শাস্ত্রীয় ব্রত ও মেয়েলি ব্রতের মধ্যে পার্থক্য :-
শাস্ত্রীয় ব্রত ভারতে আর্যদের অনুষ্ঠান, পুরাণ ভেঙে এই ব্রতের উদ্ভব, আচার-নিয়মের নিষ্ঠা ও ব্রতের মূল লক্ষ্য। অন্যদিকে মেয়েলি ব্রত ভারতের নিবাসীদের অনুষ্ঠান, বৈদিক সুক্তের সঙ্গে মেয়েলি ব্রতের মিল সক্ষিত হলেও, মেয়েলি ব্রতের উদ্ভব বৈদিকমুক্ত নয়, এর মধ্যে একটা জাতির প্রাণের কথা, একটা স্বপ্ন যেন মূর্তরূপ পেতে চায়। বেদ, পুরাণের চেয়েও পুরানো এই সব লৌকিক ব্রত অনুষ্ঠান।শাস্ত্রীয় ব্রত পুরুষতান্ত্রিক আর্য সভ্যতার অবদান, আর মেয়েলিব্রত মাতৃতান্ত্রিক অনার্য সমাজের সৃষ্টি-আর্য-পূর্ব সমাজে এর উদ্ভব। বৈদিক সূক্তের সঙ্গে মেয়েলি ব্রতের চাওয়া-পাওয়া কামনায় মিল থাকলেও বৈদিক অনুষ্ঠান মূলত পুরুষদের আর ব্রত অনুষ্ঠান মেয়েদের। বৈদিক ঋষিরা যেখানে চাচ্ছেন – ইন্দ্র আমাদের সহায় হোন, তিনি আমাদের বিজয় দিন, শত্রুরা দূরে পলায়ন করুক ইত্যাদি। আর বাঙালি মেয়েরা চাইছেরিণে রণে ত্রয়ে। হব, পনে জনে সূয়ো হব, আকালে লক্ষ্মী হব, সময়ে পুত্রবর্তী হব।"
আরও পড়ুন :- ব্রত কথা কি?
শাস্ত্রীয় ব্রত কিংবা বৈদিত সূক্তগুলো বহিমুখী, আর মেয়েলি ব্রতগুলো আমাদের অন্তঃ পুরচারী নারীদের মতো, অন্তর্মুখী। লেখক অবনীন্দ্রনাথ আলোচনাসূত্রে এ দুই বিষয়কে আমাদের রূপকথার বিহঙ্গম পাখির সঙ্গে তুলনা করেছেন। দুজনেই পৃথিবীর কিন্তু বেদ মুক্তনগুলি ছাড়াও স্বাধীন, ধানের সবুজের ওপর নীল আকাশের গান, উদার পৃথিবীর গান; আর ব্রতের ছড়াগুলি যেন নীড়ের ধারে বসে ঘন সবুজের আড়ালে পক্ষীমাতার মধুর কাকলি কিন্তু দুই গানই পৃথিবীর সুরে বাঁধা।
অনুষ্ঠান প্রক্রিয়ার দিক থেকেও মেয়েলি ব্রত ও শাস্ত্রীয় ব্রতের মধ্যে পার্থক্য বিদ্যমান। শাস্ত্রীয় ব্রতের প্রায় সবগুলিতে, কামনা করেই ব্রত হোক না, কামনা চরিতার্থ করবার উপায় বা অনুষ্ঠান বা ক্রিয়া অনেকটা একই, পুত্রপৌত্র কামনা, তারও চরিতার্থতার যে মন্ত্র, যে ক্রিয়া, অন্য কিছু কামনা করেও সেইসব ক্রিয়া সংযম কামনার এক ক্রিয়া, সব রোগের এক ওষুধ বা সব সিন্দুকের একই চাবি।
শাস্ত্রীয় ব্রত এদিক থেকে একমুখী, গতানুগতিক কিংবা একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তি মাত্র। অন্যদিকে মেয়েব্রিত এই রকমারি রূপের প্রধান কারণ, এগুলো লোকসমাজের সম্পদ। লোকসমাজে কোনকিছুর নির্দিষ্ট নিয়ম থাকে না। লোকগীতি প্রচলিত সুরে যে কেউ গাইতে পারেন এবং সেখানে ব্যক্তিভেদে সুরের বৈষম্য আসতেই পারে। কিন্তু শাস্ত্রীয় সংগীতে সুরের কোন রকমফের চলে না। কারণ তার একটা বাঁধাধরা নিয়ম আছে। শাস্ত্রীয় ব্রত ও মেয়েলি ব্রতের মধ্যেকার সম্পর্কটা অনেকটা সে রকম।
আরও পড়ুন :- গীতিকা কাকে বলে?
