষণ কাকে বলে?

২. সমুদ্রের জলের স্তরের উপর ভিত্তি করে সমুদ্রেরস্রোতকে নিম্নোক্তভাবে ভাগ করা যায়। যথা

ক) সমুদ্রপৃষ্ঠের স্রোত (Surface Current)
খ) সমুদ্রপৃষ্ঠের নিচের স্রোত ( Subsurface Current)
গ) মাধ্যমিক স্তরের স্রোত (Intermediate Layer Current)
ঘ) গভীর সমুদ্রের স্রোত (Deep Water Current)
ঙ) সমুদ্রের তলদেশের স্রোত (Bottom Water Current)

৩. তাপমাত্রার উপর ভিত্তি করে সমুদ্রস্রোতকে নিম্নোক্তভাগে ভাগ করা যায়। যথা

ক) উষ্ণ স্রোত (Warm Current) এবং
খ) শীতল স্রোত (Cold Current)

৪. সমুদ্রস্রোতের বহমানতার উপর নির্ভর করে সমুদ্রস্রোতকে প্রধান তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা

ক) প্রশান্তমহাসাগরীয় স্রোতসমূহ,
খ) আটলান্টিক মহাসাগরীয় স্রোতসমূহ এবং
গ) ভারত মহাসগারীয় স্রোতসমূহ।

৫. ভৌগোলিক অবস্থানের উপর ভিত্তি করে নিম্নলিখিতভাগে ভাগ করা যায়। যথা

ক) নিরক্ষীয় স্রোত (Equatorial Current)
খ) উপকূলীয় স্রোত ( Coastal Current) এবং
গ) মেরু স্রোত (Polar Current)

৬. এছাড়া সমুদ্রের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্রোতসমূহ হলো:

ক) প্রান্তীয় স্রোত (Boundary Current) এবং
খ) বিপ্রতীপ স্রোত (Counter Current)


সমুদ্রস্রোতের বৈশিষ্ট্য :-

১. সমুদ্রের সকল স্রোত সমুদ্রের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক শক্তির প্রভাবে সৃষ্ট হয়।

২. সমুদ্রস্রোত পৃষ্ঠ প্রবাহ ও আন্তঃপ্রবাহ উভয়ভাবেই প্রবাহিত হতে পারে।

৩. বায়ুপ্রবাহের উপর সমুদ্র স্রোতের গতিবেগ নির্ভর করে।

৪. বায়ুপ্রবাহ ও সৌরশক্তি সমুদ্রস্রোত সৃষ্টির জন্য দায়ী।

৫. সমুদ্রস্রোত উত্তর গোলার্ধে ডান দিকে বেঁকে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে বাম দিকে বেঁকে প্রবাহিত হয়।

৬. সমুদ্রস্রোত উষ্ণ ও শীতল উভয় প্রকারই হতে পারে।

৭. সমুদ্রস্রোতের গতিবেগের একক কি.মি./ঘন্টা অথবা নটিক্যাল মাইল/ঘন্টা।

সমুদ্র স্রোতের কারণ :-

পানির স্বাভাবিক নিয়ম হচ্ছে তার উপরিভাগের সমতা রক্ষা করা। তাই সমুদ্রের একস্থানের পানি অন্যস্থানে প্রবাহিত হয়। নিম্নলিখিত কারণে সমুদ্রস্রোতের উৎপত্তি হয়।

আরও পড়ুন :- সমুদ্র তলদেশ কাকে বলে?

বায়ুপ্রবাহ (Wind Movement ) :

সমুদ্রস্রোতের উৎপত্তির প্রধান কারণ বায়ুপ্রবাহ। প্রধান স্রোতগুলো ভূ-পৃষ্ঠের প্রধান বায়ুপ্রবাহের পথ অনুযায়ী প্রবাহিত হয়। অয়ন বায়ু প্রবাহিত অঞ্চলে সমুদ্রস্রোত পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে এবং পশ্চিমা বায়ু প্রবাহিত অঞ্চলে পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়।

পৃথিবীর আবর্তন (Rotation of Earth) :

