মঙ্গলকাব্যের বিষয়বস্তু :-
মঙ্গলকাব্য মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের একটি বিশিষ্ট ও বলিষ্ঠধারা। লৌকিক দেবদেবীদের পূজা ও মাহাত্ম্য প্রচারের লক্ষ্যে এ জাতীয় কাব্য আঙ্গিকের আবির্ভাব।
অনুবাদ কাব্যের মতো এর প্রধান নির্ভর আখ্যান, তবে সেই উপাখ্যানে কোন সংস্কৃত মূলকাহিনীর উৎস নেই। গ্রামবাংলার ব্রতকথার সঙ্গে, মঙ্গলকাব্য গুলির ঐহিক কামনা বাসনার রূপায়ণও লক্ষ্য করা যায়।
এছাড়াও মঙ্গলকাব্যের মধ্যে দেবদেবীর বন্দনা, গ্রন্থোৎপত্তির কারণ বর্ণনা, নায়ক-নায়িকার বারমাস্যা, নারীগণের পতিনিন্দা, রন্ধন দ্রব্যের বিস্তৃত বর্ণনাও লক্ষ্য করা যায়।
আরও পড়ুন :- মনসামঙ্গল কাব্যের কাহিনি কি?
অনুবাদ কাব্যের মতো এর প্রধান নির্ভর আখ্যান, তবে সেই উপাখ্যানে কোন সংস্কৃত মূলকাহিনীর উৎস নেই। গ্রামবাংলার ব্রতকথার সঙ্গে, মঙ্গলকাব্য গুলির ঐহিক কামনা বাসনার রূপায়ণও লক্ষ্য করা যায়।
এছাড়াও মঙ্গলকাব্যের মধ্যে দেবদেবীর বন্দনা, গ্রন্থোৎপত্তির কারণ বর্ণনা, নায়ক-নায়িকার বারমাস্যা, নারীগণের পতিনিন্দা, রন্ধন দ্রব্যের বিস্তৃত বর্ণনাও লক্ষ্য করা যায়।
আরও পড়ুন :- মনসামঙ্গল কাব্যের কাহিনি কি?
মঙ্গলকাব্যের উদ্ভব ও বিকাশ :-
বাংলা সাহিত্যে পঞ্চদশ থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত মঙ্গলকাব্যের বিস্তার। মঙ্গলকাব্যের উদ্ভব ও বিকাশের উৎস এদেশের সুপ্রাচীন ধর্মাদর্শের সঙ্গে বিজড়িত। এদেশে আর্য আগমনের পূর্বে এখানকার আদিম জনগণ নিজস্ব ধর্মাদর্শ ও দেবদেবীগণের পরিকল্পনার অনুসারী ছিল।
পরবর্তী কালে জৈন-বৌদ্ধ-ব্রাহ্মণ্য ধর্মের মাধ্যমে আর্যদের সঙ্গে অনার্যদের সংস্পর্শ ঘটার ফলে তাদের আদিম দেবপরিকল্পনা ও ধর্মসংস্কার পরিবর্তিত হয়েছে।
তবে তারা তাদের নিজস্ব আদর্শানুসারে নিজ নিজ লৌকিক দেবতাদের পূজাপদ্ধতি ও মহিমাজ্ঞাপক কাহিনি নিয়ে পাঁচালি রচনা করেছে। এগুলোই পরবর্তী কালে মঙ্গলকাব্যের আকার পেয়েছে।
আরও পড়ুন :- চণ্ডী-মঙ্গল কাব্যের কাহিনি ও ধারা?
