বাক্য ভাষার অত্যন্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বাক্যে ব্যবহৃত শব্দকে পদ বলে। একাধিক শব্দকে পাশাপাশি ব্যবহার করলেই বাক্য হয় না। বক্তার মনের ভাব সম্পূর্ণভাবে প্রকাশিত হলেই তা বাক্যের পর্যায়ে পড়ে। কিন্তু এখন প্রশ্ন হলো বাক্য বলতে কি বুঝায়।
"একটি সম্পূর্ণ মনোভাব যে সমস্ত পদ দ্বারা প্রকাশ করা যায়, তাদের সমষ্টিকে বাক্য বলে।"
বাক্য কি এ সম্পর্কে মুনীর চৌধুরী ও মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী বলেছেন -
“যে সুবিন্যস্ত পদসমষ্টি দ্বারা কোনো বিষয়ে বক্তার মনোভাব সম্পূর্ণরূপে প্রকাশিত হয়, তাকে বাক্য বলে।"
সুতরাং বাক্য কাকে বলে এর উত্তরে আমরা বলতে পারি, এক বা একাধিক পদের দ্বারা যখন বক্তার মনোভাব সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ পায়, তখন তাকে বাক্য বলে।
আরও পড়ুন :- বচন কাকে বলে? উদাহরণ দাও?
যেমন :-
লেখ।
আমি খাই।
কাজী নজরুল ইসলাম বই লিখছেন।
প্রত্যেকটি বাক্যের পদগুলোর মধ্যে একটি পারস্পরিক সম্পর্ক বা অন্বয় থাকতে হয়, যার কারণে বক্তার মনোভাব বা বক্তব্য স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে।
যেমন লক্ষ কর -
গিয়ে পুকুরে বড় ধরেছি একটা মাছ।
খাঁ খাঁ অপু যাওয়ায় চলে করছে বাড়িটা।
বাক্য দুটোতে বক্তার মনোভাব পরিষ্কার নয়। কেননা, পদগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক নেই এবং পদগুলো সুবিন্যস্ত নয়। তাই এগুলোকে বাক্য বলা যায় না। বাক্য হতে হলে পদগুলো সুবিন্যস্তভাবে সাজাতে হবে। যেমন -
পুকুরে গিয়ে বড় একটা মাছ ধরেছি।
রবীন্দ্রনাথ চলে যাওয়ায় বাড়িটা খাঁ খাঁ করছে।
একটি বাক্য সাধারণত কর্তা, কর্ম ও ক্রিয়াপদ নিয়ে গঠিত হয়। তবে একটি বাক্যকে সার্থক করে তুলতে আরও কতকগুলো গুণ বা শর্ত মানতে হয়।
১. আকাঙ্ক্ষা।
২. আসত্তি ও
৩. যোগ্যতা।
পলাশ মন দিয়ে লেখাপড়া ...
বললে বক্তার মনের ভাব সম্পূর্ণ বোঝা যায় না। আরও কিছু বলার বাকি থাকে। আরো কিছু শোনার ইচ্ছা জাগে। যদি বলা হয়
পলাশ মন দিয়ে লেখাপড়া করে। অথবা
পলাশ মন দিয়ে লেখাপড়া করতো। অথবা
পলাশ মন দিয়ে লেখাপড়া করবে।
বাবা বাজার ইলিশ থেকে এনেছেন।
-এখানে বক্তা যা বলতে চেয়েছেন তার সব উপকরণ আছে। কিন্তু পদগুলো যথাযথভাবে সাজানো হয় নি। ফলে সুস্পষ্ট কোনো অর্থও প্রকাশ পায় নি। কিন্তু
বাবা বাজার থেকে ইলিশ এনেছেন।
এভাবে লেখা হলে বক্তব্যটির অর্থ পুরোপুরি পরিষ্কার হয়ে একটি সুগঠিত বাক্য হতো। তাই সার্থক বাক্যে ব্যবহৃত পদগুলোর যথাযথ অবস্থানে থাকা আবশ্যক।
আমরা বড়শি দিয়ে মাছ ধরি।
এই উদাহরণটি একটি যথার্থই সার্থক বাক্য। যেহেতু এখানে পদগুলোর অর্থগত ও ভাবগত মিল বজায় রেখে তা বিশ্বাসের জন্ম দিয়েছে। কিন্তু
আমরা বড়শি দিয়ে নারকেল পাড়ি।
বললে বক্তব্যটিতে অর্থ ও ভাবের অসংগতি প্রকাশ পায়। তা বিশ্বাসযোগ্যও হয় না। কারণ বড়শি দিয়ে কেউ নারকেল পাড়ে না।
আরও দেখুন :- কর্মকারক কাকে বলে?
