বায়ুমণ্ডল কাকে বলে? বায়ুমন্ডলের স্তর কয়টি? বায়ুমন্ডলের উপাদান ও গুরুত্ব?

বায়ুমন্ডলের ইংরেজি প্রতিশব্দ Atmosphere। বায়ুমন্ডল পৃথিবীর অপরিহার্য অংশ। এটি আমরা দেখতে পাইনা কিন্তু অনুভব করতে পারি। বায়ুমন্ডল মাধ্যাকর্ষণ শক্তির ফলে পৃথিবীর গায়ের সাথে লেগে থাকে এবং আবর্তন করে। তবে বায়ু কঠিন ভূমির সাথে সমানভাবে চলতে না পারার সামান্য পশ্চাতে পড়ে থাকে।

বিজ্ঞানীগণের ধারণা, বায়ুমণ্ডলের বয়স প্রায় ৩৫০ কোটি বছর। বায়ুমণ্ডল ভূ-অভ্যন্তরের নির্গত গ্যাস থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে। ভূ-পৃষ্ঠ থেকে উপরের দিকে মাত্র ৩০ কিলোমিটারের মধ্যে বায়ুমন্ডলের ৯০ শতাংশ অবস্থান করছে। ভূ-পৃষ্ঠ থেকে উপরের দিকে প্রায় ১০,০০০ কিলোমিটার পর্যন্ত বায়ুমণ্ডল বিস্তৃত।

বায়ুমণ্ডল কাকে বলে :-

পৃথিবী পৃষ্ঠের চারপাশে বেষ্টন করে যে অদৃশ্য বায়বীয় আবরণ রয়েছে তাই হলো বায়ুমণ্ডল।

সহজ ভাষায় বায়ুমণ্ডল কাকে বলে? এর উত্তরে বলা হয়, ভূ-পৃষ্ঠের চারপাশ যে বায়বীয় আবরণ দ্বারা বেষ্টিত রয়েছে তাকেই সহজ ভাষায় বলা হয় বায়ুমণ্ডল।

বায়ুমণ্ডলের স্তর কয়টি :-

বায়ুমণ্ডল বিভিন্ন স্তরে স্তরে সজ্জিত। বায়ুমন্ডলের স্তরসমূহের মধ্যে সর্বনিম্ন স্তর থেকে উপরের দিকে ক্রমশ লঘু হয়। উলম্বভাবে (Vertically) বায়ুর তাপমাত্রার বিন্যাসের ভিত্তিতে বায়ুমন্ডলকে পাঁচটি স্তরে ভাগ করা যায়।
  1. ট্রেপোমণ্ডল [Troposphere],
  2. স্ট্রাটোমন্ডল [Stratosphere]
  3. মেসোমণ্ডল [Mesosphere])
  4. তাপমণ্ডল [Thermosphere] এবং
  5. এক্সোমণ্ডল [Exosphere]

বায়ুমণ্ডলের উপরিউক্ত ওরগুলোর মধ্যে প্রথম তিনটি ( ট্রেপোমণ্ডল [Troposphere], স্ট্রাটোমন্ডল [Stratosphere] ও মেসোমণ্ডল [Mesosphere]) সমমন্ডলের অন্তর্ভুক্ত এবং শেষের দুইটি (তাপমণ্ডল [Thermosphere] ও এক্সোমণ্ডল [Exosphere] ) বিষমমণ্ডলের অন্তর্ভুক্ত।

১) ট্রোপোস্ফিয়ার বা ঘনমণ্ডল:-

ভূপৃষ্ঠ থেকে ১৮ কিলোমিটার পর্যন্ত ঊর্ধ্বের বায়ুস্তরকে ট্রপোস্ফিয়ার বা ঘনমণ্ডল বলে। বায়ুমণ্ডলের এই স্তরে আমরা বাস করি।

ট্রপো (Tropo) ইংরেজি শব্দটির অর্থ পরিবর্তন (Change) এবং দৈনন্দিন আবহাওয়ায় আমরা যেরকম বিভিন্ন পরিবর্তন অনুভব করি, এই বায়ুস্তরেও সে ধরনের পরিবর্তন দেখা যায় ।

