কোম্পানি সংগঠনের বৈশিষ্ট্য :-
কোম্পানি সংগঠন আইনানুযায়ী গঠিত ও পরিচালিত কতিপয় ব্যক্তির যৌথ প্রচেষ্টার ফলে সৃষ্ট একটি ব্যবসায় সংগঠন। বৃহদায়তন এ সংগঠনের কতগুলো আইনানুগ ও সাধারণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। উভয় প্রকৃতির বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করা হলো।ক. আইনগত বৈশিষ্ট্য :-
১. আইনের সৃষ্ট (Creation of law) :-কোম্পানি ব্যবসায় দেশের প্রচলিত কোম্পানি আইন দ্বারা গঠিত হয়। এরূপ ব্যবসায়ের গঠন ও নিয়ন্ত্রণের প্রতিটি পর্যায় উক্ত আইন দ্বারা প্রভাবিত হয়। বাংলাদেশে এ জাতীয় ব্যবসায় কোম্পানি আইন ১৯৯৪ এর বিধান অনুসারে গঠিত হয়।
২. বাধ্যতামূলক নিবন্ধন (Compulsory registration) :-
কোম্পানি ব্যবসায় প্রচলিত আইন অনুযায়ী নিবন্ধিত হতে হয়। যে কোনো কোম্পানির জন্যই নিবন্ধন বাধ্যতামূলক।
৩. সিলমোহর (Seal) :-
আইন দ্বারা সৃষ্ট হওয়ায় কোম্পানি সংগঠনের নিজস্ব সিলমোহর থাকে। নিজের নামাঙ্কিত এ সিলমোহর থাকায় কোম্পানি নিজ নামে কাজকর্ম পরিচালনা করতে পারে।
8. কৃত্রিম ব্যক্তিসত্তা (Artificial personality) :-
কোম্পানি সংগঠন কৃত্রিম সঞ্জর অধিকারী। আইনই তাকে এরপ সঙ্গ প্রদান করেছে। মানুষের ন্যায় এর অবয়ব না থাকলেও আইনের দৃষ্টিতে কোম্পানি একটি কৃত্রিম ব্যক্তি হিসেবে পরিগণিত। যে কোনো ব্যক্তির ন্যায় কোম্পানি নিজ নামে ব্যবসায় চালাতে পারে।
৫. চিরন্তন অস্তিত্ব (Perpetual succession) :-
কোম্পানির কৃত্রিম ব্যক্তিসত্তা কোম্পানিকে চিরন্তন বা স্থায়ী অস্তিত্বের সুযোগ এনে দিয়েছে। মালিকানার পরিবর্তন, এমনকি সদস্যদের মৃত্যু ঘটলেও কোম্পানির অস্তিত্ব বিপন্ন হয় না। আইন অনুসারে বিলোপ সাধন করা না হলে কোম্পানির ব্যবসায়ের অস্তিত্ব বিনষ্ট হয় না।
৬. সীমিত দায় (Limited liability) :-
কোম্পানি ব্যবসায়ের সদস্যদের অর্থাৎ শেয়ারহোল্ডাদের দায় সীমাবদ্ধ। তারা যে পরিমাণ অর্থের শেয়ার ক্রয় করে শুধু সেই পরিমাণ অর্থেই তাদের দায় সীমিত থাকে।
৭. শেয়ার (Share) :-
কোম্পানি ব্যবসায়ের আরেকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো এর মূলধনকে বিভিন্ন শেয়ারে বিভক্তিকরণ। মূলধনকে নির্দিষ্ট সংখ্যক শেয়ারে বিভক্ত করা হয় এবং প্রত্যেকটি শেয়ারের একটি আংকিক মূল্য থাকে।
৮. আইনানুগ পরিচালনা (Legal control) :-
কোম্পানি ব্যবসায়ের পরিচালনায় ও ব্যবস্থাপনায় কোম্পানি আইনের বিভিন্ন বিধান মেনে চলতে হয়।
আরও পড়ুন:- পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি কাকে বলে?
