অতিরিক্ত জনসংখ্যার কারণ ও প্রভাব?

অতিরিক্ত জনসংখ্যার কারণ :-

যে সব এলাকায় বা দেশে মানুষের জীবনধারণের পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা রয়েছে সাধারণত সে সব এলাকাতেই অধিক জনসংখ্যা বাস করে। প্রাকৃতিক, আর্থ-সামাজিকসহ বিভিন্ন কারণে কোনো দেশ বা অঞ্চলে অতিরিক্ত জনসংখ্যা পরিলক্ষিত হয়। অতিরিক্ত জনসংখ্যার জন্য যে সকল কারণ মুখ্য ভূমিকা পালন করে সেগুলো নিম্নে বর্ণনা করা হলো।

১. ভূমিরূপ :

অতিরিক্ত জনসংখ্যার একটি অন্যতম কারণ হলো ভূমিরূপ। সাধারণত সমতল ভূমি অঞ্চলে অধিক জনসংখ্যা দেখা যায়।

বিশ্বের যে সকল অঞ্চলে সমতল ভূমি রয়েছে সেসব এলাকায় কৃষিকাজ, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প কারখানা সহজে স্থাপন করা যায় বলে অধিক লোক বাস করে।

২. মৃত্তিকা :

উর্বর মৃত্তিকা অঞ্চলে স্বভাবতই অধিক জনসংখ্যা বাস করে। এসব মৃত্তিকা অঞ্চলে ব্যাপকহারে কৃষি কর্মকান্ত হওয়ায় মানুষের খাবার সরবরাহ নিশ্চিত হয়।

এছাড়া কৃষিভিত্তিক উৎপাদিত পণ্যসামগ্রীকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন শিল্প কারখানা গড়ে উঠে। আর এসব শিল্প-কারখানার চারপাশে অতিরিক্ত লোক সমাগম হয়।

৩. জলবায়ু :

অনুকূল জলবায়ু অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড সম্পন্ন করা সহজ হওয়ায় অধিক জনসংখ্যা বাস করে। নাতিশীতোষ্ণ বা সমভাবাপন্ন অঞ্চলের দেশগুলোতে জনসংখ্যা তুলনামূলক বেশি।

৪. প্রাকৃতিক সম্পদ :

অতিরিক্ত জনসংখ্যার একটি অন্যতম কারণ প্রাকৃতিক সম্পদ। কেননা, মানুষ প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ ও ব্যবহার করে জীবিকা নির্বাহ এবং শিল্পোন্নয়ন করে থাকে।

৫. পানির পর্যাপ্ততা :

জীবনধারণের জন্য অপরিহার্য পানি। পানির পর্যাপ্ততাকে কেন্দ্র করে জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি হয়ে থাকে। সাধারণত নদী অববাহিকা অঞ্চলে বিভিন্ন শিল্প-কারখানা স্থাপন, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার লাভ করায় অতিরিক্ত জনসংখ্যা পরিলক্ষিত হয়।

আরও পড়ুন :- শব্দ দূষণ কি?

৬. পরিবহন ও যোগাযোগ :

পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হলে অধিক জনসমাগম হয়। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চল ব্যতীত সারা দেশে সড়ক, রেল ও নৌ যোগাযোগ সহজ হওয়ায় সর্বত্র জনসংখ্যার চাপ বেশি।

৭. শিক্ষা ও জন্মনিয়ন্ত্রণ :

সাধারণত সুশিক্ষায় শিক্ষিত না হলে মানুষজন অধিক সন্তান গ্রহণ করে থাকে। শহরের তুলনায় গ্রামের লোকজন কম শিক্ষিত হওয়ার গ্রামে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বেশি এবং জন্মনিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে সচেতন না হওয়ায় জনসংখ্যাও অধিক।

৮. মৃত্যুহার হ্রাস ও প্রজনশীলতা :

জনসংখ্যা অতিরিক্ত হওয়ার আরও একটি কারণ হলো মৃত্যুহার হ্রাস। চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে শিশু ও মাতৃ মৃত্যুহার হ্রাস পেয়েছে। প্রজননশীলতার হার বেশি হলে তা জনসংখ্যার উপর প্রভাব ফেলে।

৯. দারিদ্রতা ও নিম্ন জীবনযাত্রার মান :

দারিদ্রতা ও নিম্ন জীবনযাত্রার মান অতিরিক্ত জনসংখ্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সাধারণত দরিদ্র লোকজন এবং প্রত্যন্ত এলাকায় বসবাসকারী লোকজন জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য শহর এলাকায় ছুটে যায়। ফলে শহরাঞ্চলে অতিরিক্ত জনসংখ্যা দেখা যায়।

১০. নগরায়ন :

নগরায়নের সঙ্গে সঙ্গে জনসংখ্যা বাড়তে থাকে। নগরে বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মকাণ্ডে অসংখ্য মানুষ সম্পৃক্ত থাকে।

১১. জাতিগত দ্বন্দ্ব ও যুদ্ধ বিগ্রহ :

জাতিগত দ্বন্দ্ব এবং যুদ্ধ বিগ্রহের কারণে লোকজন পার্শ্ববর্তী দেশে আশ্রয় গ্রহণ করে। ফলে যে দেশে আশ্রয় গ্রহণ করে সে দেশে জনসংখ্যার চাপ পড়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ- সিরিয়া এবং ইরাকে অভ্যন্তরীণ গোলযোগের কারণে অনেক লোক পার্শ্ববর্তী দেশে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটে গেছে।
জনসংখ্যার কারণ ও প্রভাব