ট্রোপোস্ফিয়ারের বৈশিষ্ট্য:-

(ii) মেরু অঞ্চলে [Poles) ট্রপোস্ফিয়ার প্রায় ৯ কিলোমিটার ঊর্ধ্বে বিস্তৃত এবং নিরক্ষরেখার [Equator] ওপর ট্রপোস্ফিয়ারের উচ্চতা প্রায় ১৮ কিলোমিটার।

(ii) বায়ুমণ্ডলের এই স্তরে বায়ুতে প্রায় ৯০% ধূলিকণা, জলীয় বাষ্প, কুয়াশা মেঘ প্রভৃতি থাকায় এই স্তরে ঝড়, বৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি, বজ্রপাত, তুষারপাত প্রভৃতি ঘটনাগুলি ঘটতে দেখা যায়, এজন্য ভূপৃষ্ঠ সংলগ্ন বায়ুমণ্ডলকে 'ক্ষুব্ধ মন্ডল' বলে ।

(iii) বায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন স্তরের মধ্যে ট্রপোস্ফিয়ারই হল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তর । বায়ুমণ্ডলের প্রায় ৭৫% গ্যাসীয় পদার্থ এই স্তরে থাকায় এখানে বায়ুরচাপ সবচেয়ে বেশি।

(Iv) ট্রপোস্ফিয়ারের ওপরের স্তরে জলীয়বাষ্প বা মেঘ থাকে না বললেই চলে।

(v) বায়ুমণ্ডলের এই স্তরে ভূপৃষ্ঠ থেকে যতই উপরে ওঠা যায় ততই তাপ মাত্রা কমতে থাকে । প্রতি কিলোমিটারে ৬.৪° বা প্রায় প্রতি ১৬৫ মিটার উচ্চতার জন্য ১° সেন্টিগ্রেড করে তাপ কমে যায়, 'একে উত্তাপ কমে যাওয়ার গড় (Average Lapse rate of temperature) বলে। ভূ- পৃষ্ঠের ওপরে ১০-১৩ কিলোমিটার উচ্চতায় বায়ুর তাপ এই হারে কমতে থাকে। মধ্য অক্ষাংশে (Middle Latitude) ট্রপোস্ফিয়ারের ঊর্ধ্ব সীমানায় বায়ুমণ্ডলের উত্তাপ ৭৫° সেন্টিগ্রেড থেকে ৬০° সেন্টিগ্রেড হয়।

(vi) এই অংশে উচ্চতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বায়ুর চাপ কমতে থাকে। এই স্তরে বায়ুর ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি প্রায় শতকরা ৯০ ভাগ ।


ট্রোপোপজ [Tropopause):-

ট্রোপোস্ফিয়ার এবং স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার- এই দুই বায়ুস্তরের সীমা নির্দেশক সংযোগ স্থলকে ট্রোপোপজ বলে।

ট্রপোস্ফিয়ার বায়ুস্তর এই অঞ্চলে এসে থেমে যায়, তাই একে ট্রপোপজ বলে।

ট্রোপোপজ অঞ্চলে নিরক্ষরেখার ওপর বায়ুর তাপমাত্রা ৮০° সেন্টিগ্রেড এবং মেরুদ্বয়ের ওপর -৪৫° সেন্টিগ্রেড হয়ে থাকে, কারণ মেরুদ্বয়ের ওপর যেখানে ট্রিপোপজের উচ্চতা মাত্রা ৮ কিমি সেখানে নিরক্ষরেখার ওপর ট্রোপোপজের উচ্চতা ১৮ কিমি । টপোপজের স্তরে বায়ু চলাচল বা তাপীয় ফল তেমন দেখা যায় না, তাই এই স্তরকে স্তব্ধ স্তরও বলে।
বায়ুমণ্ডল কাকে বলে

২) স্ট্রাটোস্ফিয়ার বা শান্তমণ্ডল:-

বায়ুমণ্ডলের দ্বিতীয় স্তরটি হলো স্ট্রাটোমণ্ডল। যা ভূ-পৃষ্ঠ থেকে উপরের দিকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। এ স্তরের শেষ সীমা স্ট্রাটোবিরতি (Stratopause)।

ট্রপোস্ফিয়ার এর ওপরের ১৮ থেকে ৮o কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত বায়ুস্তরকে স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার বা শান্তমণ্ডল বলে।

