রাষ্ট্রীয় ব্যবসায় কাকে বলে? রাষ্ট্রীয় ব্যবসায়ের প্রকারভেদ এবং সুবিধা ও অসুবিধা?

দেশের সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করার লক্ষ্যেই রাষ্ট্রীয় সংগঠন গড়ে ওঠে। লাগামহীন পর্যায়ে ব্যবসায় জগৎকে ছেড়ে দেওয়া অযৌক্তিক, এ বিবেচনা থেকে সমাজতন্ত্রের মতবাদ থেকে রাষ্ট্রীয় সংগঠন বা রাষ্ট্রীয় ব্যবসায়ের জন্ম।

বর্তমানে প্রায় সকল দেশেই কোনো না কোনো রাষ্ট্রীয় ব্যবসায় দেখা যায়। অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, যে সব ব্যবসায় সংবেদনশীল কিংবা জনকল্যাণের নিমিত্তে সেই সব ব্যবসায়গুলো রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন থাকাই শ্রেয়। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলো সচরাচর মুনাফাভোগী হয় না বরং জনসেবন নিয়োজিত থাকে। এ পোস্টে আমরা রাষ্ট্রীয় ব্যবসায় কাকে বলে? সে সম্পর্কে প্রাথমিক কিছু প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা শুরু করবো।

রাষ্ট্রীয় ব্যবসায় কাকে বলে :-

এক কথায় বলতে গেলে রাষ্ট্রের মালিকানাধীন ব্যবসায়ই রাষ্ট্রীয় ব্যবসায় বা সংগঠন।

সাধারণত জনস্বার্থে কিংবা রাষ্ট্রের নিরাপত্তার খাতিরে সরকার এ ধরনের ব্যবসায়ের মালিকানা গ্রহণ করে থাকেন। নতুন করে স্থাপন বা বর্তমান প্রচলিত ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানকে রাষ্ট্রায়ত্তকরণের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ব্যবসায় প্রতিষ্ঠা লাভ করে থাকে।

দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সাধন, নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, বেকার সমস্যার সমাধান, প্রাকৃতিক সম্পদের সুষম বণ্টন ও যথাযথ ব্যবহার, দেশ রক্ষা, জনকল্যাণ, অর্থনৈতিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি সাধনের লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয় ব্যবসায় প্রতিষ্ঠা করা হয়।

আরও পড়ুন:- বণ্টন প্রণালি কাকে বলে?

সুতরাং রাষ্ট্রীয় ব্যবসায় কাকে বলে? এর উত্তরে বলা যায় সরকার কিংবা রাষ্ট্র কর্তৃক স্থাপন অথবা বিশেষ আদেশের বলে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন আনয়নের মাধ্যমে সরকার বা সরকারি প্রতিনিধি কর্তৃক পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত ব্যবসায়কেই বোঝায়।

অন্য কথায়, স্থাপন বা জাতীয়করণের মাধ্যমে আত্মীকৃত এবং পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে সরকারি নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানকেই রাষ্ট্রীয় ব্যবসায় বলে।

রাষ্ট্রীয় ব্যবসায় সরকারি কোনো দপ্তরের নিয়ন্ত্রণে সরকারি কর্মচারী বা প্রতিনিধি কর্তৃক পরিচালিত হয়ে থাকে। এ ধরনের ব্যবসায়ের মুনাফা সরকারি ইচ্ছায় জনকল্যাণার্থে ব্যয়িত হয়।
রাষ্ট্রীয় সংগঠন বা ব্যবসায় কী

রাষ্ট্রীয় ব্যবসায়ের প্রকারভেদ :-

রাষ্ট্রীয় ব্যবসায় সাধারণত চার প্রকার।

১. সরকারি বিভাগীয় সংগঠন।
২. বোর্ড প্রশাসিত সরকারি সংগঠন।
৩. বিধিবন্ধ রাষ্ট্রীয় সংস্থা ও
৪. সরকারি যৌথ মূলধনী কোম্পানি।

রাষ্ট্রীয় ব্যবসায়ের সুবিধা :-

রাষ্ট্রীয় ব্যবসায় জনকল্যাণের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, মুনাফা অর্জনের জন্য নয়। দেশের সম্পদ যাতে মুষ্টিমেয় লোকের হাতে কেন্দ্রীভূত না হয়, তা দূর করার জন্যও রাষ্ট্রীয় ব্যবসায় স্থাপন করা হয়েছে।

তাছাড়া ব্যবসায় বাণিজ্যের ক্ষেত্রে "Laissez Faire Policy" বা ইচ্ছেমত চলতে দেয়ার নীতি এর অবসান ঘটিয়ে সরকারি নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রীয় ব্যবসায় প্রতিষ্ঠা করা হয়।