সুতরাং বাক্যে পদগুলোর মধ্যে অর্থের সংগতি ও ভাবের মিল রক্ষা করা আবশ্যক। নয়তো যোগ্যতার অভাবে তা বাক্য হবে না।
ক. গঠন অনুসারে বাক্য। এবং
খ. অর্থ অনুসারে বাক্য।
১. সরল বাক্য
২. মিশ্র বা জটিল বাক্য এবং
৩. যৌগিক বাক্য
১. বিবৃতিমূলক বা বর্ণনামূলক বাক্য,
২. প্রশ্নসূচক বাক্য,
৩. আদেশসূচক বাক্য,
৪. ইচ্ছাসূচক বাক্য,
৫. বিস্ময়সূচক বাক্য।
কিন্তু অর্থ অনুযায়ী বাক্যকে ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় সাতটি প্রকারে বিভক্ত করেছেন। যথা-
১. নির্দেশসূচক বাক্য,
২. প্রশ্নবাচক বাক্য,
৩. ইচ্ছা বা প্রার্থনাসূচক বাক্য,
৪. আজ্ঞাসূচক বাক্য,
৫. কার্যকারণাত্মক বাক্য,
৬. সংশয়সূচক বা সন্দেহদ্যোতক বাক্য ও
৭. আবেগসূচক বাক্য।
যে বাক্যে একটি মাত্র উদ্দেশ্য ও একটি মাত্র বিধেয় থাকে তাকে সরল বাক্য বলে।
যেমন- রহিম প্রতিদিন বিদ্যালয়ে যায়।
এই বাক্যটিতে উদ্দেশ্য হলো 'রহিম' ও 'প্রতিদিন বিদ্যালয়ে যায়' এটি বিধেয়।
মিশ্র বা জটিল বাক্য কাকে বলে :-
কোনো কোনো বাক্যে উদ্দেশ্য ও বিধেয় অর্থাৎ কর্তা ও সমাপিকা ক্রিয়া ছাড়া এক বা একাধিক অপ্রধান খন্ড বাক্য থাকতে পারে। এই অপ্রধান খন্ডাংশ মূল বাক্যেরই অংশ। এ ধরনের বাক্যকে মিশ্র বাক্য বলে।
আরও দেখুন :- ভাষন দেওয়ার নিয়ম?
আরও স্পষ্ট ভাষায় বললে, যে বাক্যে একটি স্বাধীন বাক্য এবং এক বা একাধিক অধীন বাক্য পরস্পর সাপেক্ষভাবে ব্যবহৃত হয়, তাকে জটিল বাক্য বা মিশ্র বাক্য বলে।
যেমন - 'সে যদি আসে, তবে আমি খাব।'
যিনি পরের উপকার করেন, তাকে সবাই শ্রদ্ধা করে।
এই বাক্যটিতে অপ্রধান খণ্ডবাক্য হলো 'সে যদি আসে' আর প্রধান খণ্ড বাক্য হলো 'তবে আমি খাব'।
এখানে প্রশ্ন আসে খণ্ডবাক্য কাকে বলে?