স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারের বৈশিষ্ট্য:-

(i) স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার স্তরে ধূলিকণা, মেঘ প্রভৃতি না থাকায় এখানে ঝড়, বৃষ্টি, বজ্রপাত প্রভৃতি প্রাকৃতিক ঘটনা ঘটে না।

(ii) স্ট্রাটোপজ তাপমাত্রা ০° সেলসিয়াস বা এর কাছাকাছি হয়। এ স্তরে বায়ুর ঘনত্ব ও চাপ উভয়ই কম।

(iii) এ স্তরে বাতাস অত্যন্ত হালকা। বাতাসের ঊর্ধ্ব বা নিম্ন গতি নেই, তবে সমান্তরাল গতি দেখা যায়।

(iv) ফ্র্যাটোস্ফিয়ার স্তরে বায়ুপ্রবাহ, মেঘ, ঝড়, বৃষ্টি ও বজ্রপাত দেখা যায় না বলে দ্রুতগতিসম্পন্ন জেটবিমানগুলো ঝড়-বৃষ্টি এড়িয়ে চলার জন্য স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারের মধ্য দিয়ে চলাচল করে। জেটবিমানগুলি সাধারণত এই স্তরের মধ্যে দিয়ে চলার সময়ে আকাশে সাদা দাগ রেখে যায়।

স্ট্রাটোমন্ডলের উপরের দিকে ওজোন (zone) গ্যাসের স্তর রয়েছে যা ওজোন মণ্ডল বা Ozonesphere নামে পরিচিত। এ স্তরটির গভীরতা ১২-১৬ কিলোমিটার। ওজোন স্তর সূর্যরশ্মির অভি বেগুনি রশ্মি (Ultra Violet Rays) শোষণ করে। জীবজগতের জন্য সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি খুবই ক্ষতিকর। তবে এটি ওজোন স্তর ভেদ করে পৃথিবীতে পৌঁছাতে পারে না। এ স্তর সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মি শোষণ করায় তাপমাত্রা (প্রায় ৭৬° সেলসিয়াস) অনেক বেশি।

আরও পড়ুন:- জীববৈচিত্র কাকে বলে?

স্ট্র্যাটোপজ [Stratopause]:-

স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারের মধ্যে দিয়ে যতই উঁচুতে ওঠা যায় ততই উত্তাপ ক্রমশ বাড়তে থাকে এবং (উত্তাপ) ৫০ কিমি উচ্চতায় সর্বোচ্চ (o ডি:সেন্টিগ্রেড) হয়। তবে ৫০ কিমির বেশি উচ্চতা থেকে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা আবার কমতে শুরু করে, অর্থাৎ তাপমাত্রার বৃদ্ধি থেমে যায় বা পজ করে।

মেসোস্ফিয়ারের মধ্যবর্তী অঞ্চলে তাপমাত্রার স্থিতাবস্থা থাকায় এই অঞ্চলকে স্ট্যাটোপজ স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার ও বলা হয়।

৩) মেসোস্ফিয়ার:-

স্ট্যাটোপজের ওপর থেকে বায়ুমণ্ডলের যতদূর উচ্চতা পর্যন্ত উষ্ণতা কমতে থাকে, সেই অংশটিকে মেসোস্ফিয়ার বলে।

মেসোস্ফিয়ার স্তরটি স্ট্র্যাটোপজ স্তরের ওপর ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৮০ কিমি উচ্চতা পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। ভূপৃষ্ঠ থেকে ৮ কিমি উচ্চতায় এই স্তরে বায়ুর তাপমাত্রা সবচেয়ে কম থাকে (কম বেশি -৯৩ ডি: সেলসিয়াস)। মহাকাশ থেকে যেসব উল্কা পৃথিবীর দিকে ছুটে আসে সেগুলি মেসোস্ফিয়ার ভরের মধ্যে এসে পুড়ে ছাই হয়ে যায়।

মেসোপজ (Mesopause):

মেসোস্ফিয়ারের ওপরে যে উচ্চতায় তাপমাত্রা হ্রাস পাওয়া থেমে যায়- অর্থাৎ পজ করে, তাকে মেসোপজ বলে।