আহ্নিক গতির জন্য পৃথিবী নিজ অক্ষে সর্বদা পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে ঘুরছে। এই কারণে সমুদ্রের পানি পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে সমুদ্রস্রোতের সৃষ্টি করে। ফলশ্রুতিতে সমুদ্রস্রোত ফেরেলের সূত্র অনুসারে উত্তর গোলার্ধে ডান দিকে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে বাম দিকে বেঁকে প্রবাহিত হয়।

উষ্ণতার তারতম্য (Variation in Temperature) :

নিরক্ষীয় অঞ্চলে সূর্য লম্বভাবে কিরণ দেয় ফলে নিরক্ষীয় অঞ্চলের উষ্ণ পানি আয়তনে বৃদ্ধি পায় ও হালকা বলে সমুদ্রের উপরিভাগ দিয়ে উত্তর ও দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়। অপরদিকে, পানির সমতা রক্ষা করার জন্য মেরু অঞ্চলের শীতল ও ভারি পানি সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে নিরক্ষীয় অঞ্চলে আসতে থাকে। অর্থাৎ উষ্ণতার তারতম্য সমুদ্রস্রোতকে প্রবাহিত করে।

লবণাক্ততার তারতম্য (Variation in Salinity) :

সমুদ্রের অধিক লবণাক্ত অঞ্চল হতে কম লবণাক্ত অঞ্চলের দিকে পানির আন্তঃপ্রবাহ এবং অল্প লবণাক্ত অঞ্চল হতে অধিক লবণাক্ত অঞ্চলের দিকে পানির পৃষ্ঠ প্রবাহ সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন প্রাকৃতিক কারণ যেমন বৃষ্টিপাত, বাষ্পীভবন, নদী, বরফ গলা পানি প্রভৃতি কারণে সমুদ্রের সর্বত্র লবণাক্ততার পরিমাণ সমান থাকে না। যেমন- নিরক্ষীয় অঞ্চলে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত, মেরু অঞ্চলে কম বাষ্পীভবনের কারণে লবণাক্ষতা কম। অপরদিকে বৃষ্টিহীনতার জন্য ক্রান্তীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা অধিক।

স্থলভাগের অবস্থান (Presence of Landmasses) :

স্বাভাবিকভাবে সমুদ্রস্রোত প্রবাহিত হওয়ার সময় স্রোতের সম্মুখে স্থলভাগ থাকলে স্রোতের দিক পরিবর্তিত হয়ে নতুন স্রোতের উৎপত্তি হয়।

অসম বাষ্পীভবন (Unequal Evaporation) :

সমুদ্রের কোনো অংশে অধিক উত্তাপের জন্য বাষ্পীভবনের পরিমাণ অধিক হলে পানির উচ্চতা কমে যায় ফলে নিকটবর্তী কম উত্তপ্ত অঞ্চল হতে পানি এসে পানির স্বাভাবিক ধর্ম অনুসারে পানির সমতা রক্ষা করে। এভাবে অসম বাষ্পীভবন সমুদ্রস্রোতকে প্রভাবিত করে।

সমুদ্রের গভীরতা (Depth of the Ocean) :

সমুদ্রের গভীরতা কম হলে পানি দ্রুত উত্তপ্ত হয়ে ওপরে উঠে এবং শীতল পানি নিচে নেমে যায়। এভাবে উর্ধ্বগামী ও নিম্নগামী স্রোতের সৃষ্টি হয়। সূর্যের কিরণ সমুদ্রের গভীরে ২১০ মিটারের অধিক প্রবেশ করতে পারে না। ফলে গভীর সমুদ্রের উপরিভাগ দিয়ে পৃষ্ঠস্রোত এবং তলদেশ দিয়ে অন্তঃস্রোত প্রবাহিত হয়।

সমুদ্রস্রোতের প্রভাব :-

পৃথিবীর সাগর ও মহাসাগরসমূহের বিভিন্ন স্থানে প্রধানত দুই ধরনের সমুদ্রস্রোতের (ঊষ্ণ ও শীতল স্রোত) প্রস্তাব বিশেষভাবে লক্ষণীয়। নিম্নে প্রধান দুটি ভাগে সমুদ্রস্রোতের প্রভাব বর্ণনা করা করা হলো। যথা