লেখক মনে করেন, 'ব্রত হচ্ছে মানুষের সাধারণ সম্পত্তি কোনো ধর্মবিশেষের কিংবা বিশেষ দলের মধ্যে সেটা বন্ধ নয়,... ঋতুপরিবর্তনের সঙ্গে মানুষের যে দশাবিপর্যয় ঘটত সেইগুলোকে ঠেকাবার ইচ্ছা এবং চেষ্টা থেকেই ব্রতক্রিয়ার উৎপত্তি।'
এই উৎপত্তির পিছনে অর্থাৎ মেয়েলি বা খাঁটি ব্রতের উৎপত্তির পিছনে গণমানসের একটা ভূমিকা থেকে গেছে, লোকসংস্কৃতির যেকোন সৃষ্টিতেই তাই থাকে। ফলে, মেয়েলি ব্রতের । আচার-অনুষ্ঠানের রীতি-পদ্ধতি কামনাভেদে পৃথক। শুধু কামনা ভেদেই পৃথক নয়, একই ব্রতের নিয়ম-কানুন অঞ্চল ভেদে আবার ভিন্ন হতে পারে, তাতে কোন মহাভারত অশুদ্ধ হয় না।
কারণ, লোকসাহিত্যের অঞ্চল পার্থক্যে পাঠান্তর থাকতেই পারে। ব্রতের ক্ষেত্রেও সে নিয়ম প্রযোজ্য। আর ব্রত, বিশেষত মেয়েলিব্রত একজন মানুষের কামনা এবং তার চরিতার্থতার অনুষ্ঠান নয়। ব্রতের মূলে কামনা এবং তার চরিতার্থতার জন্য ক্রিয়া যদিও আবশ্যক, তবু ব্রতে একক মানুষের কামনা ধরা পড়ে না। ব্রত তখন, যখন দশে মিলে এক কাজ এক উদ্দেশে করছে। ব্রতের মোটামুটি আদর্শ এই হল একের কামনা দশের মধ্যে প্রবাহিত হয়ে একটা অনুষ্ঠান হয়ে উঠছে।
তবে এক্ষেত্রে লেখক একের সঙ্গে কেন যে দশজনে মিলছে, কিংবা একের অনুকরণ কেন যে দশজন র মধ্যে না গিয়ে ব্রত ও উপাসনার পার্থক্যের মধ্যে দিয়ে ব্রতের পিছনে দশজনের ভূমিকার দিকটি সে প্রশ্নের মধ্যে করছে, সে স্পষ্ট করে দিলেন –
'একজনকে নিয়ে নাচ চলে কিন্তু নাটক চলে না, তেমনি একজনকে দিয়ে উপাস্য দেবতা উপাসনা চলে । ব্রত-অনুষ্ঠান চলে না। ব্রত ও উপাসনা দুইই ক্রিয়া-কামনার চরিতার্থতার জন্য। কিন্তু একটি ডাকের মধ্যে বন্ধ এবং উপাসনাই তার চরম, আর-একটি দশের মধ্যে পরিব্যাপ্ত কামনার সফলতাই তার শেষ।'
লেখক মনে করেন, 'ব্রত হচ্ছে মানুষের সাধারণ সম্পত্তি কোনো ধর্মবিশেষের কিংবা বিশেষ দলের মধ্যে সেটা বন্ধ নয়,... ঋতুপরিবর্তনের সঙ্গে মানুষের যে দশাবিপর্যয় ঘটত সেইগুলোকে ঠেকাবার ইচ্ছা এবং চেষ্টা থেকেই ব্রতক্রিয়ার উৎপত্তি।'
এই উৎপত্তির পিছনে অর্থাৎ মেয়েলি বা খাঁটি ব্রতের উৎপত্তির পিছনে গণমানসের একটা ভূমিকা থেকে গেছে, লোকসংস্কৃতির যেকোন সৃষ্টিতেই তাই থাকে। ফলে, মেয়েলি ব্রতের । আচার-অনুষ্ঠানের রীতি-পদ্ধতি কামনাভেদে পৃথক। শুধু কামনা ভেদেই পৃথক নয়, একই ব্রতের নিয়ম-কানুন অঞ্চল ভেদে আবার ভিন্ন হতে পারে, তাতে কোন মহাভারত অশুদ্ধ হয় না।
