ভাবসম্প্রসারন কাকে বলে বা কি ? ভাবসম্প্রসারণ এর কয়টি অংশ ও লেখার নিয়ম

ভাষার মাধুর্যময় আধারে ভাবের যথার্থ প্রকাশই সাহিত্যিকের সিদ্ধি।

কবি-সাহিত্যিকদের রচনায় অনেক সময় ভাব-সংহত বাক্য বা চরণ থাকে, যার মিত-অবয়বে লুক্কায়িত থাকে জীবন ও জগৎ সম্পর্কিত গূঢ় কথা, নিহিত থাকে ভূয়োদর্শনের শক্তি। ইতিময়, রূপকাশ্রয়ী স্বল্প-বাক উক্তিগুলো বিশ্লেষণে বের হয়ে আসে গত জীবন সম্পর্কে বৃহৎ ভাব, জীবনের অদ্ভুদর্শন। এই ধরনের ভাবগূঢ় বাক্যগুলোর ব্যাখ্যা-বিশেষণই হলো ভাবসম্প্রসারণ

আরও স্পষ্ট ভাষায় ভাবসম্প্রসারণ কি তা বললে বোঝায়, কবি, সাহিত্যিক, মনীষীদের রচনা কিংবা হাজার বছর ধরে প্রচলিত প্রবাদ প্রবচনে নিহিত থাকে জীবনসত্য। এ-ধরনের গভীর ভাব বিশ্লেষণ করে তা সহজভাবে বুঝিয়ে দেওয়াকে বলে ভাবসম্প্রসারণ


ভাবের সম্প্রসারণে বক্তব্য বিষয় স্পষ্ট ও বোধগমা হয়ে ওঠে। যথাযথ শব্দ প্রয়োগ আর উপমা, দৃষ্টান্ত, তুলনা ইত্যাদির আশ্রয়ে ভাবের সম্প্রসারণের কাজটি সম্পন্ন করতে হয়।

ভাবসম্প্রসারণ বলতে বোঝায় -

কোন বিষয়, ঘটনা বা ধারণার উপর চিন্তা-ভাবনা করা এবং সেই বিষয়ের ব্যাপ্তি বা পরিসর বর্ধিত করা।

উদাহরণস্বরূপ:
  • - কোন ঘটনা বা অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সাধারণীকরণ করা (যেমন, একটি ঘটনা থেকে সবার জন্য পাঠ উপলব্ধি করা)
  • - কোন ধারণা বা বিষয়কে বৃহত্তর পরিসরে অন্তর্ভুক্ত করা (যেমন, কোন নিয়ম বা প্রমেয়ের প্রয়োগ বিভিন্ন পরিস্থিতিতে)
  • - কোন ধারণা বা বিষয়ের ওপর ব্যাপক ভাবে মনোযোগ দেয়া এবং তার বিভিন্ন দিক খুঁজে বের করা
  • - একটি বিষয় নিয়ে বিভিন্ন চিন্তাভাবনা তুলে আনা এবং সংশ্লিষ্ট তথ্যের সাথে সংযোগ স্থাপন করা

এভাবে বাংলা ব্যাকরণে ভাবসম্প্রসারণ হল কোন বিষয়ের ওপর বিস্তৃতভাবে চিন্তা করা এবং তার ব্যাপ্তি বা পরিসর বাড়িয়ে দেয়ার মানসিক প্রক্রিয়া।