ক. জলবায়ুর উপর প্রভাব :

জলবায়ুর উপর সমুদ্রস্রোতের প্রভাব নিম্নে বর্ণনা করা হলো। যথা

১. সমুদ্র তীরবর্তী দেশসমূহের উপর সমুদ্রস্রোতের প্রভাব সর্বাধিক। ঊষা সমুদ্রস্রোত প্রবাহিত অঞ্চলের জলবায়ু উষ্ণ থাকে অপরদিকে শীতল সমুদ্র স্রোত প্রবাহিত অঞ্চলের জলবায়ু অপেক্ষাকৃত শীতল হয়।

যেমন: উত্তর আমেরিকার সেন্ট লরেন্স নদী ও তার মোহনা শীতল লাব্রাডার স্রোতের প্রভাবে বছরের প্রায় নয় মাসই বরফাবৃত থাকে। কিন্তু একই অক্ষাংশে অবস্থিত বৃটিশ দ্বীপপুঞ্জের উপকূল উষ্ণ উপসাগরীয় স্রোতের প্রভাবে সর্বদা বরফমুক্ত থাকে। লন্ডন এবং নিউইয়র্ক একই অক্ষাংশে অবস্থিত হলেও শীতকালে শীত অনুভূত হয় কারণ নিউইয়র্কের পূর্বপার্শ্ব দিয়ে শীতল পাব্রাডার স্রোত প্রবাহিত হয়।

২. ঊষ্ণ স্রোতের উপর দিয়ে প্রবাহিত বায়ুতে অধিক জলীয়বাষ্প থাকে বলে তা স্থলভাগের উপর দিয়ে প্রবাহিত হলে বৃষ্টিপাত ঘটায়। অপরদিকে শীতল স্রোতের উপর দিয়ে প্রবাহিত বায়ু শুদ্ধ হয় বিধায় স্থলভাগে বৃষ্টিপাত ঘটায় না।

৩. উষ্ণ ও শীতল সমুদ্রস্রোতের মিলনস্থলে তাপমাত্রা বা উষ্ণতার পার্থক্যের দরুণ ঘন কুয়াশা এবং ঝড়ের সৃষ্টি হয়। এ কারণে নিউফাউন্ডল্যান্ড ও জাপানের পূর্ব উপকূলে কুয়াশা এবং ঝড়-বৃষ্টির সৃষ্টি হয়।

খ. বাণিজ্যের উপর প্রভাব :

নাতিশীতোষ্ণ এবং হিমমন্ডলের অনেক সমুদ্র শীতকালে পানি বরফে পরিণত হয়। এইরূপ অঞ্চলে উষ্ণ স্রোত প্রবাহিত হলে সমুদ্রের পানি বরফে পরিণত হতে পারে না।

উপসাগরীয় উষ্ণ স্রোতের দরুণ নরওয়ের উত্তর উপকূলে শীতকালেও বরফ জমে না, ফলে বন্দরগুলোর পথ বন্ধ হতে পারে না। উষ্ণ জাপান বা কুরোশিও স্রোতের জন্য কানাডার পশ্চিম উপকূলও বরফমুক্ত থাকে।

সুমেরু শীতল স্রোতের প্রভাবে উত্তর আমেরিকার পাব্রাডার উপদ্বীপের বন্দরগুলো বছরের অধিকাংশ সময়ই বরফে আবৃত থাকে ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যে বিঘ্ন ঘটে।

সমুদ্রস্রোতের ফলাফল :-

বায়ুমণ্ডলে উষ্ণতার তারতম্য :

উষ্ণস্রোত যে সকল দেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয় সেই সকল দেশের তাপমাত্রা /উত্তাপ বৃদ্ধি পায়। কিন্তু শীতলস্রোত প্রবাহিত হলে জলবায়ু অপেক্ষাকৃত শীতল হয়।