খণ্ডবাক্য :-
একাধিক বাক্য মিলে একটি জটিল বাক্য তৈরি হলে বাক্যের অন্তর্গত প্রতিটি বাক্য যদি স্বাধীন বাক্য না হয়ে অন্য কোনো বাক্যের অংশ হিসেবে ব্যবহৃত হয় তবে তাকে খণ্ডবাক্য বলে।
যেমন- 'যদি তুমি আস, তাহলে আমি যাব', এখানে 'তুমি আস' এবং 'আমি যাব' বাক্যাংশ দুটি খণ্ডবাক্য।
খণ্ডবাক্যকে দুই ভাগে ভাগ করা যাযয়। যেমন-
১. প্রধান খণ্ডবাক্য এবং
২. অধীন বা আশ্রিত খণ্ডবাক্য।
প্রধান খণ্ডবাক্য :
বাক্যে ব্যবহৃত যে খণ্ডবাক্য অর্থ প্রকাশের জন্য বাক্যের অন্য অংশের ওপর নির্ভরশীল নয়, তাকে প্রধান খণ্ডবাক্য বলে।
যেমন- 'আমি জানি যে সে কাজটি করেছে।'
এখানে 'সে কাজটি করেছে' বাক্যটি প্রধান খগুবাক্য। বাক্যটি এককভাবে উপস্থাপন করা হলেও এর পূর্ণ অর্থ প্রকাশ পায়।
অধীন বা আশ্রিত খণ্ডবাক্য :
বাক্যে ব্যবহৃত যে খণ্ডবাক্য তার পূর্ণাঙ্গ অর্থ প্রকাশের জন্য প্রধান খণ্ডবাক্যের ওপর নির্ভরশীল হয়, তাকে অধীন বা আশ্রিত খণ্ডবাক্য বলে।
যেমন- 'আমি অবাক হলাম তোমার কাণ্ডজ্ঞান দেখে।
এখানে 'তোমার কাণ্ডজ্ঞান দেখে' আশ্রিত খণ্ডবাক্য। বাক্যটি নিজেই নিজের পূর্ণ অর্থ প্রকাশ করতে পারে না। অর্থ প্রকাশের জন্য প্রধান খণ্ডবাক্যের উপর নির্ভর করতে হয়।
মিশ্র বা জটিল বাক্যের প্রকারভেদ :-
জটিল বাক্য প্রধানত তিন প্রকার। যথা-
১. আশ্রয়-আশ্রিত জটিল বাক্য
৩. সাপেক্ষ-পদযুক্ত জটিল বাক্য ও
৩. প্রতি-নির্দেশক সর্বনামযুক্ত জটিল বাক্য।
আশ্রয়-আশ্রিত জটিল বাক্য :-
যে জটিল বাক্যের আশ্রিত খণ্ডবাক্যটি প্রধান খণ্ডবাক্যের আশ্রয়ে থাকে এবং প্রধান খণ্ডবাক্যের সম্পূরক রূপে কাজ করে তাকে আশ্রয়-আশ্রিত জটিল বাক্য বলে।
যেমন- নিপা যে আসবে, তা বলা যায় না।
সাপেক্ষ-পদযুক্ত জটিল বাক্য :-
যে জটিল বাক্যের আশ্রিত খণ্ডবাক্য প্রধান খণ্ডবাক্যের বিধেয় ক্রিয়া সংগঠনের উপর নির্ভর করে, তাকে সাপেক্ষ-পদযুক্ত জটিল বাক্য বলে।
যেমন- 'কাল যদি ঝড় হয়, তবে বিদ্যালয় বন্ধ থাকবে।'
এ ধরনের জটিল বাক্যের প্রধান খণ্ড বাক্যে সাধারণত সাপেক্ষ অব্যয় 'যদি' এবং আশ্রিত খণ্ডবাক্যে 'তাহলে / তবে / না হয়' ইত্যাদি দ্বারা যুক্ত থাকে।
প্রতি নির্দেশক সর্বনামযুক্ত জটিল বাক্য :-
যখন তখন, যা তা, যাহা তাহা, যার-তার, যেখানে-সেখানে, যথা-তথা ইত্যাদি প্রতিনির্দেশক সর্বনাম ব্যবহার করে জটিল বাক্য গঠন করলে। তাকে প্রতিনির্দেশক সর্বনাম যুক্ত জটিল বাক্য বলে।
যেমন- 'যখন রোদ উঠল, তখন আমরা বাড়ি পৌঁছে গেছি।
যৌগিক বাক্য কাকে বলে :-
দুই বা তার বেশি সরল বা জটিল বাক্য সংযোজক বা বিয়োজক অব্যয় দ্বারা যুক্ত হয়ে একটি দীর্ঘবাক্য গঠন করলে তাকে যৌগিক বাক্য বলে।
যৌগিক বাক্যের মধ্যে অন্তর্গত নিরপেক্ষ বাক্য গুলো - অথবা, এবং, কিংবা, ও, বরং, কিন্তু, তথাপি, যথা ইত্যাদি অব্যয়যোগে সংযুক্ত থাকে।
সরল বাক্যের সাথে সরল বাক্য বা জটিল বাক্যের সঙ্গে জটিল বাক্য বা সরল বাক্যের সঙ্গে জটিল বাক্য বা জটিল বাক্যের সাথে সরল বাক্য সংযোজক অব্যয় দ্বারা যুক্ত হয়ে যৌগিক বাক্য গঠিত হয়।