ভাব সম্প্রসারণ এর মূল উদ্দেশ্য কি :-

ভাব সম্প্রসারণের কিছু মূল উদ্দেশ্য নিম্নরূপ:
  • - বিষয়বস্তুর উপর গভীর ও বিস্তারিত ধারণা লাভ করা।
  • - প্রাসঙ্গিক তথ্য এবং অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নতুন চিন্তা এবং ধারণার সৃষ্টি।
  • - পূর্ব-অর্জিত জ্ঞানের সাথে নতুন তথ্য এবং ধারণার সংযোগ স্থাপন।
  • - বিষয়বস্তুর বিভিন্ন দিক বিবেচনা করার মত প্রশ্ন করার ক্ষমতা বৃদ্ধি।
  • - বিশ্লেষণাত্মক চিন্তা এবং তর্ক করার দক্ষতা উন্নয়ন।
  • - সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সাহায্য করা।
  • - লেখাপড়া, কাজ এবং জীবনে প্রয়োগ করার জ্ঞান অর্জন।
  • - নতুন উদ্ভাবন এবং আবিষ্কারের জন্য ভিত তৈরি।

এর মাধ্যমে ব্যক্তির চিন্তাশক্তি বৃদ্ধি পায় এবং তিনি সমস্যা সমাধানে দক্ষ হয়।

ভাবসম্প্রসারণ লেখার নিয়ম :-

১. উদ্ধৃত অংশটি বার বার পড়ে মূল ভাবটি বুঝে নিতে হবে।

২. যুক্তি ও উদাহরণ সহকারে অন্তর্নিহিত ভাবটি বিশদভাবে আলোচনা করতে হবে।

৩. বক্তব্য যাতে মূল ভাব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে না পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

৪. এক কথার পুনরাবৃত্তি এবং বক্তব্য যাতে একঘেয়েমিপূর্ণ ও রসহীন না হয় সেদিকে মনোযোগী হতে হবে।

৫. ভাব-সম্প্রসারণের ভাষা হবে সহজ, সরল ও আকর্ষণীয়। মূল ভাব বোঝানোর জন্যে সার্থক দৃষ্টান্ত থাকা দরকার।

৬ মূল অংশ অপেক্ষা ভাবের সম্প্রসারণ দীর্ঘতর হবে।

ভাবসম্প্রসারণ এর কয়টি অংশ :-

ভাবসম্প্রসারণের তিনটি অংশ

(1) আভিধানিক অর্থ

(২) মূল ভাব

(৩) মূল ভাব প্রকাশের উপযোগী যুৎসই দৃষ্টান্ত।
ভাবসম্প্রসারন কি

ভাব-সম্প্রসারণ রচনায় অনুসরণীয় -

১. বারংবার পাঠ করে উদ্ধৃত বাক্যের মর্মোদ্ধার করা প্রথম করণীয়।

২. বাক্যের অলংকারের আড়ালে নিহিত সারসত্য গভীরভাবে অনুধাবন করতে হবে।

৩. সহজ, সরল ও বাহুল্যবর্জিত বাক্য ব্যবহারে বিশ্লেষণ করতে হবে। প্রয়োজনানুসারে প্রাসঙ্গিকভাবে দৃষ্টান্ত, তথ্য ও উদ্ধৃতি ব্যবহার করতে হবে।

আরও পড়ুন :- চর্যাপদ কি? 

৪. উপমাত্মক বাক্যের ভাব-সম্প্রসারণে উপমান ও উপমেয় অংশকে দুটো অনুচ্ছেদে বিশেষণ করা বাঞ্ছনীয়। প্রথম অনুচ্ছেদে থাকবে আক্ষরিক অর্থ, দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে ব্যক্তনার্থ।

৫. ভাব-সম্প্রসারণ হবে মূলভাবের অনুসারী, অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্য সম্পূর্ণরূপে পরিহার্য।

৬. প্রারম্ভিক বাক্যটি হবে সুসংহত, ঘনপিনদ্ধ ও শ্রুতিমধুর এবং ক্রিয়াপদ বিরহিত।

৭. নির্ভুল উক্তি ও প্রবাদ প্রবচনের ব্যবহারে ভাব সম্প্রসারণ হয়ে ওঠে সৌন্দর্যময়।

৮. উদ্ধৃতি ব্যবহারে লেখকের নাম ব্যবহার অবশ্যই পরিহার্য।

৯. সম্প্রসারিত ভাবের আয়তন ততটুকুই হবে, যতটুকুতে ভাবের প্রকাশ সম্পূর্ণতা পায়।

১০. বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি কঠোরভাবে পরিহার করতে হবে। এতে বক্তব্যের ভাব-গাম্ভীর্য ও ওজস্বিতা বিনষ্ট হয়।