মেসোস্ফিয়ারের বৈশিষ্ট্য :-

(i) এ স্তরে বায়ুর চাপ অত্যন্ত কম এবং মেঘ ও জলীয়বাষ্পহীন।

(ii) এ স্তরে ৫০ কিলোমিটার উচ্চতায় বায়ুর চাপ ১ মিলিবার থেকে কমে ৯০ কিলোমিটার উচ্চতায় এর মান দাঁড়ায় ০.০১ মিলিবার।

(iii) এ স্তরের শুরু থেকেই উষ্ণতা হ্রাস পেতে থাকে এবং শেষ সীমা অর্থাৎ মেসোপজে (Mesopause) প্রায় ৯০° সেলসিয়াসে নেমে আসে।

৪) তাপমণ্ডল :-

ভূ-পৃষ্ঠ থেকে উপরের দিকে ৮০ কিলোমিটার ঊর্ধ্বসীমা থেকে অর্থাৎ মেসোপজ থেকে তাপমন্ডলের শুরু। এ স্তরের উপরের সীমা ৫০০ কি.মি. পর্যন্ত। এখানে বায়ুমণ্ডল অত্যন্ত হালকা এবং বায়ুচাপ ক্ষীণ। তাপমন্ডলের ১০০ থেকে ৩০০ কি.মি. উচ্চতায় অক্সিজেন ও নাইট্রোজেন পরমাণু অত্যন্ত ছোট তরঙ্গমাপের সৌরশক্তি শোষণ করায় উষ্ণতা প্রায় ১০০০° সেলসিয়াস পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে।

তাপমন্ডলে আয়নিত এ অংশ আয়নমণ্ডল ( ionosphere) নামে পরিচিত। আয়নমন্ডল মূলত মেসোমন্ডলের ঊর্ধ্বাংশ থেকে তাপমন্ডলের নিম্নাংশ (৫০ থেকে ১০০ কিলোমিটার) পর্যন্ত সম্প্রসারিত। আয়নমন্ডলে বেতার তরঙ্গ প্রতিফলিত হয়ে ভূ-পৃষ্ঠে ফিরে আসে।

আরও পড়ুন:- পরিবেশ দূষণ কাকে বলে?

তাপমণ্ডলের বৈশিষ্ট্য:-

(i) স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারের ওপরে ভূপৃষ্ঠ থেকে ৮০ কিলোমিটার উচ্চতায় বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা- ৯৩° সেলসিয়াস থেকে বাড়তে বাড়তে ৫০০ কিলোমিটার উচ্চতায় প্রায় ১০০০° সেলসিয়াসে পরিণত হয়।

(ii) প্রখর সূর্য কিরণের জন্য হালকা বায়ু দিয়ে গঠিত এই স্তরে বায়ুমণ্ডলের মোট ভরের মাত্র ০.৫% আছে।

(iv) এই স্তরের বায়ু আয়নিত অবস্থায় রয়েছে (এই বিরাট অঞ্চলটি বিদ্যুতযুক্ত অসংখ্য কণা অর্থাৎ, আয়ন ও ইলেকট্রনে পূর্ণ হয়ে আছে)। এখানে হাইড্রোজেন, হিলিয়াম, ওজোন প্রভৃতি গ্যাস আয়নিত অবস্থায় থাকে।

(v) ভূপৃষ্ঠের বেতার তরঙ্গগুলি আয়নোস্ফিয়ার ভেদ করে আরও ওপরে যেতে পারে না বলে এই স্তর থেকে বেতার তরঙ্গ প্রতিফলিত হয়ে পৃথিবীতে ফিরে আসে।

৫) এক্সোমণ্ডল :-

তাপমণ্ডলের উপরে ৯৬০ কিলোমিটার পর্যন্ত যে বায়ুস্তর রয়েছে তাকে এক্সোমণ্ডল বলে।

এক্সোমণ্ডলের বৈশিষ্ট্য:

(i) এই স্তরে হিলিয়াম এবং হাইড্রোজেন গ্যাসের পরিমাণ সর্বাধিক।

(ii) এ মন্ডলে তাপমাত্রা ৩০০ থেকে ১৬৫০° সেলসিয়াস পর্যন্ত হয়।

(iii) এ স্তরে সামান্য পরিমাণে আর্গন, হিলিয়াম, অক্সিজেন প্রভৃতি রয়েছে।

ম্যাগনেটোস্ফিয়ার [Magnetosphere]-

এক্সোস্ফিয়ারের উপরে অবস্থিত বায়ুমণ্ডলের সর্বশেষ স্তরকে ম্যাগনেটোস্ফিয়ার বলে। এই স্তরের জন্য পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের আয়নিত কণার উপস্থিতি নিয়ন্ত্রিত হয়।