৯. বাধ্যতামূলক নিরীক্ষা (Compulsory audit) :-
প্রত্যেক কোম্পানিকে বাধ্যতামূলকভাবে বার্ষিক হিসাবপত্র চার্টার্ড একাউন্টান্ট ফার্ম দ্বারা নিরীক্ষা করাতে হয়।
খ. সাধারণ বৈশিষ্ট্য :-
১. ঐচ্ছিক সংস্থা (Voluntary association) :-কোম্পানি ব্যবসায় কতিপয় ব্যক্তির সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলে সৃষ্ট একটি ঐচ্ছিক বা স্বেচ্ছামূলক ব্যবসায়।
2. সদস্য পদ ( Membership) :-
কোম্পানি ব্যবসায়ের সদস্যপদ লাভ করার জন্য শেয়ার ক্রয় করা বাধ্যতামূলক। শেয়ার ক্রয় না করে কেই কোম্পানির সদস্য বা শেয়ারহোল্ডার হতে পারে না।
৩. সদস্য সংখ্যা (Number of members) :-
প্রকারভেদ অনুযায়ী কোম্পানি ব্যবসায়ের সদস্য সংখ্যা বিভিন্ন হয় প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির ক্ষেত্রে সদস্য সংখ্যা ২ থেকে ৫০ জন এবং পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি ক্ষেত্রে সদস্য সংখ্যা নিম্নে ৭ জন এবং ঊর্ধ্বে শেয়ার দ্বারা সীমিত।
৪. শেয়ারের হস্তান্তরযোগ্যতা (Transferability of share) :-
কোম্পানি ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির শেয়ার হস্তান্তর করা যায়। এক্ষেত্রে যে সদস্য শেয়ার হস্তান্তর করে তার সদস্যপদ রহিত হয়ে যায়।
৫. ব্যবস্থাপনার সাথে মালিকানার বিচ্ছিন্নতা (Separation of ownership and management) :-
কোম্পানির মালিকগণ সরাসরি ব্যবস্থাপনার সাথে জড়িত থাকে না। ফলে ব্যবস্থাপনা ও মালিকানা একে অপরের থেকে দূরে অবস্থান করে।
আরও পড়ুন:- ব্যবসায় উদ্দেশ্য লিখ?
৬. মালিকানার ব্যাপ্তি (Expansion of ownership) :-
পাবলিক লিমিটেড কোম্পানির ক্ষেত্রে নতুন নতুন শেয়ার বিক্রয় করে মালিকানার ব্যাক্তি বাড়ানো সম্ভব।
৭. গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা (Democratic administration) :-
কোম্পানির পরিচালকগণ সাধারণত বার্ষিক সাধারণ সভায় শেয়ারহোল্ডারদের দ্বারা নির্বাচিত হন। তাছাড়া পলিসি নির্ধারণের ব্যাপারেও সংখ্যা গরিষ্ঠ শেয়ারহোল্ডারদের মতামতের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। ফলে কোম্পানির ব্যবস্থাপনায় গণতান্ত্রিক নীতির প্রচলন ঘটে।
৮. লভ্যাংশ বণ্টন (Distribution of profit) :-
মুনাফার পরিমাণ নির্ধারণ করার পর সংগঠনের পরিচালক পর্ষদের অনুমোদনক্রমে শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে শেয়ারের অনুপাতে মুনাফা বণ্টন করা হয়।
কোম্পানি সংগঠনের গুরুত্ব :-
ব্যবসায় জগতে বৃহদায়তন উৎপাদনের বিপুল সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করে দেওয়ায় কোম্পানি সংগঠন সারাবিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায় সংগঠন হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বৃহৎ পুঁজি গঠন, শেয়ার মালিকদের কম ঝুঁকিসহ কতিপয় সুবিধাজনক অবস্থানে থাকায় কোম্পানি সংগঠন অন্যান্য ব্যবসায় সংগঠনের তুলনায় এক স্বকীয় ভিত্তি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। নিম্নে কোম্পানি সংগঠনের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা আলাচনা করা হলো১. বিপুল পুঁজির সমাহার (Accumulation of large amount of capital) :-
কোম্পানি সংগঠনে বিপুল সংখ্যক সদস্য অন্তর্ভুক্ত হবার সুবিধা থাকয় এটি বড় আকারের মূলধন যোগাড় করতে সক্ষম। তাই কোম্পানি বৃহৎ ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হবার সুযোগ অধিক
২. বৃহদায়তন উৎপাদন (Large scale of production) :-
বর্তমান বিশ্ব চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গেলে উৎপাদন কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ ক্ষেত্রে আবদ্ধ করে রাখা যেমন সম্ভব নয়, তেমনি এর পরিমাণগত সীমাবদ্ধতাও কাম্য নয়। সেক্ষেত্রে কোম্পানি সংগঠন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে বৃহদায়তন উৎপাদনের পথকে উন্মোচন করেছে।
৩. চমৎকার বিনিয়োগ ক্ষেত্র (A charming investment field) :-
কোম্পানি সংগঠন বর্তমান বিশ্বে এক চমৎকার বিনিয়োগ ক্ষেত্র হিসেবে প্রতিভাত হয়েছে। কয়েকটি বিশেষ কারণ যেমন-পৃথক সত্তা, সীমিত দায়, চিন্তান অস্তিত্ব ও স্বল্পমূল্যের শেয়ার ক্রয়ের সুযোগ থাকায় বিনিয়োগকারীদের জন্য এটা উত্তম ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
