খনিজ সম্পদ কাকে বলে :-
এক বা একাধিক উপাদানে গঠিত হয়ে বা সামান্য পরিবর্তিত অবস্থায় যেসব রাসায়নিক প্রক্রিয়াজাত যৌগিক পদার্থ শিলাস্তরে সঞ্চিত থাকে তাকে খনিজ বলে।বিশেষ রাসায়নিক গঠনযুক্ত প্রাকৃতিক ও অজৈব উপায়ে গঠিত বস্তুকে খনিজ সম্পদ বলে।
এটি প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে সৃষ্টি হয়ে থাকে যার উপর মানুষের কোন হাত বা নিয়ন্ত্রন নেই। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে ভূ-পৃষ্ঠের অভ্যন্তরভাগের শিলান্তরের মধ্যে বিভিন্ন প্রকার শিলার উপাদান অথবা যুগযুগ ধরে রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় শিলাসমূহ কয় প্রাপ্ত হয়ে যে সকল যৌগিক পদার্থ সৃষ্টি করে তাদেরকে খনিজ সম্পদ বলা হয়।
খনিজ সম্পদের উদাহরণ :-
সোনা, তামা, রূপা, করলা, জি তৈল, লোহা, ভাষা, দণ্ড, চুনাপাশ্বের, অ্যালুমিনিয়াম, ম্যাংগানিজ প্রভৃতি খনিজ সম্পদের উদাহরণ।
খনিজ সম্পদ কত প্রকার ও কি কি :-
খনিজ সম্পদের গঠন, উপাদান, আকার এবং ব্যবহারের উপর ভিত্তি করে খনিজ সম্পদকে প্রধান তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা১. ধাতব খনিজ : ধাতব পদার্থ দ্বারা তৈরি খনিজকে ধাতব খনিজ বলে। ধাতব খনিজ লৌহ বৰ্গীয় এবং অলৌহ বৰ্গীয় হয়ে থাকে। লৌহ বৰ্গীয় ধাতব খনিজসমূহ হলো- লৌহ, ম্যাঙ্গানিজ এবং নিকেল। অলৌহবর্গীয় খনিজসমূহ হলো- তামা, টিন, সোনা, রূপা, হীরা প্রভৃতি।
২. অধাতব খনিজ : যে সকল খনিজে ধাতব পদার্থ থাকে না তাকে অধাতব খনিজ বলে। যেমন- সালফার, গ্রাফাইট, অভ্র এবং জিপসাম প্রভৃতি।
৩. শক্তিসম্পদ : যে সকল খনিজ সম্পদ প্রধানত শক্তি উৎপাদনে ব্যবহৃত হয় তাকে শক্তি সম্পদ বলে। যেমন- খনিজ তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস, কয়লা এবং আণবিক খনিজ প্রভৃতি।
আরও পড়ুন :- মহীসোপান কি?
তেমনিভাবে শুধুমাত্র খনিজ তেলে সমৃদ্ধির কারণে মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলো আর্থিক স্বচ্ছলতা লাভ করেছে। আবার খনিজ সম্পদের অভাবে অনেক দেশ অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিকভাবে এখনও অনেক অনুন্নত রয়ে গেছে। নিম্নে খনিজ সম্পদের গুরুত্বের বিভিন্ন দিক বর্ণনা করা হলো-
খনিজ সম্পদের গুরুত্ব :-
খনিজ সম্পদ প্রকৃতির দান, যার উপর মানুষের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। কিন্তু খনিজ সম্পদ অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। দেখা যায়, যে দেশ যত বেশী খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ সে দেশ অর্থনৈতিক ভাবে তত উন্নত। যুক্তরাষ্ট্রে, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, চীন প্রভৃতি দেশে প্রচুর খনিজ সম্পদ থাকায় এ সকল দেশ অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিকভাবে ব্যাপক উন্নতি সাধন করেছে।তেমনিভাবে শুধুমাত্র খনিজ তেলে সমৃদ্ধির কারণে মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলো আর্থিক স্বচ্ছলতা লাভ করেছে। আবার খনিজ সম্পদের অভাবে অনেক দেশ অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিকভাবে এখনও অনেক অনুন্নত রয়ে গেছে। নিম্নে খনিজ সম্পদের গুরুত্বের বিভিন্ন দিক বর্ণনা করা হলো-
১. শিল্প উন্নয়নে খনিজ সম্পদ :