কারণ, লোকসাহিত্যের অঞ্চল পার্থক্যে পাঠান্তর থাকতেই পারে। ব্রতের ক্ষেত্রেও সে নিয়ম প্রযোজ্য। আর ব্রত, বিশেষত মেয়েলিব্রত একজন মানুষের কামনা এবং তার চরিতার্থতার অনুষ্ঠান নয়। ব্রতের মূলে কামনা এবং তার চরিতার্থতার জন্য ক্রিয়া যদিও আবশ্যক, তবু ব্রতে একক মানুষের কামনা ধরা পড়ে না। ব্রত তখন, যখন দশে মিলে এক কাজ এক উদ্দেশে করছে। ব্রতের মোটামুটি আদর্শ এই হল একের কামনা দশের মধ্যে প্রবাহিত হয়ে একটা অনুষ্ঠান হয়ে উঠছে।
তবে এক্ষেত্রে লেখক একের সঙ্গে কেন যে দশজনে মিলছে, কিংবা একের অনুকরণ কেন যে দশজন র মধ্যে না গিয়ে ব্রত ও উপাসনার পার্থক্যের মধ্যে দিয়ে ব্রতের পিছনে দশজনের ভূমিকার দিকটি সে প্রশ্নের মধ্যে করছে, সে স্পষ্ট করে দিলেন –
'একজনকে নিয়ে নাচ চলে কিন্তু নাটক চলে না, তেমনি একজনকে দিয়ে উপাস্য দেবতা উপাসনা চলে । ব্রত-অনুষ্ঠান চলে না। ব্রত ও উপাসনা দুইই ক্রিয়া-কামনার চরিতার্থতার জন্য। কিন্তু একটি ডাকের মধ্যে বন্ধ এবং উপাসনাই তার চরম, আর-একটি দশের মধ্যে পরিব্যাপ্ত কামনার সফলতাই তার শেষ।'
আরও পড়ুন :- সন্ধি কি বা কাকে বলে?
শাস্ত্রীয় ব্রত আনুষ্ঠানিক, মন্ত্র ও পূজারি নির্ভর, অন্য দিকে মেয়েলিব্রত কামনা-বাসনাপূর্ণ, মন্ত্রহান, তার সঙ্গ প্রকৃতির একাত্মতা। মেয়েলি ব্রতে প্রকৃতি-নির্ভরতা অনেক সময় তাকে ব্রত ভাবতে সন্দেহ জাগায়। প্রত্যেক ঋতুর ফুলপাতা, আকাশ-বাতাসের সঙ্গে এই সব অশাস্ত্রীয় অথচ একেবারে খাঁটি ও আশ্চর্যরকম সৌন্দর্যে রসে শিল্পে পরিপূর্ণ বাঙালির সম্পূর্ণ নিজের ব্রতগুলির যে গভীর যোগ দেখা যাচ্ছে, তাতে করে এগুলিকে ধর্মানুষ্ঠান বাব কি ষড়ঋতুর এক একটি উৎসব বলা ঠিক করা শক্ত।
শাস্ত্রীয় ব্রত আনুষ্ঠানিক, মন্ত্র ও পূজারি নির্ভর, অন্য দিকে মেয়েলিব্রত কামনা-বাসনাপূর্ণ, মন্ত্রহান, তার সঙ্গ প্রকৃতির একাত্মতা। মেয়েলি ব্রতে প্রকৃতি-নির্ভরতা অনেক সময় তাকে ব্রত ভাবতে সন্দেহ জাগায়। প্রত্যেক ঋতুর ফুলপাতা, আকাশ-বাতাসের সঙ্গে এই সব অশাস্ত্রীয় অথচ একেবারে খাঁটি ও আশ্চর্যরকম সৌন্দর্যে রসে শিল্পে পরিপূর্ণ বাঙালির সম্পূর্ণ নিজের ব্রতগুলির যে গভীর যোগ দেখা যাচ্ছে, তাতে করে এগুলিকে ধর্মানুষ্ঠান বাব কি ষড়ঋতুর এক একটি উৎসব বলা ঠিক করা শক্ত।
0 মন্তব্যসমূহ
Please do not enter any spam link in the comment box.