যেমন- 'তুমি বুদ্ধিমান কিন্তু তোমার সাথে যে এসেছিল সে বোকা।
বিবৃতিমূলক বাক্য :-
যে বাক্যে কোনো বক্তব্যকে সাধারণ ভাবে বিবৃত বা বর্ণনা করা হয়, তাকে বিবৃতিমূলক বা বর্ণনামূলক বাক্য বলে।
যেমন- ওসমান ভালো ক্রিকেট খেলতে পারে।
বিবৃতিমূলক বাক্য দুই প্রকারের। যথা -
১. অস্তিবাচক বাক্য এবং
২. নেতিবাচক বাক্য।
অস্তিবাচক বাক্য :-
যে বাক্যে কোনো ঘটনা, ভাব বা বক্তব্যের অস্তিত্ব হ্যাঁ-বোধক অর্থ প্রকাশ করে, তাকে অস্তিবাচক বাক্য বা হ্যাঁ-বাচক বাক্য বলে।
যেমন- ভাল জিনিসের কদর বেশি।
নেতিবাচক বাক্য :-
যে বাক্যে কোনো ঘটনা, ভাব বা বক্তব্যের অস্তিত্ব যদি না - বোধক অর্থে প্রকাশিত হয়, তখন তাকে নেতিবাচক বাক্য বলে।
যেমন - 'ফরিদা আজ স্কুলে যাবে না।
প্রশ্নবোধক বাক্য :-
যে বাক্যে কোনো ঘটনা, কাহিনি বা বক্তব্য বর্ণনায় প্রশ্নসূচক অর্থ প্রকাশ পায়, তখন তাকে প্রশ্নবোধক বাক্য বলে।
যেমন: 'আপনি কোথা থেকে এসেছেন?'
অনুজ্ঞাবাচক বাক্য :-
যে বাক্য দ্বারা বর্তমান ও ভবিষ্যতের কোনো অনুরোধ, অনুমতি, আদেশ, নিষেধ উপদেশ, ইত্যাদি বিষয়ে বোঝায়, সেই সব বাক্যকে অনুজ্ঞাবাচক বাক্য বলে।
যেমন - দয়া করে বইটি দিন।
ইচ্ছা বা প্রার্থনাসূচক বাক্য :-
যে বাক্যে বক্তার ইচ্ছা বা প্রার্থনাসূচক অর্থ প্রকাশ পায়, তাকে ইচ্ছা বা প্রার্থনাসূচক বাক্য বলে।
যেমন- 'তুমি সাধনায় সফল হও।'
আবেগসূচক বাক্য :-
যে বাক্যে বক্তার মনের আনন্দ, বেদনা, শোক-বিষাদ ইত্যাদি আবেগ প্রকাশ পায়, তাকে আবেগসূচক বাক্য বলে।
যেমন - হুররে! আমরা খেলায় জিতেছি।
সংশয়সূচক বাক্য :-
যে ধরনের নির্দেশক বাক্যে বক্তব্য বিষয় সম্পর্কে সংশয়, সন্দেহ, সম্ভাবনা, অনুমান, অনিশ্চয়তা ইত্যাদি ভাব প্রকাশিত হয়, তাকে সংশয়সূচক বাকা বলে।
যেমন- 'মনে হয়, রহমান পাস করবে না।'
কার্যকারণাত্মক বাক্য :-
যে সব বাক্যে কোনো নিয়ম, স্বাকৃতি, শর্ত বা সংকেত প্রকাশ পায়, তাকে কার্যকরাণাত্মক বাক্য বলে।
যেমন- যদি আমি আসতে না পারি, তাহলে তুমি চলে যেও।
বাক্য কাকে বলে :-
ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ তাঁর 'বাঙ্গালা ব্যাকরণ' গ্রন্থে বাক্য কাকে বলে (bakko kake bole) তার আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন -"একটি সম্পূর্ণ মনোভাব যে সমস্ত পদ দ্বারা প্রকাশ করা যায়, তাদের সমষ্টিকে বাক্য বলে।"
বাক্য কি এ সম্পর্কে মুনীর চৌধুরী ও মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী বলেছেন -
“যে সুবিন্যস্ত পদসমষ্টি দ্বারা কোনো বিষয়ে বক্তার মনোভাব সম্পূর্ণরূপে প্রকাশিত হয়, তাকে বাক্য বলে।"
সুতরাং বাক্য কাকে বলে এর উত্তরে আমরা বলতে পারি, এক বা একাধিক পদের দ্বারা যখন বক্তার মনোভাব সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ পায়, তখন তাকে বাক্য বলে।
আরও পড়ুন :- বচন কাকে বলে? উদাহরণ দাও?