আর্য-ব্রাহ্মণ্য-ধর্ম-সংস্কার সাধারণ মানুষের জীবনের সঙ্গে কোন সংযোগ রাখে নি; অন্যদিকে জৈন-বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব সাধারণ মানবসমাজে ছড়িয়ে ছিল। সমাজ ও ধর্মজীবনের এ অবস্থাতেই এ দেশে তুর্কি আক্রমণ ঘটে ।
এই যুগান্তকারী তুর্কি আক্রমণের পরিণামে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও সমাজ সংকটের সম্মুখীন হয় এবং তা থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য সাধারণ মানবজীবনের সংস্কার, ধর্মবিশ্বাস ও দেবদেবীকে গ্রহণ করেছিল।
এভাবে আর্য-অনার্যের মিলন ঘটে এবং লৌকিক দেবদেবীরাই মঙ্গলকাব্যের উপজীব্য হয়ে উঠলে এই নতুন কাব্যধারার প্রবর্তন সহজতর হয়। প্রকৃতপক্ষে এ দেশে তুর্কি আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে হিন্দু সমাজের সঙ্গে মুসলমান সমাজের সংঘর্ষের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ মঙ্গলকাব্য গুলোর উদ্ভব সম্ভব হয়েছিল।
পরবর্তী কালে জৈন-বৌদ্ধ-ব্রাহ্মণ্য ধর্মের মাধ্যমে আর্যদের সঙ্গে অনার্যদের সংস্পর্শ ঘটার ফলে তাদের আদিম দেবপরিকল্পনা ও ধর্মসংস্কার পরিবর্তিত হয়েছে।
তবে তারা তাদের নিজস্ব আদর্শানুসারে নিজ নিজ লৌকিক দেবতাদের পূজাপদ্ধতি ও মহিমাজ্ঞাপক কাহিনি নিয়ে পাঁচালি রচনা করেছে। এগুলোই পরবর্তী কালে মঙ্গলকাব্যের আকার পেয়েছে।
আরও পড়ুন :- চণ্ডী-মঙ্গল কাব্যের কাহিনি ও ধারা?
আর্য-ব্রাহ্মণ্য-ধর্ম-সংস্কার সাধারণ মানুষের জীবনের সঙ্গে কোন সংযোগ রাখে নি; অন্যদিকে জৈন-বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব সাধারণ মানবসমাজে ছড়িয়ে ছিল। সমাজ ও ধর্মজীবনের এ অবস্থাতেই এ দেশে তুর্কি আক্রমণ ঘটে ।
এই যুগান্তকারী তুর্কি আক্রমণের পরিণামে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও সমাজ সংকটের সম্মুখীন হয় এবং তা থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য সাধারণ মানবজীবনের সংস্কার, ধর্মবিশ্বাস ও দেবদেবীকে গ্রহণ করেছিল।
এভাবে আর্য-অনার্যের মিলন ঘটে এবং লৌকিক দেবদেবীরাই মঙ্গলকাব্যের উপজীব্য হয়ে উঠলে এই নতুন কাব্যধারার প্রবর্তন সহজতর হয়। প্রকৃতপক্ষে এ দেশে তুর্কি আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে হিন্দু সমাজের সঙ্গে মুসলমান সমাজের সংঘর্ষের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ মঙ্গলকাব্য গুলোর উদ্ভব সম্ভব হয়েছিল।
মঙ্গলকাব্য কাকে বলে বা কি :-
'মঙ্গল' শব্দটির আভিধানিক অর্থ 'কল্যাণ'।
যে কাব্যে দেবতার আরাধনা, মাহাত্ম্য কীর্তন করা হয়, যে কাব্য শ্রবণেও মঙ্গল হয় এবং বিপরীতটিতে হয় অমঙ্গল; যে কাব্যের আধার মঙ্গল, এমন কি যে কাব্য যার ঘরে রাখলেও মঙ্গল হয়—তাকেই বলা হয় মঙ্গলকাব্য।
