মাটি দূষণ কাকে বলে? মাটি দূষণের কারণ? মাটি দূষণের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ?

মাটি দূষণ কাকে বলে :-

রোদ, বৃষ্টি, বায়ুপ্রবাহ, পানিস্রোত, হিমবাহ, অগ্ন্যুৎপাত, ভূমিকম্প প্রভৃতি প্রাকৃতিক শক্তির প্রভাবে শিলারাশি চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে পৃথিবী পৃষ্ঠের উপরিভাগে যে নরম আবরণ সৃষ্টি হয়েছে তাকে মাটি বলে।

মৃত্তিকার উপরই আমরা বসবাস করি এবং গাছপালাসহ নানা ধরনের ফসল উৎপাদন করে জীবনধারণ করি।

শিল্প বর্জ্য, কৃষি বর্জ্য, তেজষ্ক্রিয় বর্জ্য, জমাকৃত আবর্জনা এবং বিভিন্ন জৈব উপাদান মৃত্তিকার যে ক্ষতিসাধন করে তাই হলো মৃত্তিকা দূষণ।

মাটি দূষণের কারণ :-


সাধারণত মৃত্তিকা দূষণের ক্ষেত্রে সে সকল কারণগুলো কাজ করে থাকে। তা বর্ণনা করা হলো।

১. শিল্প-কারখানার বর্জ্য :

শিল্প-কারখানার বর্জ্য পদার্থ মৃত্তিকার সাথে মিশে দূষণ ঘটায়। শিল্প-কারখানার কঠিন বর্জ্য, রাসায়নিক উপাদান প্রভৃতি দীর্ঘদিন মৃত্তিকায় মিশলে মৃত্তিকা তার স্বাভাবিক গুণাগুণ হারিয়ে ফেলে।

আরও পড়ুন :- দূষণ কাকে বলে? 

২. কৃষি ও গৃহস্থালি বর্জ্য :

ফসলের পরিত্যক্ত অংশ জমানো এবং পোড়ানো, গবাদি পশুর মলমূত্র, কৃষি যন্ত্রপাতির অবশিষ্টাংশ দীর্ঘদিন ধরে মাটিতে ফেলে রাখলে মাটির গুণাগুণের উপর প্রভাব পড়ে। এছাড়া গৃহস্থালি কাজে ব্যবহৃত জিনিসপত্রের অবশিষ্টাংশ, প্রাণি বর্জ্য, খাদ্যের আঁশ, মিউনিসিপ্যালের বর্জ্য, পলিথিন ইত্যাদি মাটিতে পড়ে থাকলে মাটি দূষিত হয়।

৩. রাসায়নিক সার ও কীটনাশক :

মৃত্তিকা দূষণের অন্যতম কারণ রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার। ক্রমবর্ধিষ্ণু জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে জমিতে অধিক হারে ফসল ফলানোর জন্য অধিক হারে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। অনেক সময় কীটনাশকের বিষক্রিয়া দীর্ঘদিন যাবৎ থাকে যা মৃত্তিকার উর্বরতা হ্রাস, কেঁচোসহ, উপকারী কীটপতঙ্গ এবং বিভিন্ন অনুজীব ধ্বংস করে থাকে।

এছাড়া রাসায়নিক সার ব্যবহারের পুনরাবৃত্তির ফলে মৃত্তিকায় অপ্রয়োজনীয় রাসায়নিক যৌগের পরিমাণ বাড়ে, অন্যদিকে হিউমাস ও নাইট্রোজেনের মাত্রা কমে যায়। এভাবে মৃত্তিকা দূষিত হতে থাকে।
মৃত্তিকা দূষণ কাকে বলে

৪. মাটি পোড়ানো :

সাধারণত ইটভাটার স্থানে মাটি পোড়ানো, ক্ষেতের অবশিষ্টাংশ পোড়ানোর ফলে মাটি পুড়ে গেলে উৎপাদন ক্ষমতা কমে যায় এবং দূষণ ঘটে।

৫. এসিড বৃষ্টি :

বৃষ্টির পানির সাথে সালফিউরিক এসিড, নাইট্রিক এসিড, হাইড্রোজেন ক্লোরাইড ইত্যাদি রাসায়নিক পদার্থ মিশ্রিত অবস্থায় ভূ-পৃষ্ঠে পতিত হয়। এই ধরনের বৃষ্টিপাতকে বলে এসিড বৃষ্টি। সাধারণত শিল্পাঞ্চলে অধিক হারে জীবাশ্ম জ্বালানি ও সালফাইড আকরিক পোড়ানোর ফলে এ ধরনের বৃষ্টি হতে পারে। এতে মৃত্তিকা দূষিত হয়।

৬. মৃত্তিকার লবণাক্ততা :

মৃত্তিকার লবণাক্ততা উর্বরতা হ্রাসের একটি উল্লেখযোগ্য কারণ। সামুদ্রিক পানি জলোচ্ছ্বাসের মাধ্যমে ভূ-অভ্যন্তরে প্রবেশ করে মৃত্তিকাকে লবণাক্ত করে।

আরও পড়ুন :- জল দূষণ কাকে বলে?