ভাবসম্প্রসারণের বৈশিষ্ট্য :-

ভাবসম্প্রসারণের কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপ:
  • - বিষয়বস্তু সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা লাভ: ভাবসম্প্রসারণের মাধ্যমে কোন বিষয়ের ব্যাপ্তি বৃদ্ধি পায় এবং বিষয়বস্তু সম্পর্কে আরও গভীর ও বিস্তারিত ধারণা লাভ করা যায়।
  • - নতুন চিন্তার সৃষ্টি: প্রাসঙ্গিক তথ্য এবং অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নতুন চিন্তা এবং ধারণা গড়ে ওঠে।
  • -পূর্ব-অজ্ঞাত সংযোগ: পূর্ববর্তী জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতার সাথে নতুন তথ্য এবং ধারণার সংযোগ স্থাপন।
  • - প্রশ্ন করার মতামত দেয়ার ক্ষমতা বৃদ্ধি: নতুন প্রশ্নের সৃষ্টি এবং বিষয়বস্তুর বিভিন্ন দিক বিবেচনা।
  • - বিশ্লেষণাত্মক চিন্তার উন্নয়ন: বিষয়বস্তুর গভীর বুঝ এবং বিশ্লেষণাত্মক চিন্তার উন্নয়ন।
  • - সমস্যা সমাধানে সাহায্য: বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি বিবেচনা করে সমস্যা সমাধানে সাহায্য করে।

নীচে ভাবসম্প্রসারণ এর একটি উদাহরণ দেওয়া হলো :-

ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়।

ভাবসম্প্রসারণ :

জীবন কর্মময়। কর্মশক্তির মূলে রয়েছে উৎসাহ-উদ্দীপনা আর প্রবল আগ্রহ। আগ্রহের সঙ্গে নিষ্ঠা থাকলে অসাধ্যকে সাধন করা যায়। মানুষকে সব বাধা অতিক্রম করতে সাহায্য করে ইচ্ছাশক্তি। প্রতিদিনই আমাদের কোনো-না-কোনো কাজ করতে হয়। পৃথিবীতে কোনো কাজই বিনা বাধায় করা যায় না। সব কাজেই কিছু-না-কিছু সুবিধা-অসুবিধা ও বাধা-বিপত্তি থাকে। সেই অসুবিধা ও বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করতে পারলেই সাফল্য আসে। এজন্য প্রয়োজন প্রবল ইচ্ছা। ইচ্ছা থাকলে কোনো কাজ আটকে থাকে না। ইচ্ছাই মানুষকে সামনের দিকে এগিয়ে নেয়। ইচ্ছাই সকল কর্মের প্রেরণা। দৃঢ় ইচ্ছার কাছে সকল বাধা হার মানে। প্রবল ইচ্ছা নিয়ে কোনো কাজ করলে অতি কঠিন কাজও শেষ করা যায়। পৃথিবীর মহান ব্যক্তিরা এভাবেই সব ধরনের বিপত্তি অতিক্রম করে লক্ষ্যে পৌঁছেছেন। সম্রাট নেপোলিয়ান তাঁর সেনাবাহিনীসহ আল্পস পর্বতের কাছে গিয়ে অসীম উৎসাহে বলে ওঠেন : আমার বিজয় অভিযানের মুখে আল্পস পর্বত থাকবে না।' আত্মশক্তি ও ইচ্ছাশক্তির বলে তিনি আল্পস পার হতে পেরেছিলেন। মানুষের সকল কাজের মূল হলো ইচ্ছাশক্তি। ইচ্ছাই মানুষকে সাফল্যের দ্বারে পৌঁছে দেয়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