এয়ারোনমি Aeronomy:-

আবহবিদ্যায় ভূপৃষ্ঠের উপরে প্রায় ১০০ কি.মি. পর্যন্ত বায়ুমণ্ডলের স্তর সম্মন্ধে আলোচনা করা হয়। এর উপরে বায়ুমণ্ডলের যে স্তর রয়েছে সে সম্মন্ধে যে শাস্ত্রে আলোচনা করা হয়, তার নাম এয়ারোনমি।


বায়ুমণ্ডলের উপাদান :-

বায়ুমণ্ডল বিভিন্ন প্রকার গ্যাসীয় পদার্থ ও জলীয়বাষ্পের সংমিশ্রনে গঠিত। বায়ুমন্ডলের প্রধান দুটি উপাদান হলো নাইট্রোজেন (৭৮.০২%) এবং অক্সিজেন (২০.৭১%), যা মোট উপাদানগুলোর প্রায় ৯৯%। অবশিষ্ট ১% অন্যান্য উপাদান।

ভূ-পৃষ্ঠ থেকে উপরের দিকে প্রায় ৯০ কিলোমিটার পর্যন্ত বায়ুমন্ডলের উপাদানগুলো প্রায় একই রকম থাকে যা সমমন্ডল (Homosphere) নামে পরিচিত।

আর ভূ-পৃষ্ঠ সংলগ্ন এই ৯০ কিলোমিটারের ঊর্ধ্বে বায়ুমণ্ডলের যে অংশ রয়েছে সেখানে বিভিন্ন গ্যাসের অনুপাত সমান থাকে না বলে তাকে বিষমমণ্ডল (Heterosphere) বলে।

বায়ুমন্ডল গঠনকারী উপাদানগুলোকে তিনটি ভাগে ভাগ করা করা যায়। যথা
  • গ্যাসীয়
  • জলীয়বাষ্প
  • ধূলিকণা


ক. গ্যাসীয় উপাদান :-

বায়ুমন্ডলের গ্যাসীয় উপাদানগুলো নিম্নরূপ :

১. নাইট্রোজেন (Nitrogen):

নাইট্রোজেন বায়ুমণ্ডলে নিষ্ক্রিয় গ্যাস হিসেবে অবস্থান করে। এটি ধ্রুব (Constant) যা অপরিবর্তনীয়। বায়ুমন্ডলের নাইট্রোজেন অক্সিজেনের দ্রাবক হিসেবে কাজ করে। এর দ্বারা বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়ার ক্রিয়া পরিবর্তিত এবং যৌগ গঠিত হয়, যা খাদ্য উৎপাদন ও অঙ্গজ গঠনে উদ্ভিদজগতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

এছাড়া জীবজগতের প্রোটিন জাতীয় খাদ্য প্রস্তুত করতে সাহায্য করে। নাইট্রোজেন সরাসরি কোনো প্রাণী কিংবা উদ্ভিদকে বাঁচিয়ে রাখে না। তবে নাইট্রোজেন ছাড়া কোনো প্রাণী কিংবা উদ্ভিদ বাঁচতে পারে না।

২. অক্সিজেন (Oxygen):

অক্সিজেন একটি সক্রিয় গ্যাস। কারণ এটি অন্য মৌলের সাথে সহজেই যৌগ গঠন করে। প্রাণির জীবনধারণের জন্য অক্সিজেন অপরিহার্য।

অক্সিজেন প্রাণীর শ্বাস গ্রহণ এবং শক্তি ও উত্তাপ বৃদ্ধির কাজে ব্যবহৃত হয়। অক্সিজেনের ব্যাপক ব্যবহারের পরও বায়ুমন্ডলে এর পরিমাণ প্রায় একই রকম থাকে।

৩. কার্বন ডাই-অক্সাইড (Carbon diOxide):

বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ মাত্র ০.০৩% হলেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ উদ্ভিদের সালোকসংশেষণ (Photosynthesis) প্রক্রিয়ায় খাদ্য উৎপাদনের জন্য আবশ্যকীয় উপাদান কার্বন ডাই-অক্সাইড।