8. সঞ্চয়ে আগ্রহ সৃষ্টি (Interest for saving) :-
কোম্পানি সংগঠনে কম বিনিয়োগ করার সুযোগ থাকায় সঞ্চয়কারীরা অনায়াসেই এতে বিনিয়োগের সুযোগ পাচ্ছে। মুনাফা প্রাপ্তি, অগ্রাধিকার ও রাইট শেয়ার ক্রয়ের সুযোগ ইত্যাদি ক্ষেত্রে সঞ্চয়কারীদের আগ্রহ সৃষ্টি হওয়ায় তা ব্যক্তি জীবনে ও জাতীয় জীবনে বিশেষ ভূমিকা পালন করছে।
৫. ঝুঁকি বন্টনের সুযোগ (Opportunity for distribution of risk) :-
কোম্পানির শেয়ারহোল্ডারদের দায় সীমিত হবার কারণে এ ক্ষেত্রে ঝুঁকি বন্টনের সুযোগ অধিক। এর ফলে বৃহদায়তনের ও অধিক ঝুঁকিসম্পন্ন সামাজিক কল্যাণমূলক কোনো ব্যবসায়িক কর্ম সম্পাদন করা কোম্পানির ক্ষেত্রেই সম্ভব।
৬. কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি (Employment opportunity) :-
কোম্পানি ক্ষেত্র সুবিস্তৃত হবার কারণে এটি বিপুল কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে সক্ষম। বৃহৎ সংগঠনে অধিক কর্মী নিযুক্ত হবার সুযোগ থাকায় বেকার সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশের ন্যায় তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জন্য কোম্পানি সংগঠন এক আশীবাদস্বরূপ।
৭. সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ও কৌশলের ব্যবহার (Use of latest technology and expertise) :-
অধিক পুঁজি বিনিয়োগের দ্বারা বৃহদায়তন ব্যবসায় গড়ে তোলার সুযোগ থাকায় সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ও কৌশলের ব্যবহার করা সম্ভব হয়। গবেষণা ও উন্নয়নে মাধ্যমে পণ্য ও সেবার মান বৃদ্ধি করে জাতীয় চাহিদা পুরণেও এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হয়।
৮. দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আনয়ন (Raising economic growth of the country) :-
ব্যাপকভিত্তিক বিনিয়োগ কাজে সম্পৃক্ত থাকার ফলে কোম্পানি দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আনয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। কোম্পানির পক্ষ থেকে ব্যাপক কর সরকারি কোষাগারে জমা হয়। ফলে দেশের অর্থনীতি আরও সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে। এতে অর্থনীতির গতি সঞ্চার হয়।
৯. সামাজিক উন্নয়নে অংশগ্রহণ (Participation in social development) :-
কেবল মুনাফা অর্জনই নয়, কোম্পানি সংগঠন সামাজিক প্রগতি ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে ব্যাপক অবদান রাখে। কোম্পানি সংগঠনের সাথে জড়িত শ্রমিক কর্মচারীদের স্বার্থেই শুধু নয়, সামাজিক দায়িত্ব পালনের লক্ষ্যেও এটি স্কুল-কলেজ, ধর্মীয় ও দাতব্য প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করে সামাজিক উন্নয়নে অংশগ্রহণ করে।
১০. শিল্পোন্নয়ন (Industrial development) :-
কোম্পানি সংগঠন দেশে নতুন নতুন শিল্প কারখানা গড়ে তুলে দেশের শিল্প উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। বৃহদায়তন উৎপাদনের ফলে অন্যান্য ব্যবসায় অপেক্ষা কোম্পানি ব্যবসায়ই শিল্প উন্নয়নের পথকে ত্বরান্বিত করে বেশি।
১১. আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অর্জন (Achieving international cooperation) :-
কোম্পানি সংগঠনের খেলা সুবিস্তৃত হবার ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটা দেশের সীমা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিস্তার লাভ করে। এতে এক দেশের সাথে অন্য দেশের যোগাযোগ বৃদ্ধি পায়, পরস্পরের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপিত হয়। পারস্পরিক প্রয়োজনে একে অপরের স্বার্থে এগিয়ে আসে এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি পায়।
আরও পড়ুন:- একজন আদর্শ নেতা গুনাবলী কি কি?
ওপরের আলোচিত বিষয়সমূহ ছাড়াও কোম্পানি সংগঠন ব্যবস্থাপনার পেশাগত উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সুতরাং ব্যক্তিগত, সামাজিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কোম্পানি ব্যবসায়ের তাৎপর্য অপরিসীম। শুধু ক্রেতার চাহিদা পুরণই নয়, দেশের কর্মসংস্থান, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সামাজিক সেবা সম্প্রসারণসহ সকল ক্ষেত্রেই কোম্পানি সংগঠনের গুরুত্ব সমধিক।
0 মন্তব্যসমূহ
Please do not enter any spam link in the comment box.