যে ধর্মমূলক কাব্যে লৌকিক ও পৌরাণিক দেবদেবীদের অলৌকিক মাহাত্ম্যের প্রতিষ্ঠা ঘটে ও লোক সমাজে তাঁদের পূজা প্রচারিত হয়, যার পাঠে কিংবা শ্রবণে ব্যক্তি সমষ্টির ঐহিক ও পারত্রিক মঙ্গল ঘটে, তাকে মঙ্গলকাব্য বলা হয়।
'বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস'- এর লেখক ডঃ আশুতোষ ভট্টাচার্য মঙ্গলকাব্য সম্পর্কে বলেছেন,
যে কাব্যে দেবতার আরাধনা, মাহাত্ম্য কীর্তন করা হয়, যে কাব্য শ্রবণেও মঙ্গল হয় এবং বিপরীতটিতে হয় অমঙ্গল; যে কাব্যের আধার মঙ্গল, এমন কি যে কাব্য যার ঘরে রাখলেও মঙ্গল হয়—তাকেই বলা হয় মঙ্গলকাব্য।
যে ধর্মমূলক কাব্যে লৌকিক ও পৌরাণিক দেবদেবীদের অলৌকিক মাহাত্ম্যের প্রতিষ্ঠা ঘটে ও লোক সমাজে তাঁদের পূজা প্রচারিত হয়, যার পাঠে কিংবা শ্রবণে ব্যক্তি সমষ্টির ঐহিক ও পারত্রিক মঙ্গল ঘটে, তাকে মঙ্গলকাব্য বলা হয়।
'বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস'- এর লেখক ডঃ আশুতোষ ভট্টাচার্য মঙ্গলকাব্য সম্পর্কে বলেছেন,
“আনুমানিক খ্ৰীষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দী হইতে আরম্ভ করিয়া অষ্টাদশ শতাব্দীর কবি ভারতচন্দ্রের কাল পর্যন্ত বঙ্গসাহিত্যে যে বিশেষ এক শ্রেণীর ধর্মবিষয়ক আখ্যানকাব্য প্রচলিত ছিল, তাহাই বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে মঙ্গলকাব্য নামে পরিচিত”।
মঙ্গলকাব্য কত প্রকার ও কি কি :-
মঙ্গলকাব্যকে তিন টি শ্রেনীতে ভাগ করা যায়। যেমন,
বৈষ্ণব মঙ্গলকাব্য
পৌরাণিক মঙ্গলকাব্য ও
লৌকিক মঙ্গলকাব্য
বৈষ্ণব মঙ্গলকাব্য
পৌরাণিক মঙ্গলকাব্য ও
লৌকিক মঙ্গলকাব্য
এদের আবার কতগুলো ভাগ রয়েছে । যেমন -
বৈষ্ণব মঙ্গলকাব্য :-
চৈতন্য মঙ্গল
অদ্বৈত মঙ্গল
গোবিন্দ মঙ্গল
কৃষ্ণ মঙ্গল
রাধিকা মঙ্গল
জগৎ মঙ্গল
কিশোরী মঙ্গল
স্মরণ মঙ্গল
গোকুল মঙ্গল
রসিক মঙ্গল
জগন্নাথ মঙ্গল ইত্যাদি
অদ্বৈত মঙ্গল
গোবিন্দ মঙ্গল
কৃষ্ণ মঙ্গল
রাধিকা মঙ্গল
জগৎ মঙ্গল
কিশোরী মঙ্গল
স্মরণ মঙ্গল
গোকুল মঙ্গল
রসিক মঙ্গল
জগন্নাথ মঙ্গল ইত্যাদি
পৌরাণিক মঙ্গলকাব্য :-
গৌরী মঙ্গল
ভবানী মঙ্গল
দুর্গ মঙ্গল
অন্নদামঙ্গল
কমলা মঙ্গল
গঙ্গা মঙ্গল
চণ্ডিকা মঙ্গল ইত্যাদি
ভবানী মঙ্গল
দুর্গ মঙ্গল
অন্নদামঙ্গল
কমলা মঙ্গল
গঙ্গা মঙ্গল
চণ্ডিকা মঙ্গল ইত্যাদি
লৌকিক মঙ্গলকাব্য :-
শিবারন বা শিব-মঙ্গল
মনসা-মঙ্গল
চণ্ডী-মঙ্গল
ধর্ম-মঙ্গল
কালিকা-মঙ্গল
শীতলা-মম্বল
রায় মঙ্গল
ষষ্ঠী মঙ্গল
সূর্য মঙ্গল
সারদা মঙ্গল ইত্যাদি
মনসা-মঙ্গল
চণ্ডী-মঙ্গল
ধর্ম-মঙ্গল
কালিকা-মঙ্গল
শীতলা-মম্বল
রায় মঙ্গল
ষষ্ঠী মঙ্গল
সূর্য মঙ্গল
সারদা মঙ্গল ইত্যাদি
বাংলা ভাষায় কেবল মনসামঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গলকে নিয়েই মঙ্গলকাব্য লেখা হয়নি। গৌণস্তরেও অনেকগুলি মঙ্গলকাব্য বিভিন্ন সময়ের কবিরা রচনা করেছিলেন।
আরও পড়ুন :- ধর্মমঙ্গল কাব্য কি?