এছাড়া তাপ শোষণ ও জলবায়ু নিয়ন্ত্রণেও এটি ভূমিকা রাখে। ভূ-পৃষ্ঠের সর্বত্র কার্বন ডাই- অক্সাইড এর পরিমাণ সমান থাকে না। মানুষের বিভিন্নমুখী কর্মকান্ড যেমন- কাঠ কয়লা, খনিজ তেল প্রভৃতি জ্বালানি হিসেবে ব্যবহারের ফলে এর পরিমাণ স্থির না থেকে হ্রাস-বৃদ্ধি হয়।

৪. ওজোন (Ozone):

ওজোন বায়ুমণ্ডলের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এটি অক্সিজেনের তিনটি পরমাণু দ্বারা গঠিত। পৃথিবীতে বসবাসকারী জীবজগতের জন্য ওজোন স্তর গুরুত্বপূর্ণ।

আরও পড়ুন:- সৌরজগৎ কি?

এ গ্যাসটি সূর্যরশ্মির অতি বেগুনি রশ্মি বা Ultra Violet Rays শোষণ করে পৃথিবীকে প্রাণীর বসবাসের উপযোগী করে রাখে। সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মি ক্ষতিকর ক্যান্সার ও বিভিন্ন রোগ সৃষ্টি করতে পারে যা জীবজগতের জন্য ক্ষতির কারণ।

৫. অন্যান্য গ্যাসসমূহ:

অন্যান্য গ্যাসের মধ্যে আর্গন, নিয়ন, হিলিয়াম, ক্রিপটন, জেনন, হাইড্রোজেন, রেডন, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইড হলো নিষ্ক্রিয়। এসব গ্যাস কোনো রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে না।

খ. জলীয়বাষ্প :-

বায়ুমন্ডলের গুরুত্বপূর্ণ এ উপাদানটি সাধারণত নিম্নস্তরে থাকে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে বাতাসের জলীয়বাষ্প ধারণ ক্ষমতা বাড়ে এবং তাপমাত্রা কমে গেলে জলীয়বাষ্প ধারণ ক্ষমতা কমে যায়। এছাড়া অঞ্চল বা ঋতুভেদেও জলীয়বাষ্পের হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে।

জলীয়বাষ্পের অণুগুলো নাইট্রোজেন ও অক্সিজেন অণুগুলোর অনুরূপ বাতাসে ঘুরে বেড়ায়। জলীয়বাষ্পের প্রভাবে মেঘ, বৃষ্টি, তুষার, শিশির, কুয়াশা, ঝড় ইত্যাদি সৃষ্টি হয় যা পৃথিবী পৃষ্ঠে জলবায়ুগতভাবে বিশেষ প্রভাব ফেলে।

গ. ধূলিকণা (Dust):

বায়ুমণ্ডলের নিম্নস্তরে অতি সূক্ষ্ণ ধূলিকণা রয়েছে। এগুলো অন্যান্য গ্যাসের অণুর ন্যায় ভেসে বেড়ায়। ধূলিকণা, সাধারণত আগ্নেয়গিরির শিলাচূর্ণ ও ছাই, কল-কারখানার পোড়া ছাই, কয়লার গুড়া ও ধোঁয়া ইত্যাদি থেকে সৃষ্টি হয়ে বায়ুমণ্ডলে মিশে যায়।

বায়ুমন্ডলের ধূলিকণা জলীয়বাষ্পকে জলকণায় রূপান্তরিত হতে সাহায্য করে। এছাড়া ধূলিকণা বায়ুমণ্ডলকে উত্তপ্ত হতে সাহায্য করে এবং সূর্যরশ্মির তাপ শোষণ করে সৌরতাপ বন্টনে সহায়তা করে।

বায়ুমণ্ডলের গুরুত্ব :-

পৃথিবী সৌরজগতের সব থেকে আদর্শ ও বাসযোগ্য গ্রহ এবং বায়ুমন্ডল এই গ্রহে জীবজগতের বেঁচে থাকার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল।

বায়ুমন্ডলের বিভিন্ন স্তরে নানা রকম গ্যাসীয় উপাদান, জলীয়বাষ্প ও ধূলিকণার উপস্থিতির জন্য স্তরভেদে নানা পার্থক্য দেখা যায়। বায়ুমণ্ডলের গুরুত্বসমূহ এখানে আলোচনা করা হলো

