পৃথিবীর অন্যান্য উন্নত ভাষার মতো বাংলা ভাষারও অনেক আলাদা রূপ আছে: একটি হলো বলার ভাষা বা মৌখিক রূপ, অপরটি হলো লেখার ভাষা বা লৈখিক রূপ। মৌখিক ভাষা আবার দুটো রয়েছে, যথা : আঞ্চলিক ভাষা ও প্রমিত ভাষা। অপর দিকে লৈখিক ভাষারও দুটো আলাদা রীতি আছে, যেমন : চলিত ভাষা ও সাধু ভাষা।
সাধুভাষার তুলনায় চলিতভাষা বা চলিতরীতি নবীন। সাধুরীতির জন্ম হয়েছে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে আর চলিভাষার সৃষ্টি হয় ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে।
সাধু ভাষা কাকে বলে এ সম্পর্কে ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছেন -
"সাধারণ গদ্য সাহিত্যে ব্যবহৃত বাঙ্গালা ভাষাকে সাধু ভাষা বলে।"
চলিত ভাষা কাকে বলে এ সম্পর্কে ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছেন -
দক্ষিণ-পশ্চিমবঙ্গে ভাগীরথী নদীর তীরবর্তী স্থানের ভদ্র ও শিক্ষিত সমাজে ব্যবহৃত মৌখিক ভাষা, সমগ্র বাংলাদেশের শিক্ষিত সমাজ কর্তৃক শ্রেষ্ঠ মৌখিক ভাষা বলে গৃহীত হইয়াছে। এই মৌখিক ভাষাকে বিশেষভাবে চলিত ভাষা বলা হয়।
১. সাধু ভাষা ব্যবহার করার মাধ্যমে সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বজায় থাকে। বাংলা সাহিত্যে সাধু বা তৎসম ভাষা ব্যবহার হয় প্রচলিত হচ্ছে।
২. সাধু ভাষায় নৈতিকতা ও সংস্কৃতির প্রতি খ্যাতি রয়েছে। তাই এর ব্যবহার দিয়ে সমাজের নৈতিকতার উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব।
৩. সাধু বা চলিত ভাষার ব্যবহার করলে কথাগুলোকে আরও সুন্দরভাবে তুলে ধরা সম্ভব। তা পাঠক, শ্রোতা ও দর্শকদের আকৃষ্ট করে।
৪. প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে রয়েছে বেশ কিছু মনোরম কবিতা, গল্প, উপন্যাস যেগুলো সাধু ভাষায় রচিত। ভাষার সমৃদ্ধির জন্য এগুলো পড়া প্রয়োজন।
৫. সুসংস্কারিত ও সভ্য মানুষ হওয়ার জন্যও সাধু ভাষার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করা হয়।
এগুলো ছিল সাধু ভাষার গুরুত্ব এবং প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আমার ধারণা।
সাধুভাষার তুলনায় চলিতভাষা বা চলিতরীতি নবীন। সাধুরীতির জন্ম হয়েছে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে আর চলিভাষার সৃষ্টি হয় ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে।
সাধু ভাষা কাকে বলে :-
যে ভাষা রীতিতে ক্রিয়াপদ ও সর্বনাম পদ পূর্ণরূপে ব্যবহৃত হয়, তা-ই সাধু ভাষা। যেমন: উহারা ঘুমাইয়া রহিয়াছে। তাহারা খেলিতেছে।সাধু ভাষা কাকে বলে এ সম্পর্কে ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছেন -
"সাধারণ গদ্য সাহিত্যে ব্যবহৃত বাঙ্গালা ভাষাকে সাধু ভাষা বলে।"
চলিত ভাষা কি বা কাকে বলে :-
যে ভাষা রীতিতে বা ব্যবহারে ক্রিয়াপদ ও সর্বনাম পদ সংক্ষিপ্ত আকারে ব্যবহৃত হয়, তাকে চলিত ভাষা বলে।যেমন : ওরা ঘুমিয়ে রয়েছে। তারা খেলছে।
আরও পড়ুন :- কথ্য ভাষা কাকে বলে
চলিত ভাষা কাকে বলে এ সম্পর্কে ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছেন -
দক্ষিণ-পশ্চিমবঙ্গে ভাগীরথী নদীর তীরবর্তী স্থানের ভদ্র ও শিক্ষিত সমাজে ব্যবহৃত মৌখিক ভাষা, সমগ্র বাংলাদেশের শিক্ষিত সমাজ কর্তৃক শ্রেষ্ঠ মৌখিক ভাষা বলে গৃহীত হইয়াছে। এই মৌখিক ভাষাকে বিশেষভাবে চলিত ভাষা বলা হয়।
সাধু ও চলিত ভাষার উদাহরণ :-
সাধু ভাষার উদাহরণ :
নদীতে স্নান করিবার সময় রাজদত্ত অঙ্গুরীয় শকুন্তলার অঞ্চলকোণ হইতে সলিলে পতিত হইয়াছিল। পতিত হইবামাত্র এক অভিবৃহৎ রোহিত মৎস্যে গ্রাস করে। সেই মৎস্য, কতিপয় দিবস পর, এক ধীবরের জালে পতিত হইল। ধীবর, খণ্ড খণ্ড বিক্রয় করিবার মানসে ঐ মৎস্যকে বহু অংশে বিভক্ত করিতে করিতে তদীয় উদরমধ্যে অঙ্গুরীয় দেখিতে পাইল। ঐ অঙ্গুরীয় লইয়া, পরম উল্লসিত মনে, সে এক মণিকারের আপণে বিক্রয় করিতে গেল।…….. [ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর : শকুন্তলা]চলিত ভাষার উদাহরণ :-
সাহিত্যের সহজ অর্থ যা বুঝি সে হচ্ছে নৈকট্য, অর্থাৎ সম্মিলন। মানুষ মিলিত হয় নানা প্রয়োজনে, আবার মানুষ মিলিত হয় কেবল মেলারই জন্যে, অর্থাৎ সাহিত্যেরই উদ্দেশে। শাকসবজির খেতের সঙ্গে মানুষের যোগ ফসল ফলানোর যোগ। ফুলের বাগানের সঙ্গে যোগ সম্পূর্ণ পৃথক জাতের। সবজি খেতের শেষ উদ্দেশ্য খেতের বাইরে, সে হচ্ছে ভোজ্যসংগ্রহ। ফুলের বাগানের যে উদ্দেশ্য তাকে এক হিসাবে সাহিত্য বলা যেতে পারে। অর্থাৎ, মন তার সঙ্গে মিলতে চায় সেখানে গিয়ে বসি, সেখানে বেড়াই, সেখানকার সঙ্গে যোগে মন খুশি হয়।………. [রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যের তাৎপর্য]সাধু ভাষার বৈশিষ্ট্য :-
- সাধু ভাষায় ক্রিয়াপদের পূর্ণাঙ্গ রূপ। যেমন : করিয়াছি, গিয়াছি।
- সাধু ভাষায় সর্বনাম পদের পূর্ণাঙ্গ রূপ। যেমন: তাহারা, তাহার, তাহাদের।
- সাধু ভাষায় অনুসর্গের পূর্ণরূপ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যেমন: হইতে, দিয়া প্রভৃতি।
- সাধু ভাষায় তৎসম শব্দের (সংস্কৃত শব্দ) প্রয়োগ বেশি। যেমন: হস্ত, মস্তক, ঘৃত, ধৌত।
- সাধু ভাষার উচ্চারণ গুরুগম্ভীর।
- সাধু ভাষার কাঠামো সাধারণত অপরিবর্তনীয়। এটি সুনির্ধারিত ব্যাকরণের অনুসারী।
- সাধু ভাষা বক্তৃতা ও নাট্য সংলাপের অনুপযোগী।
চলিত ভাষার বৈশিষ্ট্য :-
- চলিত ভাষায় ক্রিয়াপদের রূপ সংক্ষিপ্ত। যেমন : করেছি, গিয়েছি।
- চলিত ভাষায় সর্বনাম পদের রূপ সংক্ষিপ্ত। যেমন তারা তাদের।
- চলিত ভাষায় ব্যবহৃত হয় অনুসর্গের সংক্ষিপ্ত রূপ। যেমন : হতে, দিয়ে।
- চলিত ভাষায় অর্ধ-তৎসম, তদ্ভব, দেশি ও বিদেশি প্রভৃতি শব্দের ব্যবহার বেশি। যেমন : ঘি, হাত, ধোয়া, মাথা ।
- চলিত ভাষার উচ্চারণ হালকা ও গতিশীল।
- চলিত ভাষা পরিবর্তনশীল।
- চলিত ভাষা চটুল, জীবন্ত ও লোকায়ত।
সাধু ভাষা ও চলিত ভাষার পার্থক্য:-
এখন আমরা সাধু ভাষা ও চলিত ভাষার মধ্যে যে পার্থক্য রয়েছে তার আলোচনা করবো -
সাধু ভাষা | চলিত ভাষা |
সাধু ভাষারীতি সর্বজনগ্রাহ্য লেখার ভাষা। | চলিত ভাষারীতি সর্বজনবোধ্য মুখের ও লেখার ভাষা। |
সাধু ভাষারীতি সমস্ত ব্যাকরণের নিয়ম-কানুন মেনে চলে। | চলিত ভাষা ব্যাকরণের সব নিয়ম মেনে চলে না। |