প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার, ভারি ও মৌলিক শিল্প স্থাপন, পরিকল্পিত অর্থনৈতিক উন্নয়ন, আঞ্চলিক বৈষম্য দূরীকরণ, বৈদেশিক বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি, শ্রমিকদের কল্যাণসাধন, ক্ষতিকারক পণ্যের উৎপাদন ও বন্টন, নিয়ন্ত্রন প্রভৃতি কাজের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ব্যবসায় জনগণকে সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে।

তাছাড়া জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে কোন কোন পণ্য বা সেবার ক্ষেত্রে গোপনীয়তা রক্ষা করা রাষ্ট্রীয় ব্যবসায়ের অন্যতম উদ্দেশ্য। যেমন- বোর্ডের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ছাপানো, টাকা ছাপানো গোপনীয় দলিলপত্রাদি ছাপানো, সমরাস্ত্র ও গোলাবারুদ তৈরি ইত্যাদি।

রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত ও নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানগুলোই এ সকল ক্ষেত্রে গোপনীয়তা রক্ষা করতে পারে। রাষ্ট্রীয় ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যই হলো জনগণের ভাগ্যোন্নয়নের লক্ষ্যে সম্পদগুলোর মাধ্যমে অধিক সেবা লাভের সুযোগ সৃষ্টি করা যেমন- বিদ্যুৎ, ওয়াসা, ডাক ও তার প্রাকৃতিক ও জ্বালানি, রেলওয়ে ইত্যাদি রাষ্ট্রীয় ব্যবসায়ের মাধ্যমে একদিকে যেমন জনসাধারনের উপকার হচ্ছে অন্যদিকে সম্পদ বিভাজনে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা হচ্ছে।

আরও পড়ুন:- নেতৃত্ব কাকে বলে?

রাষ্ট্রীয় ব্যবসায়ের অসুবিধা :-

ব্যবসায় একটি গতিশীল প্রক্রিয়া। বিশ্বায়ন ও তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে সর্বোচ্চ দক্ষতা, মেধা ও ইচ্ছাশক্তি খাটিয়ে প্রতিযোগিদের সাথে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়ে রাষ্ট্রীয় ব্যবসায় কতটুকু সফলতার সাথে এগিয়ে যাচ্ছে তা নিয়ে অনেকেই সন্দিহান। তাই রাষ্ট্রীয় ব্যবসায়ের বেশকিছু সীমাবদ্ধতা ও অসুবিধা পরিলক্ষিত হয়। যা নিম্নরূপ:

১. বিভিন্ন দেশের অধিকাংশ রাষ্ট্রীয় ব্যবসায়ই অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। তাই এখানে সরকারকে প্রচুর লোকসান বহন করতে হয়।

২. এ ধরনের ব্যবসায়ে উৎপাদিত অধিকাংশ পণ্য ও সেবার মান উন্নত নয়। জনগণ এ ব্যবসায় পছন্দ করে না।

৩. ‘শূণ্য চেয়ারে কোট ঝোলে' কথাটি রাষ্ট্রীয় ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে বেশি শোনা যায়। এ ব্যবসায়ের দৈনন্দিন কার্যকলাপে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ পরিলক্ষিত হয়। ফলে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও সংঘাতে রাষ্ট্রীয় ব্যবসায়ের উদ্দেশ্য অর্জন হয়।

৪. এ ব্যবসায়ের অধিকাংশ কর্মকর্তা ও কর্মচারী রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয় যা উন্নয়নের বাধা হিসেবে কাজ করে।

৫. পর্যাপ্ত মূদ্ধন বিনিয়োগের অভাবে এ ব্যবসায় সম্প্রসারণে অসুবিধা হচ্ছে।

৬. এ ব্যবসায়ে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা বিদ্যমান থাকায় কার্যসম্পাদনে গতিশীলতার অভাব রয়েছে, যা উন্নয়নের অন্যতম অন্তরায়।

৭. এ ধরনের ব্যবসায়ে অধিক সরকারি নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকে বিধায় কর্মকর্তা কর্মচারীরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না। এতে ব্যক্তিক উন্নয়নসহ প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্থ হয়।

৮. রাষ্ট্রীয় ব্যবসায়ের মালিক সরকার হওয়ায় এ ব্যবসায়ের উন্নয়নে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে কোন ব্যক্তিগত উৎসাহ লক্ষ্য করা যায় না।

৯. সরকারি ব্যবসায়ে উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা নিয়োগের ক্ষেত্রে দক্ষতার চেয়ে প্রায়ই রাজনৈতিক বিবেচনা প্রাধান্য পায়। এতে এর ব্যবস্থাপনা অনেক ক্ষেত্রেই অদক্ষ হয়ে থাকে।


১০. সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান হিসেবে সংসদে রাষ্ট্রীয় ব্যবসায়ের বিভিন্ন কার্যক্রমগুলো নিয়ে আইন সভা বা সংসদে খোলাখুলি আলোচনা হয়, ফলে ব্যবসায় গোপনীয়তা রক্ষা করা যায় না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