১. বায়ুমণ্ডল প্রধানত উদ্ভিদ ও প্রাণিকূলের জীবন রক্ষায় পূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি শুষে নেয় এবং এর বিভিন্ন গ্যাসীয় উপাদান যেমন- অক্সিজেন ও কার্বন ডাই-অক্সাইড উদ্ভিদ ও প্রাণিকে বাঁচিয়ে রাখতে সাহায্য করে।

২. বায়ুমণ্ডলে জলীয়বাষ্প আছে বলেই মেঘ সৃষ্টি হতে পারে। ফলে বৃষ্টি হয় এবং জীবজগৎ রক্ষা পায়।


৩. মানুষ তার নানা প্রয়োজনে প্রকৃতিকে ব্যবহার করতে গিয়ে পরিবেশের ক্ষতি করছে। যেমন- প্রচুর পরিমানে গাছ পালা ও বন-জঙ্গল নিধন, প্রাকৃতিক গ্যাস, কয়লা ইত্যাদি পোড়ানো এবং তা থেকে নির্গত কালো ধোঁয়া, যানবাহনের কালো ধোঁয়া ও বিষাক্ত গ্যাস বায়ুমণ্ডলের জন্য ক্ষতিকর। তাই প্রাকৃতিক পরিবেশ অর্থাৎ জীবজগতের বেঁচে থাকার জন্য বায়ুমণ্ডলের বিশুদ্ধতা বজায় রাখা জরুরি।

৪. বায়ুমণ্ডলকে বিশুন্ধ না রাখলে উদ্ভিদ ও প্রাণির শুধু জীবন বিপর্যয় হবে না, সেই সাথে ভবিষ্যতের প্রাকৃতিক পরিবেশ হুমকির সম্মুখীন হবে।

৫. বায়ুর নানা গ্যাসীয় উপাদান যেমন- কার্বন ডাই-অক্সাইড এর সাহায্যে উদ্ভিদ খাদ্য প্রস্তুত করে, জলীয়বাষ্প নিয়ন্ত্রণ করে । এছাড়াও চুনা জাতীয় খনিজ পদার্থ গঠন ও পৃথিবীতে তাপের বন্টন ও প্রতিফলনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।

৬. বায়ুমণ্ডল না থাকলে কোনো শব্দতরঙ্গ স্থানান্তরিত হয় না। কারণ পৃথিবী হতে পাঠানো বেতার তরঙ্গ আয়নমণ্ডলে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে ফিরে আসে।

৭. বায়ুমণ্ডলের নানা স্তরে বায়ুর চাপের পার্থক্য দেখা যায়। তাই বায়ুমণ্ডলে বায়ুর ওজন ও চাপ এর ভারসাম্য সঠিক না হলে আমরা চলাফেরা করা বা দাঁড়াতে পারতাম না।

৮. বায়ুমন্ডলের মধ্যে ওজোন স্তর আছে বলে সূর্য হতে আগত অতিবেগুনী রশ্মির হাত হতে পৃথিবীর জীবজগৎ রক্ষা পায়। এমনকি বায়ুমন্ডলের স্তরে উল্কাপিন্ড বিধ্বস্ত না হলে তা সরাসরি পৃথিবীতে আঘাত হানতো।

৯. বায়ুমণ্ডল মূলত একটি তাপনিরোধক আবরণ যা জীবজগৎকে সৌরতাপ শক্তি হতে রক্ষা করে।

১০. বায়ুমণ্ডলে নাইট্রোজেন এর মাত্রা বেশি থাকায় এর দ্বারা উদ্ভিদজগৎ প্রোটিন জাতীয় খাদ্য প্রস্তুত করে এবং জীবজগৎ ঐ উদ্ভিদ থেকে প্রয়োজনীয় প্রোটিন গ্রহণ করতে পারে।

১১. ট্রপোমণ্ডল না থাকলে আবহাওয়া সৃষ্টি হতো না এবং মেঘ-বৃষ্টি, তুষার, কুয়াশা ইত্যাদি না থাকলে শস্য ও বনভূমির জন্য বৃষ্টিপাত পাওয়া যেত না।

আরও পড়ুন :- দূষণ কাকে বলে?

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