যেমন :-
লেখ।
আমি খাই।
কাজী নজরুল ইসলাম বই লিখছেন।
প্রত্যেকটি বাক্যের পদগুলোর মধ্যে একটি পারস্পরিক সম্পর্ক বা অন্বয় থাকতে হয়, যার কারণে বক্তার মনোভাব বা বক্তব্য স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে।
যেমন লক্ষ কর -
গিয়ে পুকুরে বড় ধরেছি একটা মাছ।
খাঁ খাঁ অপু যাওয়ায় চলে করছে বাড়িটা।
বাক্য দুটোতে বক্তার মনোভাব পরিষ্কার নয়। কেননা, পদগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক নেই এবং পদগুলো সুবিন্যস্ত নয়। তাই এগুলোকে বাক্য বলা যায় না। বাক্য হতে হলে পদগুলো সুবিন্যস্তভাবে সাজাতে হবে। যেমন -
পুকুরে গিয়ে বড় একটা মাছ ধরেছি।
রবীন্দ্রনাথ চলে যাওয়ায় বাড়িটা খাঁ খাঁ করছে।
একটি বাক্য সাধারণত কর্তা, কর্ম ও ক্রিয়াপদ নিয়ে গঠিত হয়। তবে একটি বাক্যকে সার্থক করে তুলতে আরও কতকগুলো গুণ বা শর্ত মানতে হয়।
বাক্য গঠনের শর্ত :-
একটি আদর্শ বা সার্থক বাক্য তখনই গঠিত হবে যখন বাক্যটির মধ্যে তিনটি গুণ বা বৈশিষ্ট্য থাকবে। এ গুণগুলো হচ্ছে -১. আকাঙ্ক্ষা।
২. আসত্তি ও
৩. যোগ্যতা।
১. আকাঙ্ক্ষা কাকে বলে :
যে কোনো বাক্যের অর্থ সম্পূর্ণ রূপে বোঝার জন্য একটি পদ শোনার পর অন্য পদ শোনার ইচ্ছা বা আগ্রহকে আকাঙ্ক্ষা বলা হয়। যেমন:পলাশ মন দিয়ে লেখাপড়া ...
বললে বক্তার মনের ভাব সম্পূর্ণ বোঝা যায় না। আরও কিছু বলার বাকি থাকে। আরো কিছু শোনার ইচ্ছা জাগে। যদি বলা হয়
পলাশ মন দিয়ে লেখাপড়া করে। অথবা
পলাশ মন দিয়ে লেখাপড়া করতো। অথবা
পলাশ মন দিয়ে লেখাপড়া করবে।
আরও দেখুন :- কর্তৃকারক কাকে বলে?
২. আসত্তি কাকে বলে :-
বাক্য গঠনের দ্বিতীয় শর্ত হলো আসত্তি। বাক্যের অর্থসংগতি রক্ষা করে পদগুলোকে যথাযথভাবে সাজিয়ে রাখার নাম আসত্তি। যেমন :বাবা বাজার ইলিশ থেকে এনেছেন।
-এখানে বক্তা যা বলতে চেয়েছেন তার সব উপকরণ আছে। কিন্তু পদগুলো যথাযথভাবে সাজানো হয় নি। ফলে সুস্পষ্ট কোনো অর্থও প্রকাশ পায় নি। কিন্তু
বাবা বাজার থেকে ইলিশ এনেছেন।
এভাবে লেখা হলে বক্তব্যটির অর্থ পুরোপুরি পরিষ্কার হয়ে একটি সুগঠিত বাক্য হতো। তাই সার্থক বাক্যে ব্যবহৃত পদগুলোর যথাযথ অবস্থানে থাকা আবশ্যক।
৩. যোগ্যতা কাকে বলে :-
বাক্যের মধ্যে ব্যবহৃত পদগুলোর অর্থের সংগতি ও ভাবের মিলবন্ধনকে বলা হয় যোগ্যতা। যেমন :আমরা বড়শি দিয়ে মাছ ধরি।
এই উদাহরণটি একটি যথার্থই সার্থক বাক্য। যেহেতু এখানে পদগুলোর অর্থগত ও ভাবগত মিল বজায় রেখে তা বিশ্বাসের জন্ম দিয়েছে। কিন্তু
আমরা বড়শি দিয়ে নারকেল পাড়ি।
বললে বক্তব্যটিতে অর্থ ও ভাবের অসংগতি প্রকাশ পায়। তা বিশ্বাসযোগ্যও হয় না। কারণ বড়শি দিয়ে কেউ নারকেল পাড়ে না।
আরও দেখুন :- কর্মকারক কাকে বলে?