যেমন- কালিকামঙ্গ ল, অন্নদামঙ্গল, রায়মঙ্গল, গৌরীমঙ্গল, শীতলামঙ্গল, গঙ্গামঙ্গল, ষষ্ঠীমঙ্গল ইত্যাদি। বৈষ্ণব সমাজের কৃষ্ণ ও চৈতন্যকে ঘিরে শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল, রাধিকামঙ্গল, গোবিন্দমঙ্গল, চৈতন্যমঙ্গল লেখা হয়েছিল।
মঙ্গল কাব্যের ছন্দ:
লৌকিক ছন্দ বা ছড়ার ছন্দের পাশাপাশি মঙ্গলকাব্যে ব্যাপকভাবে অক্ষরবৃত্ত পয়ার ছন্দই প্রধানত ব্যবহৃত হয়েছে। যে পয়ার ছন্দ মঙ্গলকাব্যে ব্যবহৃত হয়েছে তাকে লঘু বা দ্বিপদী পয়ার বলে উল্লেখ করা যায়। প্রতিটি পদ আট এবং ছয় মাত্রায় বিভক্ত। পয়ার বা পাঁচালী ছন্দের পর মঙ্গলকাব্যে আর যে সকল ছন্দ ব্যবহৃত হয়েছে তাদের মধ্যে ত্রিপদী ছন্দ অন্যতম। অনেক সময় ত্রিপদী ছন্দকে মঙ্গলকাব্যের কবিগন লাচাড়ী বলে উল্লেখ করেছেন। মঙ্গলকাব্যের প্রধান ছন্দ।মঙ্গলকাব্যের বৈশিষ্ট্য :-
প্রথমেই মঙ্গলকাব্যে গনেশ প্রভৃতি পঞ্চদেবতার বন্দনা করার পর গ্রন্থ উৎপত্তির কারণ বর্ণনা করে এবং সৃষ্টি রহস্য, কথন প্রভৃতি সূচনা অংশে এই কাঠামোটি প্রত্যেক মঙ্গলকাব্যে দেখা যায়।
- মঙ্গলকাব্যের একটি প্রধান উদ্দেশ্য দেবদেবীদের মাহাত্ম্য প্রচার করা।
- মঙ্গলকাব্যে কবির ভূমিকা অংশে পূর্বপুরুষের পরিচয়, বসবাসের বর্ণনা, স্বপ্ন-আদেশ প্রভৃতির অল্প-বিস্তর বর্ণনার উল্লেখ থাকে।
- মঙ্গলকাব্যের অন্যতম উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য কবিদের ভনিতা ব্যবহার। এখানে কবির নাম, তার পদবী, আশ্রয়দাতা, পৃষ্ঠপোষক প্রভৃতি নাম উল্লেখ করা থাকে।
- মঙ্গলকাব্যে উল্লেখিত কাহিনি গুলো অনেক পালায় বিভক্ত থাকে।
- মঙ্গল কাবা দেবখন্ড ও নর খন্ডে বিভক্ত।
- সব মঙ্গল কাব্যের নায়ক-নায়িকা স্বর্গ থেকে আগত দেব-দেবী। মর্ত্যে আগমনের উদ্দেশ্য দেব মাহাত্ম্যের প্রচারের জন্য।
- মঙ্গল কাব্যে অনেক আলোচনায় সমুদ্র পথের উল্লেখ থাকে।
- মঙ্গল কাব্যের অন্যতম একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য নারীদের পতিনিন্দার বর্ণনা।
- মঙ্গলকাব্যের অন্যতম একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো দেবীর চৌতিশা স্তব বর্ণনা করা।
- মঙ্গলকাব্য তথা মধ্যযুগের কাব্যের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হল নায়িকার বারোমাস্যার বর্ণনা থাকে ।
- মঙ্গলকাব্য গুলোর মধ্যে মনসামঙ্গল ছাড়া, প্রায় সব মঙ্গলকাব্যেই যুদ্ধের বিস্তারিত বর্ণনার উল্লেখ আছে।
- প্রহেলিকা বা ধাঁধাঁ, প্রবাদ-প্রবচন, লোকবিশ্বাস, লোকশ্রুতি প্রভৃতি মঙ্গল কাব্যের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য।
- মঙ্গলকাব্যের অপর একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো দেব-দেবতাদের বিদ্রোহীকে তাদের পদতলে নতশীর্ষ করানো।
0 মন্তব্যসমূহ
Please do not enter any spam link in the comment box.