যেমন-শীতল ল্যাব্রাডর স্রোতের প্রভাবে উত্তর আমেরিকার সেন্ট লরেন্স নদী ও তার মোহনা বছরের নয় মাস বরফাবৃত থাকে। আবার উষ্ণ উপসাগরীয় স্রোতের প্রভাবে একই অক্ষাংশে অবস্থিত ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের উপকূল সর্বদা বরফমুক্ত থাকে।

বৃষ্টিপাত :

উষ্ণস্রোতের ওপর দিয়ে প্রবাহিত বায়ুতে অধিক জলীয়বাষ্প থাকার স্থলভাগের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার সময় বৃষ্টিপাত ঘটায়। অন্যদিকে শীতলস্রোতের উপর দিয়ে প্রবাহিত বায়ুতে জলীয়বাষ্প না থাকায় বৃষ্টিপাত হয়না বরং তুষারপাত ঘটায়।

যেমন- শীতল ল্যাব্রাডর স্রোতের জন্য ল্যাব্রোডর উপকূলে অধিক তৃষারপাত হয়। ইংল্যান্ডের পশ্চিম উপকূলে বৃষ্টিপাত অধিক হওয়ার কারণ হলো আটলান্টিক মহাসাগরের উষ্ণ স্রোত।

কুয়াশা ও ঝড় :

বিপরীতমুখী ঊষ্ণ ও শীতল স্রোতের মিলনস্থলে ঘনকুয়াশা ও ঝড়ের সৃষ্টি হয়। এ জন্য নিউফাউন্ডল্যান্ড ও জাপানের পূর্ব উপকূলে জাহাজ চলাচলে বিঘ্ন ঘটায়।

বন্দরের সুবিধা :

উষ্ণস্রোতের কারণে বরফ জমতে পারে না। যেমন- উষ্ণস্রোতের প্রভাবে নরওয়ের উত্তর উপকূলীয় অঞ্চলে শীতকালে বরফ জমে না। এতে বন্দরগুলোতে সারাবছর ব্যবসা-বাণিজ্য চালান সম্ভব হয়। উষ্ণ কুরোশিও স্রোতের জন্য কানাডার পশ্চিম উপকূল বরফমুক্ত থাকে।

জাহাজ চলাচল :

স্রোতের অনুকূলে জাহাজ চালিয়ে শীঘ্র গন্তব্য স্থানে পৌঁছান যায়। যেমন- উষ্ণ উপসাগরীয় স্রোতের পথে। জাহাজ আমেরিকা থেকে ইউরোপ অনেক সহজে অল্প সময়ে যেতে পারে। পক্ষান্তরে ইউরোপ থেকে আমেরিকা পৌঁছাতে অনেক সময় লাগে।

হিমশৈল :

শীতল সমুদ্র স্রোতের গতিপথে হিমশৈল থাকার কারণে জাহাজ চলাচল নিরাপদ নয়। কিন্তু উষ্ণস্রোতের কারণে আটলান্টিক মহাসাগরের উভয় উপকূল ব্যবসা-বাণিজ্যে সমৃদ্ধ। যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত টাইটানিক জাহাজ ১৯১২ সালে হিমশৈলের সঙ্গে ধাক্কা লেগে প্রথম যাত্রাতেই সমুদ্রে ডুবে গিয়েছিল।

মগ্নচড়ার সৃষ্টি ও মৎস্য বাণিজ্য :

উষ্ণ ও শীতল স্রোতের মিলনস্থলের মাচড়ায় প্রচুর মৎস্যের সমাগম হয় এবং সেখানে মৎস্য শিকার ও মৎস্য ব্যবসা গড়ে উঠে।

যেমন- নিউফাউন্ডল্যান্ডের উপকূলে গ্রান্ড ব্যাঙ্ক, সেবল ব্যাঙ্ক, ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের উপকূলে ডর্গাস ব্যাঙ্ক মগ্নচড়ার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এই এলাকা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মৎস আহরণ ক্ষেত্র। অগভীর মগ্নচড়াগুলোতে প্রচুর পরিমাণে পাংকটন (এক প্রকার অতি ক্ষুদ্র উদ্ভিদ ও প্রাণি) জন্মায় ও বংশ বৃদ্ধি করে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

1 মন্তব্যসমূহ

Please do not enter any spam link in the comment box.