শিল্প কারখানা স্থাপনের জন্য খনিজ সম্পদ অত্যন্ত জরুরী। কারণ খনিজ সম্পদ ব্যতিত কোন দেশই শিল্প কারখানায় উন্নতি লাভ করতে পারে না। তাই যে কোন শিল্প স্থাপনের জন্য লোহা, তামা, নিকেল, কালা, খনিজ তেল, গ্যাস প্রভৃতি নিজ সম্পদের উপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। তার ফলে যে দেশ খনিজ সম্পদে যতবেশী সমৃদ্ধ সেদেশ শিল্প কারখানায় তত বেশী উন্নত। যেমন: যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া প্রভৃতিদেশ বনিজ সম্পদের প্রাচুর্য থাকায় শিল্প কারখানা ও প্রকৃত উন্নয়ন সাধন করেছে।
২. অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক উন্নতি :
খনিজ সম্পদ যে কোন দেশের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। খনিজ সম্পদ রপ্তানি করে আর্থিক সচ্ছলতা আনায়ন করে। আর যে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে তা নিয়ে দেশের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি অনায়াসে আমদানী করতে পারে।
আবার অনেক দেশের অর্থনৈতিক মেরুদ খনিজ সম্পদের উপর নির্ভরশীল। যেমন দক্ষিণ আফ্রিকার স্বর্ণখনি, ভেনিজুয়েলার তেলখনি, চিলির নাইট্রোজেন খনি, মধ্য প্রাচ্যের দেশ গুলোর তেল খনি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
৩. সভ্যতার প্রতীক :
আধুনিক সভ্যতার পেছনে খনিজ সম্পদের অবদান অনস্বীকার্য। রেলগাড়ী, কলকারখানা, উড়োজাহাজ, মোটরগাড়ি, অস্ত্রশস্ত্র প্রভৃতি সভ্যতার প্রতীক। আর এগুলো তৈরীর জন্য খনিজ সম্পদ একান্ত অপরিহার্য।
৪. জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন :
খনিজ সম্পদ একটি দেশের জীবন যাত্রার মানোন্নয়নে গুরত্বপূর্ণ অবদান রাখে। তার প্রকৃষ্ট উদাহরন হলো মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলো। তেল আবিস্তারের পূর্বে এ দেশগুলোর জীবনযাত্রার মান খুব নিম্ন ছিল, কিন্তু তেল আবিস্কারের পর তাদের জীবন যাত্রা সম্পূর্ণ পালটে যায় এবং যথেষ্ট উন্নয়ন সাধন হয়।
আরও পড়ুন :- খনিজ তেল কাকে বলে?
৫. জ্বালানি :
যানবাহন, কলকারখানা ও রান্নাবান্নার জন্য খনিজ তেল, গ্যাস ও করলা ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
৬. আলংকারাদি প্রস্তুত :
স্বর্ণ, রৌপ্য, হীরা, প্লাটিনাম ইত্যাদি খনিজ পদার্থ দ্বারা বিভিন্ন ধরনের অলংকারাদি তৈরী হয়ে থাকে।
পরিশেষে বলা যায়, কোন দেশের অর্থনীতি, শিল্প, বাণিজ্য প্রভৃতিতে খনিজ সম্পদ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
বাংলাদেশের প্রধান খনিজ সম্পদ ও এর ব্যবহার :-
বাংলাদেশের প্রধান খনিজ সম্পদসমূহ হচ্ছে কয়লা, চুনাপাথর, কাঁচাবালি, খনিজ তেল, চানামাটি, খনিজ বালি এবং প্রাকৃতিক গ্যাস।১. কয়লা :
শক্তির অন্যতম উৎস কয়লা। বাংলাদেশের বিভিন্ন কল-কারখানা, রেলগাড়ি (বর্তমানে কিছু সংখ্যক মাল গাড়ি), জাহাজ প্রভৃতি চালাবার জন্য কয়লা ব্যবহৃত হয়। এছাড়া বিভিন্ন প্রকার জালানি যেমন তাপীয় বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, ইটভাটা, গুড় তৈরী কারখানা ইত্যাদিতে কয়লা ব্যবহার হয়।
২. খনিজ তেল :
বাংলাদেশে ২টি তেল ক্ষেত্র রয়েছে। প্রথমটি ১৯৮৬ সালে সিলেট জেলার হরিপুরে ৬০০ ব্যারেল এবং বরমচালে দৈনিক ১২০০ ব্যারেল তেল উত্তোলিত হয়ে থাকে। এই অশোধিত তেল থেকে পেট্রোল, কেরোসিন, বিটুমিন, ও অন্যান্য দ্রব্য পাওয়া যায়। তেলের ব্যবহার ব্যাপক। দৈনন্দিন রান্না, গাড়ী, ট্রেন সহ বিভিন্ন বিষয়ের জালানী হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় আমাদের প্রাপ্ত তেল খুবই অল্প।
আরও পড়ুন:- আগ্নেয় শিলা কাকে বলে?
