রূপক অলংকার কাকে বলে? রূপক অলংকারের প্রকারভেদ ও বৈশিষ্ট্য

রূপক অলংকার কাকে বলে :-

বিষয়ের অপর না ঘটিয়ে (উপমেয়কে লুপ্ত না করে) তার ওপর বিষয়ীর (উপমানের) অভেদ আরোপ করলে যে অর্থসৌন্দর্যের সৃষ্টি হয়, তার নাম রূপক অলংকার।

খুব সহজ ভাবে মনে রাখতে উপমেয়ের ওপর উপমানের অভেদ আরোপ করলে রূপক অলংকার হবে।

রূপক অলংকারের বৈশিষ্ট্য :-

১. বাক্যে উপমেয় এবং উপমানের উল্লেখ থাকবে, সাদৃশ্যবাচক শব্দ থাকবে না।

২. উপমেয় এক হয়ে যাবে উপমানের সঙ্গে। এরই নাম অভেদ। সাদৃশ্যের প্রথম স্তর উপমেয়-উপমানের ভেদ মেনে নিয়ে কেবল সাদৃশ্যটুকু দেখানো (উপমা), দ্বিতীয় স্তরভেদ মেনে নিয়ে তারতম্য দেখানো (ব্যতিরেকে), তৃতীয় স্তর অভেদ (রূপক)।

আরও পড়ুন :- শ্লেষ অলংকার কাকে বলে?

৩. বাক্যে উপমানই প্রধান, ক্রিয়াপদ বা ক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত বাক্যাংশ উপমানকেই অনুসরণ করবে। উপমেয় লুপ্ত নয়, তবে গৌণ।

৪. জীবন অঙ্গী, শৈশব-যৌবন-বার্ধক্য তার অঙ্গ; আকাশ অঙ্গী, মেঘ-তারা-নীলরং তার অঙ্গ; নদী অঙ্গী-ধারা-ঢেউ-ফেনা-তীর তার অঙ্গ। অঙ্গী উপমেয়ের অঙ্গের সঙ্গে অঙ্গী উপমানের অঙ্গের অভেদ হতে পারে।
রূপক অলংকার কাকে বলে

রূপক অলংকারের প্রকারভেদ :-

বাংলায় রূপকের উল্লেখযোগ্য বিভাগ তিনটি। তথা —
  1. নিরঙ্গরূপক 
  2. সাঙ্গরূপক এবং
  3. পরম্পরিত রূপক।
বিভিন্ন প্রকার রূপক অলংকারের সংজ্ঞা :-

নিরঙ্গরূপক অলংকার কাকে বলে :-

যে রূপক অলংকারে কোনো অঙ্গের অভেদ কল্পনা না করে কেবল একটি উপমেয়ের ওপর একটি বা একাধিক উপমানের অভেদ আরোপ করা হয়, তার নাম নিরঙ্গরূপক।

আরও পড়ুন :- অনুপ্রাস অলংকার কি?

নিরঙ্গরূপক দু-রকমের। যথা-

(ক) কেবল নিরঙ্গরূপক এবং

(খ) মালা নিরজ্ঞারূপক।

একটি উপমানের অভেদ আরোপ হলে কেবল নিরঙ্গরূপক। আর একাধিক উপমানের অভেদ আরোপ হলে মালা নিরঙ্গরূপক।

উদাহরণ :

১. কেবল নিরঙ্গরূপক (একটি উপমেয়, একটি উপমান) এর উদাহরণ -

শিশুফুলগুলি তোমারে ঘেরিয়া ফুটে। —যতীন্দ্রমোহন

সংকেত :

উপমেয় 'শিশু', উপমান 'ফুলগুলি'। ক্রিয়াপদ 'ফুটে ফুলগুলি'র অনুসারী। 'শিশু'র ওপর 'ফুলগুলি'র অভেদ আরোপ

২. মালা নিরঙ্গরূপক (এখানে একটি উপমেয় এবং একের বেশি উপমান থাকে) উদাহরণ -

আমি কি তোমার উপদ্রব, অভিশাপ,

দুরদৃষ্ট, দুঃস্বপ্ন, করলগ্ন কাঁটা? —রবীন্দ্রনাথ

সংকেত:

উপমেয় 'আমি', উপমান 'উপদ্রব, 'অভিশাপ', 'দুরদৃষ্ট', 'দুঃস্বপন', 'কাঁটা'। একটি উপমেয়ের ওপর পাঁচটি উপমানের অভেদ আরোপ।

সাঙ্গরূপক কাকে বলে :-

যে রূপক অলংকারে বিভিন্ন অঙ্গসমেত অঙ্গী উপমেয়ের ওপর বিভিন্ন অঙ্গসমেত অঙ্গী উপমানের অভেদ আরোপ করা হয়, তার নাম সাঙ্গরূপক।

অর্থাৎ, উপমেয়-উপমান অঙ্গসমেত এক হয়ে গেলে সাঙ্গরূপক।

উদাহরণ :

সৌন্দর্য পাথারে

যে বেদনা-বায়ুভরে ছুটে মন-তরী

সে বাতাসে, কতবার মনে শঙ্কা করি,

ছিন্ন হয়ে গেল বুঝি হৃদয়ের পাল। - রবীন্দ্রনাথ।

আরও পড়ুন :- লোকসংস্কৃতি কাকে বলে?

সংকেত :

এখানে অঙ্গী উপমেয় হলো 'সৌন্দর্য, এবং তার অঙ্গ হলো 'বেদনা', 'মন', 'হৃদয়'।

এবং অপর অঙ্গী উপমান ‘পাথার’ এবং তার অঙ্গ হলো' তরী', 'বায়ু, 'পাল'।

পরম্পরিত রূপক কাকে বলে :-

যে রূপক অলংকারে একটি উপমেয়ের ওপর আরেকটি উপমানের অভেদ আরোপের কারণে অন্য একটি উপমেয়ের ওপর অন্য একটি উপমানের অভেদ আরোপের জন্ম হয়, তবে সেই অলংকারকে পরম্পরিত রূপক অলংকার বলে।

একটি নিরঙ্গরূপক থেকে আর একটি নিরঙ্গরূপকের জন্ম—এইভাবে রূপকের পরম্পরা বা ধারা তৈরি হতে থাকে বলে এর নাম পরম্পরিত রূপক।

উদাহরণ :

তাই দীর্ঘশ্বাসের ধোঁয়ায় কালো করছো ভবিষ্যৎ আর

অনুশোচনার আগুনে ছাই হচ্ছে উৎসাহের কয়লা। -সুকান্ত ভট্টাচার্য

ব্যাখ্যা :

প্রথম উপমেয় 'দীর্ঘশ্বাস'র ওপর প্রথম উপমান ‘ধোঁয়ার’-র অভেদ আরোপের কারণে দ্বিতীয় উপমেয় 'অনুশোচনার ওপর দ্বিতীয় উপমান 'আগুন'-এর অভেদ আরোপের জন্ম। আবার দ্বিতীয় অভেদ-আরোপ থেকে তৃতীয় উপমেয় 'উৎসাহ’-এর ওপর তৃতীয় 'কয়লা'র অভেদ-আরোপের জন্ম—এইভাবে রূপকের কার্যকারণ-পরম্পরা তৈরি হচ্ছে বলে এটি পরম্পরিত রূপক।

আরও পড়ুন :- বাক্য কাকে বলে?

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