অতিরিক্ত জনসংখ্যার কারণে সৃষ্ট প্রভাব :-

কোনো দেশের জনসংখ্যা তার ধারণ ক্ষমতার বেশি হলে দৈনন্দিন জীবনে বিভিন্ন ধরনের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। বিশ্বব্যাপী অতিরিক্ত জনবহুল অঞ্চল বা দেশগুলোকে যেসব সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় সেগুলো নিম্নে তুলে ধরা হলো।

১. কৃষি জমি হ্রাস ও ভূমি খণ্ডিতকরণ :

অতিরিক্ত জনসংখ্যাজনিত কারণে কৃষি জমির উপর প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। অতিরিক্ত জনসংখ্যার জন্য অবকাঠামো নির্মাণে কৃষি জমি ব্যবহার করা হয়। এছাড়া খাদ্যদ্রব্যের চাহিদা মিটাতে গিয়ে অধিক ফসল চাষ করতে হয়। ফলে জমিতে বিভিন্ন প্রকার সার ও কীটনাশক প্রয়োগ করতে হয় যাতে জমির গুণগত মান হ্রাস পেয়ে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পড়ে। আবার পরিবারের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে প্রতিনিয়ত জমি খণ্ড-বিখণ্ড হচ্ছে।

২. উন্মুক্ত স্থান হ্রাস এবং জলাশয় ও নদী ভরাট :

অতিরিক্ত জনসংখ্যার জন্য উন্মুক্ত স্থান বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হয়। তাছাড়া যে সকল অঞ্চলে ছোট জলাশয় ও নদী রয়েছে সেগুলোর উভয় পাশে আবাস গড়ে তোলায় পরিবেশের ভারসাম্যে চাপ পড়ে।

৩. বনভূমি হ্রাস :

স্বাভাবিকভাবেই অতিরিক্ত জনসংখ্যার কারণে বনভূমির উপর চাপ পড়ে। ফলে বনের গাছপালা কর্তনের মাধ্যমে বিভিন্ন চাহিদা পূরণ করতে হয়।


৪. খাদ্য ও পুষ্টির অভাব :

কোনো দেশের জনসংখ্যা অতিরিক্ত হলে যে সকল মৌলিক চাহিদার উপর প্রভাব পড়ে তার মধ্যে অন্যতম হলো খাদ্য ও পুষ্টি। আমরা যদি বিশ্বের অতিরিক্ত জনবহুল অঞ্চল বা শরণার্থী শিবির দেখি তাহলে দেখা যাবে যে সেখানে খাদ্য ও পুষ্টি ঘাটতি রয়েছে।

৫. বাসস্থানের অভাব :

মানুষের মৌলিক চাহিদার অন্যতম হলো বাসস্থান। অতিরিক্ত জনসংখ্যার জন্য বাসস্থান সংকুলান করতে না পারলে ঘিঞ্চি পরিবেশে বা খোলা আকাশের নিচে তাবু টেনে দিনানিপাত করতে হয়।

৬. কর্মসংস্থানের অভাব ও মাথাপিছু আয় হ্রাস :

জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে পাল্লা দিয়ে চাকুরিতে পদ বাড়ছে না। এতে বেকার সমস্যা দেখা দেয়। একই সাথে মাথাপিছু আয় হ্রাস পায়। ফলে বেকারত্ব ও মাথাপিছু নিম্ন আয়ের কারণে সামাজিক অস্থিতিশীলতা দেখা যায়।

৭. বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ ও যাতায়াত ব্যবস্থা :

জীবনধারণের জন্য আবশ্যকীয় উপাদান জল। বর্ধিত জনসংখ্যার জন্য পানিয় জল সরবরাহ বিঘ্ন ঘটে। এছাড়া যাতায়াত ব্যবস্থাও প্রভাবিত হয়।

৮. চিকিৎসা :

জনসংখ্যা অতিরিক্ত হলে সকল মানুষের চিকিৎসা সেবা প্রদান কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে চিকিৎসার জন্য দূর দূরান্তে ছুটে যেতে হয়। আবার অনেকে সুচিকিৎসা না পেয়ে ধুকে ধুকে মৃত্যু পথযাত্রী হয়।

৯. পরিবেশের উপর প্রভাব :

অতিরিক্ত জনসংখ্যার ফলে চারপাশের পরিবেশের উপর প্রভাব পড়ে। পানি দূষণ, শব্দ দূষণ, পাহাড় কর্তন, জীববৈচিত্র্য বিনষ্ট ইত্যাদির মাধ্যমে পরিবেশের ভারসাম্য বিঘ্নিত হয় ।

এছাড়া অতিরিক্ত জনসংখ্যার ফলে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি, সামাজিক নিরাপত্তা বিঘ্ন, জীবনযাত্রার মান হ্রাস এবং বৈদেশিক সাহায্য নির্ভরতা দেখা দেয়। সাধারণত অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশে অতিরিক্ত জনসংখ্যার জন্য বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। তাই একটি দেশের সম্পদ এবং জনসংখ্যার মধ্যে ভারসাম্য থাকা উচিৎ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