৭. বন উজাড় :

ব্যাপকহারে বন উজাড় করলে গাছপালার অভাবে মাটির আর্দ্রতা এবং হিউমাস কমে গিয়ে উর্বরতা শক্তি হ্রাস পায় এবং দূষণ ঘটে।

৮. প্রাকৃতিক উৎস :

বিভিন্ন প্রকার প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন- আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত, ভূমিধ্বস, ভূমিক্ষয়, প্রবল বায়ুপ্রবাহ, অতিবৃষ্টি প্রভৃতি মৃত্তিকা দূষণের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

৯. চিকিৎসা বর্জ্য :

চিকিৎসা ক্ষেত্রে ব্যবহৃত বিভিন্ন সরঞ্জাম যেমন- সিরিঞ্জ, ব্যান্ডেজ ইত্যাদি দীর্ঘদিন মাটিতে ফেলে রাখলে মাটির গুণগতমান বিনষ্ট হয়। মাটির উপকারী কীটপতঙ্গগুলো আক্রান্ত হয় এবং দূষণ ঘটে। এছাড়া পারমানবিক পরীক্ষা, মানুষের মলমূত্র, জলাবদ্ধতা প্রভৃতি কারণেও মৃত্তিকা দূষিত হয়।

মাটি দূষণের প্রভাব :-

নিম্নে মৃত্তিকা দূষণের প্রভাবসমূহ উল্লেখ করা হলো

১. উৎপাদন হ্রাস :

মৃত্তিকা দূষণের প্রধান প্রভাব পড়ে কৃষি উৎপাদনে। অধিক পরিমাণে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ফলে সাময়িকভাবে অধিক উৎপাদন হলেও দীর্ঘমেয়াদে মৃত্তিকা গুণাগুণ হারিয়ে ফেলে উৎপাদন হ্রাস পায় ।

২. মৃত্তিকার ভৌত রাসায়নিক অবক্ষয় :

মৃত্তিকা দূষণের ফলে যেসব ভৌত রাসায়নিক অবক্ষয় ঘটে তার মধ্যে রয়েছে ধারণ ক্ষমতা হ্রাস, অনুজৈবিক কার্যাবলি হ্রাস, কণার ঘনত্ব বৃদ্ধি, দৃঢ়তা ও চাপ বৃদ্ধি, কীটপতঙ্গের কার্যাবলি এবং বৈচিত্র্যতা‌ হ্রাস পাওয়া। এছাড়া মৃত্তিকার লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেতে পারে।

৩. জীববৈচিত্র্য হ্রাস :

মৃত্তিকা দূষিত হলে জীববৈচিত্র্য হ্রাস পায়। কারণ মৃত্তিকা দূষণের ফলে প্রাণির খাদ্য চক্র বিঘ্নিত হয়, জৈব পদার্থ হ্রাস পায়, ভূমিধ্বস হয় এবং বায়োমাস হ্রাস পায়। ফলে জীববৈচিত্র্য তার স্বাভাবিকতা বজায় রাখতে পারে না।

৪. মানবদেহে প্রভাব :

মৃত্তিকায় স্তুপ হয়ে থাকা আবর্জনা জনজীবনে স্বাস্থ্যহানি ঘটায়। মাটিতে মিশে যাওয়া রাসায়নিক দূষকসমূহ মানুষসহ অন্যান্য জীবের মৃত্যুও ঘটাতে পারে। এছাড়া ভারী ধাতুকণা মানবদেহে প্রবেশ করে হাঁপানি, ক্যান্সার, চর্মরোগ ইত্যাদি সৃষ্টিতে সহায়তা করে।


মাটি দূষণ নিয়ন্ত্রণের উপায় :-

মৃত্তিকা দূষণের ফলে পরিবেশে মারাত্মক ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে। মাটির সাথে যেহেতু আমাদের সম্পর্ক নিবিড় তাই এটি দূষণরোধে আমাদের সজাগ থাকতে হবে। নিম্নোক্ত উপায়ে মৃত্তিকা দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে

১. যত্রতত্র মলমূত্র ত্যাগ না করা।

২. পরিমিত পরিমাণে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করা।

৩. জমিতে জৈব সারের ব্যবহার বাড়ানো।

৪. গবাদি পশুসহ অন্যান্য প্রাণির মৃতদেহ মাটির গভীরে গর্ত করে পুতে ফেলা।

৫. পরিত্যক্ত যন্ত্রপাতির ভাঙ্গা অংশ মাটিতে ফেলে না রেখে পুন:ব্যবহার করা।

৬. শিল্প-কারখানার বর্জ্য পরিশোধনের ব্যবস্থা করা এবং পুন: ব্যবহারের উপায় বের করা।

৭. মাটিতে ইঁট না পুড়িয়ে যান্ত্রিক উপায়ে পোড়ানোর উপায় বের করা।

৮. পারমানবিক পরীক্ষা এবং বোমার ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা।

৯. পাঠ্যসূচিতে দূষণ সম্পর্কে পাঠদান ও সচেতনতা সৃষ্টি করা এবং

১০. আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা প্রভৃতি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