সুতরাং বাক্যে পদগুলোর মধ্যে অর্থের সংগতি ও ভাবের মিল রক্ষা করা আবশ্যক। নয়তো যোগ্যতার অভাবে তা বাক্য হবে না।
বাক্য কত প্রকার ও কি কি :-
সার্থক বাক্যকে আমরা দুটি দিক থেকে ভাগ করতে পারি। যেমন:ক. গঠন অনুসারে বাক্য। এবং
খ. অর্থ অনুসারে বাক্য।
ক. গঠন অনুসারে বাক্যের শ্রেনীবিভাগ :-
গঠনগত দিক থেকে বিচার করলে আমরা তিন প্রকার বাক্য পাই।১. সরল বাক্য
২. মিশ্র বা জটিল বাক্য এবং
৩. যৌগিক বাক্য
খ. অর্থ অনুসারে বাক্যের প্রকারভেদ :-
অর্থ অনুসারে বাংলা বাক্যকে পাঁচ ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন:১. বিবৃতিমূলক বা বর্ণনামূলক বাক্য,
২. প্রশ্নসূচক বাক্য,
৩. আদেশসূচক বাক্য,
৪. ইচ্ছাসূচক বাক্য,
৫. বিস্ময়সূচক বাক্য।
কিন্তু অর্থ অনুযায়ী বাক্যকে ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় সাতটি প্রকারে বিভক্ত করেছেন। যথা-
১. নির্দেশসূচক বাক্য,
২. প্রশ্নবাচক বাক্য,
৩. ইচ্ছা বা প্রার্থনাসূচক বাক্য,
৪. আজ্ঞাসূচক বাক্য,
৫. কার্যকারণাত্মক বাক্য,
৬. সংশয়সূচক বা সন্দেহদ্যোতক বাক্য ও
৭. আবেগসূচক বাক্য।
বিভিন্ন প্রকার বাক্যের সংজ্ঞা :-
সরল বাক্য কাকে বলে :-যে বাক্যে একটি মাত্র উদ্দেশ্য ও একটি মাত্র বিধেয় থাকে তাকে সরল বাক্য বলে।
যেমন- রহিম প্রতিদিন বিদ্যালয়ে যায়।
এই বাক্যটিতে উদ্দেশ্য হলো 'রহিম' ও 'প্রতিদিন বিদ্যালয়ে যায়' এটি বিধেয়।
মিশ্র বা জটিল বাক্য কাকে বলে :-
কোনো কোনো বাক্যে উদ্দেশ্য ও বিধেয় অর্থাৎ কর্তা ও সমাপিকা ক্রিয়া ছাড়া এক বা একাধিক অপ্রধান খন্ড বাক্য থাকতে পারে। এই অপ্রধান খন্ডাংশ মূল বাক্যেরই অংশ। এ ধরনের বাক্যকে মিশ্র বাক্য বলে।
আরও দেখুন :- ভাষন দেওয়ার নিয়ম?
আরও স্পষ্ট ভাষায় বললে, যে বাক্যে একটি স্বাধীন বাক্য এবং এক বা একাধিক অধীন বাক্য পরস্পর সাপেক্ষভাবে ব্যবহৃত হয়, তাকে জটিল বাক্য বা মিশ্র বাক্য বলে।
যেমন - 'সে যদি আসে, তবে আমি খাব।'
যিনি পরের উপকার করেন, তাকে সবাই শ্রদ্ধা করে।
এই বাক্যটিতে অপ্রধান খণ্ডবাক্য হলো 'সে যদি আসে' আর প্রধান খণ্ড বাক্য হলো 'তবে আমি খাব'।
এখানে প্রশ্ন আসে খণ্ডবাক্য কাকে বলে?