৩. চুনাপাথর :
সিমেন্টের কাঁচামাল হিসেবে চুনাপাথরের ব্যাপক ব্যবহার। এছাড়া গ্লাস, ব্লিচিং পাউডার, চিনি, সাবান, কাগজ, পেইন্ট প্রভৃতি শিল্পে চুনাপাথর ব্যবহার হয়ে থাকে। সিলেটের উত্তরে যে চুনাপাথর পাওয়া যায়, তা ছাতকের সিমেন্ট কারখানায় কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
৪. চীনামাটি :
চীনামাটি তৈজসপত্র তৈরী এবং বৈদ্যুতিক ইনস্যুলেটর ও স্যানিটারী সরঞ্জামের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সামান্য পরিমাণে কাগজ ও রাবার শিল্পে ব্যবহার করা হয়।
৫. তামা :
বিভিন্ন প্রকার তৈজস পত্র, বৈদ্যুতিক তার, স্কু-নাট, ডেকোরেশন সরঞ্জামসহ অনেক ক্ষেত্রে তামা ব্যবহার হয় আমাদের দেশে।
৬. কঠিন শিলা :
রেলপথ, রাস্তাঘাট, গৃহ, সেতু ও বাঁধ নির্মাণ এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতি কাজে কঠিন শিলা (Hard Rock) ব্যবহৃত হয়।
৭. সিলিকা বালি :
সিলিকা বালি সাধারণত কাঁচ নির্মাণে ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া রং, রাসায়নিক দ্রব্য ইত্যাদি তৈরিতেও সিলিকা বালি ব্যবহৃত হয়।
৮. পারমাণবিক খনিজ পদার্থ :
পারমাণবিক খনিজ পদার্থ (Atomic Minerals) সাধারণত ভারী ধাতব শিল্পে ব্যবহৃত হয়। পারমাণবিক কার্যক্রমেও এ খনিজ ব্যবহৃত হয়।
৯. গন্ধক :
গন্ধক সাধারণত রাসায়নিক শিল্পে ব্যবহার হয়। ম্যাচ, সালফার জাতীয় ঔষধ তৈরীতে, কীট পতঙ্গ নাশক ঔষধ তৈরী, এসিড, পেট্রোলিয়াম, পরিশোধন, আতশবাজি বা বিস্ফোরক প্রভৃতি দ্রব্য তৈরীতে গন্ধক ব্যবহার করা হয়।
১০. প্রাকৃতিক গ্যাস :
প্রাকৃতিক গ্যাস বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ জ্বালানি সম্পদ, যা দেশের মোট বাণিজ্যিক জ্বালানি ব্যবহারের ৭০ শতাংশ এবং মোট জ্বালানীর ১৬ শতাংশ পূরণ করে। প্রাকৃতিক গ্যাস বাংলাদেশের শিল্পকারখানাতে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বিদ্যুৎ উৎপাদন সারকারখানা, কীট নাষক ঔষধ, রাবার, প্লাষ্টিক, কৃত্রিম তন্তু, কৃষি, শিল্পকারখানা ও গৃহকর্মে ব্যবহৃত হচ্ছে। এছাড়া বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সি.এন.জি (Converted Natural Gas) হিসেবে মোটরযানে ব্যবহৃত হচ্ছে। এলপিজি বা রান্নার জন্য সিলিন্ডারের তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস ব্যবহৃত হয়।
১১. লৌহ :
বাংলাদেশে বাড়ী, গাড়ী সহ বিভিন্ন প্রকার শিল্পে লোহার ব্যবহার ব্যাপক। কিন্তু বাংলাদেশে শুধু কিছু পরিমাণে আকরিক লোহা পাওয়া যায়।
আরও পড়ুন :- কয়লা কাকে বলে?
0 মন্তব্যসমূহ
Please do not enter any spam link in the comment box.