সাধু ভাষায় পদবিন্যাস রীতি সুনির্দিষ্ট। | চলিত ভাষায় পদবিন্যাস রীতি অনেক সময় পরিবর্তিত হয়। |
সাধু ভাষায় তৎসম বা সংস্কৃত শব্দের ব্যবহার বেশি। | চলিত ভাষায় তৎসম বা সংস্কৃত শব্দের ব্যবহার কম। |
সাধু ভাষা যে কোনো বক্তৃতা, ভাষণ ও নাটকের সংলাপের ক্ষেত্রে উপযোগী নয়। | চলিত ভাষা যে কোন বক্তৃতা, ভাষণ ও নাটকের সংলাপের ক্ষেত্রে উপযোগী। |
সাধু ভাষায় সব সর্বনাম, ক্রিয়া ও অব্যয় পদের ক্ষেত্রে পূর্ণরূপ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। | চলিত ভাষায় সর্বনাম, ক্রিয়া ও অব্যয়পদের সংক্ষিপ্তরূপ ব্যবহৃত হয়। |
সাধু ভাষা গুরুগম্ভীর, দুর্বোধ্য ও মন্থর। | চলিত ভাষা চটুল, সরল ও সাবলীল। |
সাধু ভাষারীতি অপরিবর্তনীয়, তাই কৃত্রিম। | চলিত ভাষারীতি পরিবর্তনশীল, তাই জীবন্ত। |
আরও পড়ুন :- ব্যঞ্জনধ্বনি কয়টি ও কি কি? উদাহরণ দাও
সাধু ভাষা থেকে চলিত ভাষায় রূপান্তর উদাহরণ :-
নীচে সাধু ভাষা থেকে চলিত ভাষায় রূপান্তর এর উদাহরণ দেওয়া হলো -
সাধু ভাষা | চলিত ভাষা |
পথে এক যুবকের সহিত তাহার সাক্ষাৎ হইল । | পথে এক যুবকের সঙ্গে তার দেখা হলো। |
গফুর চুপ করিয়া রহিল। | গফুর চুপ করে রইল। |
আমিনা ঘর হইতে দুয়ারে আসিয়া দাঁড়াইল। | আমিনা ঘর হতে দুয়ারে এসে দাঁড়াল। |
চলিত ভাষা থেকে সাধু ভাষা রূপান্তর উদাহরণ :-
নীচে চলিত ভাষা থেকে সাধু ভাষা রূপান্তরের কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া হলো-
চলিত ভাষা | সাধু ভাষা |
হাজার বছর ধরে মানুষ এদের দেখছে। | হাজার বছর ধরিয়া মানুষ ইহাদের দেখিতেছে। |
পাশেই কিছু দূরে একটা শালুক দেখতে পায় ওসমান । | পার্শ্বেই কিছু দূরে একটি শালুক দেখিতে পায় ওসমান। |
আমাদের এ ভীরুতা কি চিরদিনই থেকে যাবে? | আমাদের এই ভীরুতা কি চিরদিনই থাকিয়া যাইবে? |
এ কথা শুনে অনেকে চমকে উঠবেন। | এই কথা শুনিয়া অনেকে চমকিয়া উঠিবেন। |
সাধু ভাষার প্রয়োজনীয়তা :-
সাধু ভাষার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো বিবেচনা করা যেতে পারে:১. সাধু ভাষা ব্যবহার করার মাধ্যমে সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বজায় থাকে। বাংলা সাহিত্যে সাধু বা তৎসম ভাষা ব্যবহার হয় প্রচলিত হচ্ছে।
২. সাধু ভাষায় নৈতিকতা ও সংস্কৃতির প্রতি খ্যাতি রয়েছে। তাই এর ব্যবহার দিয়ে সমাজের নৈতিকতার উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব।
৩. সাধু বা চলিত ভাষার ব্যবহার করলে কথাগুলোকে আরও সুন্দরভাবে তুলে ধরা সম্ভব। তা পাঠক, শ্রোতা ও দর্শকদের আকৃষ্ট করে।
৪. প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে রয়েছে বেশ কিছু মনোরম কবিতা, গল্প, উপন্যাস যেগুলো সাধু ভাষায় রচিত। ভাষার সমৃদ্ধির জন্য এগুলো পড়া প্রয়োজন।
৫. সুসংস্কারিত ও সভ্য মানুষ হওয়ার জন্যও সাধু ভাষার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করা হয়।
এগুলো ছিল সাধু ভাষার গুরুত্ব এবং প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আমার ধারণা।
0 মন্তব্যসমূহ
Please do not enter any spam link in the comment box.