ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা :-
ব্যবস্থাপনা বা ম্যানেজমেন্ট একটি নিরবচ্ছিন্ন কার্যক্রমের সমষ্টিগত প্রক্রিয়া। ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়ার কার্যসমূহ হচ্ছে পরিকল্পনা, সংগঠন, কর্মীসংস্থান, নির্দেশনা ও নেতৃত্বদান, প্রেষণা, সমন্বয়সাধন ও নিয়ন্ত্রণ। ব্যবস্থাপনা এমন সব মৌলক কার্য নির্দেশিকাকে বুঝায় যা ব্যবস্থাপনার জন্য পথ-নির্দেশ হিসেবে কাজ করে এবং যে কোন সংগঠনে প্রয়োগ করা যায়।ব্যবস্থাপকদের আদেশ-নির্দেশ দেয়ার অধিকার আছে যাতে তারা কর্মীদের দিয়ে কাজ করিয়ে নিতে পারে। কর্মীরা যাতে স্বাধীনভাবে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে। কর্মীদের উদ্যোগ উৎসাহিত করা ব্যবস্থাপকের কর্তব্য। নিচে ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা বর্ণনা করা হল।
১. লক্ষ্য অর্জন :-
প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য থাকে। এই উদ্দেশ্যকে ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন কার্যাবলীর সাহায্যে বাস্তবায়িত করা হয়। সুতরাং ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য অর্জনে ব্যবস্থাপনার গুরুত্ব অপরিসীম।
২. দক্ষতা বৃদ্ধি :-
উদ্দেশ্য অর্জনের সংগে সংগে প্রশিক্ষণও সুষ্ঠু পরিচালনার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের দক্ষতা বৃদ্ধি করার জন্য ব্যবস্থাপনা গুরুত্ব ভূমিকা পালন করে।
৩. ব্যবসায়ের উপকরণাদির উন্নয়ন :-
ব্যবসায়-বাণিজ্যে ছয়টি উপকরণ রয়েছে। যথা- মানুষ, কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি, অর্থ, পদ্ধতি ও বিপণ্নণ (Man, Material, Machine, Money, Method & Marketing)। দক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমেই এই উপকরণাদি সংগৃহীত, একত্রিত, পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়।
৪. উৎপাদনের উপকরণাদির সুষ্ঠু ব্যবহার :-
ধরুন একটি প্রতিষ্ঠানে শ্রমিক কর্মীর সংখ্যা যথেষ্ট, মূলধনেরও সমস্যা নেই, উন্নতমানের যন্ত্রপাতি এবং বিস্তৃত বাজারও রয়েছে। এখন এগুলো সঠিক ভাবে কাজে লাগাবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না এগুলোর পেছনে দক্ষ ব্যবস্থাপনা ক্রিয়াশীল হবে। তাই উৎপাদনের উপকরণ সমূহের সঠিক ব্যবহারের জন্য দক্ষ ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন।
৫. মানব ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন :-
ব্যবস্থাপনার সাহায্যে মানুষের প্রচেষ্টা সমন্বিত হয় এবং কাজের উৎসাহ পাওয়া যায়। এতে স্বতঃস্ফূর্ত কাজের পরিবেশ সৃষ্টি হয় যা অর্থনীতির অনুকূল পরিবর্তন সাধন করে।
৬. অপচয় হ্রাস :-
বর্তমানকালে ব্যবস্থাপনার শ্লোগান হল, কম খরচে বেশী উৎপাদন। এজন্যে বর্তমান ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থাপক ও শ্রমিকদের কার্যের মান ও দক্ষতা বৃদ্ধি করে, উৎপাদনে শৈল্পিক পরিবেশ নিশ্চিত করে এবং সমস্ত উপকরণ সমূহের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করে কারবার প্রতিষ্ঠানের অপচয় হ্রাস করে।
৭. শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা :-
শৃংখলা যে কোন প্রতিষ্ঠানের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য দেখা যায় যে, ব্যবস্থাপক তাঁর প্রতিষ্ঠানের বা এর কোন বিভাগের সকল কর্মী ও উপকরণের মধ্যে সমন্বয় সাধন ও ভারসাম্য স্থাপন করেন এবং শৃংখলা প্রতিষ্ঠার দ্বারা এদের প্রত্যেকের কার্যকর ব্যবহার নিশ্চিত করেন।
আরও পড়ুন:- সমবায় সমিতির বৈশিষ্ট্য উদ্দেশ্য ও গুরুত্ব লিখ?