খণ্ডবাক্য :-
একাধিক বাক্য মিলে একটি জটিল বাক্য তৈরি হলে বাক্যের অন্তর্গত প্রতিটি বাক্য যদি স্বাধীন বাক্য না হয়ে অন্য কোনো বাক্যের অংশ হিসেবে ব্যবহৃত হয় তবে তাকে খণ্ডবাক্য বলে।
যেমন- 'যদি তুমি আস, তাহলে আমি যাব', এখানে 'তুমি আস' এবং 'আমি যাব' বাক্যাংশ দুটি খণ্ডবাক্য।
খণ্ডবাক্যকে দুই ভাগে ভাগ করা যাযয়। যেমন-
১. প্রধান খণ্ডবাক্য এবং
২. অধীন বা আশ্রিত খণ্ডবাক্য।
প্রধান খণ্ডবাক্য :
বাক্যে ব্যবহৃত যে খণ্ডবাক্য অর্থ প্রকাশের জন্য বাক্যের অন্য অংশের ওপর নির্ভরশীল নয়, তাকে প্রধান খণ্ডবাক্য বলে।
যেমন- 'আমি জানি যে সে কাজটি করেছে।'
এখানে 'সে কাজটি করেছে' বাক্যটি প্রধান খগুবাক্য। বাক্যটি এককভাবে উপস্থাপন করা হলেও এর পূর্ণ অর্থ প্রকাশ পায়।
অধীন বা আশ্রিত খণ্ডবাক্য :
বাক্যে ব্যবহৃত যে খণ্ডবাক্য তার পূর্ণাঙ্গ অর্থ প্রকাশের জন্য প্রধান খণ্ডবাক্যের ওপর নির্ভরশীল হয়, তাকে অধীন বা আশ্রিত খণ্ডবাক্য বলে।
যেমন- 'আমি অবাক হলাম তোমার কাণ্ডজ্ঞান দেখে।
এখানে 'তোমার কাণ্ডজ্ঞান দেখে' আশ্রিত খণ্ডবাক্য। বাক্যটি নিজেই নিজের পূর্ণ অর্থ প্রকাশ করতে পারে না। অর্থ প্রকাশের জন্য প্রধান খণ্ডবাক্যের উপর নির্ভর করতে হয়।
মিশ্র বা জটিল বাক্যের প্রকারভেদ :-
জটিল বাক্য প্রধানত তিন প্রকার। যথা-
১. আশ্রয়-আশ্রিত জটিল বাক্য
৩. সাপেক্ষ-পদযুক্ত জটিল বাক্য ও
৩. প্রতি-নির্দেশক সর্বনামযুক্ত জটিল বাক্য।
আশ্রয়-আশ্রিত জটিল বাক্য :-
যে জটিল বাক্যের আশ্রিত খণ্ডবাক্যটি প্রধান খণ্ডবাক্যের আশ্রয়ে থাকে এবং প্রধান খণ্ডবাক্যের সম্পূরক রূপে কাজ করে তাকে আশ্রয়-আশ্রিত জটিল বাক্য বলে।
যেমন- নিপা যে আসবে, তা বলা যায় না।
সাপেক্ষ-পদযুক্ত জটিল বাক্য :-
যে জটিল বাক্যের আশ্রিত খণ্ডবাক্য প্রধান খণ্ডবাক্যের বিধেয় ক্রিয়া সংগঠনের উপর নির্ভর করে, তাকে সাপেক্ষ-পদযুক্ত জটিল বাক্য বলে।
যেমন- 'কাল যদি ঝড় হয়, তবে বিদ্যালয় বন্ধ থাকবে।'
এ ধরনের জটিল বাক্যের প্রধান খণ্ড বাক্যে সাধারণত সাপেক্ষ অব্যয় 'যদি' এবং আশ্রিত খণ্ডবাক্যে 'তাহলে / তবে / না হয়' ইত্যাদি দ্বারা যুক্ত থাকে।
প্রতি নির্দেশক সর্বনামযুক্ত জটিল বাক্য :-
যখন তখন, যা তা, যাহা তাহা, যার-তার, যেখানে-সেখানে, যথা-তথা ইত্যাদি প্রতিনির্দেশক সর্বনাম ব্যবহার করে জটিল বাক্য গঠন করলে। তাকে প্রতিনির্দেশক সর্বনাম যুক্ত জটিল বাক্য বলে।
যেমন- 'যখন রোদ উঠল, তখন আমরা বাড়ি পৌঁছে গেছি।
যৌগিক বাক্য কাকে বলে :-