৮. সম্পর্ক উন্নয়ন :-
ব্যবস্থাপনা মালিক ও শ্রমিক অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পর্কিত সকল পক্ষের মধ্যে উত্তম সম্পর্ক সৃষ্টি ও উন্নয়নে সচেষ্ট থাকে। শুধু তাই নয় সঠিক ব্যবস্থাপনা ক্রেতা বা ভোক্তা এবং বিদেশী উদ্যোক্তাদের সাথে সম্পর্ক সৃষ্টি করে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
৯. নেতৃত্ব প্রদান :-
উত্তম ব্যবস্থাপনা হচ্ছে নেতৃত্বের গভীরতা ও প্রসারতার বহিঃপ্রকাশ। ব্যবস্থাপনা ব্যতীত কোন মতবাদ, দলীয় কার্যাবলী উৎপাদন বৃদ্ধির সহায়ক হয় না।
১০. কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি :-
দক্ষ ব্যবস্থাপনা কোন প্রতিষ্ঠানের সম্প্রসারণ ও নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান গড়তে সহায়তা করে। তাই দেখা যায়, পৃথিবীর যে দেশ শিল্প ক্ষেত্রে যত অগ্রগতি লাভ করেছে, সে দেশে তত বেশী নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
১১. গবেষণা ও উন্নয়ন :-
বিজ্ঞানীরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে যে জ্ঞান আবিষ্কার করে, দক্ষ ব্যবস্থাপনার কারণেই তাকে বাস্তবে রূপদান ও এর সুফল জনগণের দ্বারে পৌঁছে দেয়া সম্ভব হচ্ছে।
১২. সামাজিক উন্নয়ন :-
ব্যবস্থাপনা সমাজে একদল দক্ষ লোক সৃষ্টি করে। এভাবে বিভিন্ন শিক্ষা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানকে পৃষ্ঠপোষতা প্রদানকরে সামাজিক আগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
১৩. জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন :-
মানুষের মাথাপিছু আয় ও ভোগের উপর জীবনযাত্রার মান নির্ভর করে। এজন্য কর্মসংস্থান, পদোন্নতি, আর্থিক উন্নয়ন, সুলভে পণ্য বন্টন, উৎপাদন বৃদ্ধি, কমমূল্যে উন্নত মানের পণ্য সরবরাহ ও তা সহজ প্রাপ্তির ব্যবস্থা করে। ব্যবস্থাপনা মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
ব্যবস্থাপনার উদ্দেশ্য :-
ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য কী? নিশ্চয়ই মুনাফা অর্জন করা। তাই ব্যবস্থাপনার উদ্দেশ্য হবে 'মুনাফা অর্জন'। আবার প্রতিষ্ঠান যদি সামাজিক সেবাপ্রদানকারী হয়, তাহলে এর ব্যবস্থাপনার মূল উদ্দেশ্য হবে জনগণের কল্যাণসাধন'। অর্থাৎ উদ্দেশ্যবিহীন ব্যবস্থাপনা হতে পারে না। যাই হোক, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপনার মূখ্য ও গৌণ উদ্দেশ্যগুলো নিচে বর্ণনা করা হলো।১. মুনাফা অর্জন ও মুনাফা সর্ব্বোচ্চকরণ :-
ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনার মূল উদ্দেশ্য প্রথমত মুনাফা অর্জন করা এবং দ্বিতীয়ত বছর বছর মুনাফার পরিমাণ যতটা সম্ভব বৃদ্ধি করা। মুনাফা বৃদ্ধির মাধ্যম ব্যবস্থাপনা মালিকের পক্ষের সম্পদ বৃদ্ধি করে।
২. ব্যবসায়ের সম্প্রসারণ :-
মুনাফার একটি অংশ ব্যবসায়ের সম্প্রসারণের জন্য বিনিয়োগ করা ব্যবস্থাপকের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য। ফলপ্রসূত ব্যবস্থাপনা ব্যবসায়ের সফল সম্প্রসারনের সহায়ক।
আরও পড়ুন:- ব্যবস্থাপনার কার্যাবলি ও নীতিমালা সম্পর্কে লিখ?
৩. সম্পদের ফলপ্রসূত ব্যবহার :-
প্রতিষ্ঠানের মানবীয় ও অমানবীয় সম্পদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা ব্যবস্থাপনার একটি অন্যতম উদ্দেশ্য। সম্পদের সঠিক ব্যবহারের ফলে প্রতিষ্ঠান সমৃদ্ধশালী হয়।
৪. মানব সম্পদের উন্নয়ন :-
প্রতিষ্ঠানে সঠিক কর্মী নিয়োগদান ও তাদের সক্ষমতা উন্নয়ন আরেকটি ব্যবস্থাপনার উদ্দেশ্য। নিয়োগকৃত কর্মীদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়।
৫. শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখা :-
প্রতিষ্ঠানে যাতে কর্ম-অসন্তোষ দেখা না দেয় তার জন্য শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখা ব্যবস্থাপনার উদ্দেশ্যেরঅন্তর্ভুক্ত ব্যবস্থাপকেরা চৌকষ নেতৃত্বের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের ভিতরে কর্ম-পরিবেশ আনন্দদায়ক করে রাখে।
৬. পণ্য ও সেবার মান উন্নয়ন :-
উৎপাদিত পণ্য ও সেবার গুণগত মান সমুন্নত রাখাও ব্যবস্থাপনার একটি উদ্দেশ্য। ব্যবস্থাপনীয় কার্যাবলির মাধ্যমে ভালো মানের পণ্য উৎপাদন নিশ্চিত করা হয়। একই সাথে সেবার মানও উন্নত করা হয়।
৭. সমন্বয়সাধন :-
সাবলীল যোগাযোগের মাধ্যম প্রতিষ্ঠানের ভিতরে বিভিন্ন বিভাগের কার্যাবলির মধ্যে সমন্বয়সাধন করার জন্য ব্যবস্থাপনা প্রচেষ্টা চালায়। কারণ ব্যবস্থাপনার একটি উদ্দেশ্য হলো আন্তঃবিভাগীয় সমস্বয়সাধন করা।
৮. প্রতিষ্ঠানের সুনাম বৃদ্ধি :-
সুনাম ব্যতীত সাফল্যের সাথে ব্যবসা পরিচালনা করা যায় না। তাই ব্যবস্থাপনার একটি উদ্দেশ্য হলো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও জনগণের সাথে জনসংযোগের মাধ্যমে এবং উঁচুমানের পণ্য উৎপাদন করে প্রতিষ্ঠানের সুনাম বৃদ্ধি করা।
আরও পড়ুন:- সমবায় সমিতির গঠন পদ্ধতি ও নীতিমালা লিখ?
0 মন্তব্যসমূহ
Please do not enter any spam link in the comment box.