দুই বা তার বেশি সরল বা জটিল বাক্য সংযোজক বা বিয়োজক অব্যয় দ্বারা যুক্ত হয়ে একটি দীর্ঘবাক্য গঠন করলে তাকে যৌগিক বাক্য বলে।
যৌগিক বাক্যের মধ্যে অন্তর্গত নিরপেক্ষ বাক্য গুলো - অথবা, এবং, কিংবা, ও, বরং, কিন্তু, তথাপি, যথা ইত্যাদি অব্যয়যোগে সংযুক্ত থাকে।
সরল বাক্যের সাথে সরল বাক্য বা জটিল বাক্যের সঙ্গে জটিল বাক্য বা সরল বাক্যের সঙ্গে জটিল বাক্য বা জটিল বাক্যের সাথে সরল বাক্য সংযোজক অব্যয় দ্বারা যুক্ত হয়ে যৌগিক বাক্য গঠিত হয়।
যেমন- 'তুমি বুদ্ধিমান কিন্তু তোমার সাথে যে এসেছিল সে বোকা।
বিবৃতিমূলক বাক্য :-
যে বাক্যে কোনো বক্তব্যকে সাধারণ ভাবে বিবৃত বা বর্ণনা করা হয়, তাকে বিবৃতিমূলক বা বর্ণনামূলক বাক্য বলে।
যেমন- ওসমান ভালো ক্রিকেট খেলতে পারে।
বিবৃতিমূলক বাক্য দুই প্রকারের। যথা -
১. অস্তিবাচক বাক্য এবং
২. নেতিবাচক বাক্য।
অস্তিবাচক বাক্য :-
যে বাক্যে কোনো ঘটনা, ভাব বা বক্তব্যের অস্তিত্ব হ্যাঁ-বোধক অর্থ প্রকাশ করে, তাকে অস্তিবাচক বাক্য বা হ্যাঁ-বাচক বাক্য বলে।
যেমন- ভাল জিনিসের কদর বেশি।
নেতিবাচক বাক্য :-
যে বাক্যে কোনো ঘটনা, ভাব বা বক্তব্যের অস্তিত্ব যদি না - বোধক অর্থে প্রকাশিত হয়, তখন তাকে নেতিবাচক বাক্য বলে।
যেমন - 'ফরিদা আজ স্কুলে যাবে না।
প্রশ্নবোধক বাক্য :-
যে বাক্যে কোনো ঘটনা, কাহিনি বা বক্তব্য বর্ণনায় প্রশ্নসূচক অর্থ প্রকাশ পায়, তখন তাকে প্রশ্নবোধক বাক্য বলে।
যেমন: 'আপনি কোথা থেকে এসেছেন?'
অনুজ্ঞাবাচক বাক্য :-
যে বাক্য দ্বারা বর্তমান ও ভবিষ্যতের কোনো অনুরোধ, অনুমতি, আদেশ, নিষেধ উপদেশ, ইত্যাদি বিষয়ে বোঝায়, সেই সব বাক্যকে অনুজ্ঞাবাচক বাক্য বলে।
যেমন - দয়া করে বইটি দিন।
ইচ্ছা বা প্রার্থনাসূচক বাক্য :-
যে বাক্যে বক্তার ইচ্ছা বা প্রার্থনাসূচক অর্থ প্রকাশ পায়, তাকে ইচ্ছা বা প্রার্থনাসূচক বাক্য বলে।
যেমন- 'তুমি সাধনায় সফল হও।'
আবেগসূচক বাক্য :-
যে বাক্যে বক্তার মনের আনন্দ, বেদনা, শোক-বিষাদ ইত্যাদি আবেগ প্রকাশ পায়, তাকে আবেগসূচক বাক্য বলে।
যেমন - হুররে! আমরা খেলায় জিতেছি।
সংশয়সূচক বাক্য :-
যে ধরনের নির্দেশক বাক্যে বক্তব্য বিষয় সম্পর্কে সংশয়, সন্দেহ, সম্ভাবনা, অনুমান, অনিশ্চয়তা ইত্যাদি ভাব প্রকাশিত হয়, তাকে সংশয়সূচক বাকা বলে।
যেমন- 'মনে হয়, রহমান পাস করবে না।'
কার্যকারণাত্মক বাক্য :-
যে সব বাক্যে কোনো নিয়ম, স্বাকৃতি, শর্ত বা সংকেত প্রকাশ পায়, তাকে কার্যকরাণাত্মক বাক্য বলে।
যেমন- যদি আমি আসতে না পারি, তাহলে তুমি চলে যেও।
0 মন্তব্যসমূহ
Please do not enter any spam link in the comment box.