বাংলার মঙ্গলকাব্যের অন্যতম প্রধান ধারা হল চন্ডীমঙ্গল কাব্যের ধারা। পুরুষ-প্রধান আর্যসংস্কৃতিতে যেমন পুরুষ দেবতাদের প্রাধান্য ছিল, তেমনি প্রাগ আর্য সংস্কৃতিতে গুরুত্ব পেয়েছিল নারী দেবতা কেন্দ্রিক চিন্তা। প্রাচীন ভারতবর্ষে মাতৃকা মূর্তির পূজা প্রচলিত ছিল। দেবী চণ্ডী পৌরাণিক কালেরই এক নারী দেবতা।
দেবী চণ্ডীর উদ্ভব সম্পর্কে তিনটি উৎসের কথা বলেন বাঙালি পণ্ডিত সমাজ। এগুলি হল
১ - ক্ষীয়মান মহাযানী বৌদ্ধ ধর্ম,
২ - অনার্য আদিবাসীদের ধর্মজগৎ ও
৩ - হিন্দু পুরাণের সুপ্রাচীন ঐতিহ্য।
ব্রজযানী বৌদ্ধরা ‘ব্রজতারা' নামে এক দেবীর কল্পনা করেন। অনেকের মতে ছোটনাগপুর অঞ্চলের ওঁরাও সমাজের দেবী 'চাণ্ডী' বাংলায় এসে চণ্ডী নাম ধারণ করেছেন। চণ্ডীপূজার মুখ্য উপাচার ধেনোমদ ও ছাগল। এই উৎসসূত্রে মনে হয় চণ্ডী হলেন অরণ্য পশুদের দেবতা। চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের কাহিনীতে দেবীর মৃগীরূপ, গোধিকারূপ, ষোড়শী কন্যার রূপ ধারণ লক্ষ্য করা যায়।
চণ্ডী মূলে নারী সমাজেরই দেবতা। চণ্ডী কখনও উমা – শিবপত্নীর কল্যাণীমূর্তিতে প্রতিষ্ঠিতা ; আবার কখনো এঁকে লক্ষ্মী বলে ভ্রম জন্মায় কেননা তিনি ধন ও ঐশ্বর্যদাত্রী। আবার ইনিই দুর্গা, ইনিই মহিষমর্দিনী দশভূজা, ইনিই মহাকালী কখনো বা সরস্বতী।
চণ্ডীর দেবীত্বের সার্বিক প্রতিষ্ঠা ঘটেছে মার্কণ্ডেয় পুরাণে। চণ্ডীমঙ্গলের দুটি আখ্যান। একটিতে রয়েছে ব্যাধসন্তান কালকেতুর প্রতি দেবীর অহৈতুকী কৃপা, অন্যটিতে রয়েছে ধনপতি সদাগরের সঙ্গে চণ্ডীর বিরোধ ও সবশেষে বিবাদ-নিষ্পত্তি।
প্রথম খণ্ডে আক্ষেটিক বা ব্যাধ কালকেতুর কাহিনি এবং দ্বিতীয় খণ্ডে বণিক ধনপতির কাহিনি বর্ণিত হয়েছে।
এ ধরনের দুটি কাহিনি কেবল চণ্ডীমঙ্গলেই পাওয়া যায়, অন্যান্য মঙ্গলকাব্যে একটি মাত্র কাহিনি রয়েছে। তবে অপরাপর মঙ্গল কাব্যের মতই চণ্ডীমঙ্গলেও দেবখণ্ড আছে। চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের কাহিনিতে ব্যাধের ওপর চণ্ডীর প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে সমাজের নিচু পর্যায়ের মানুষের মধ্যে পূজা প্রচারের কথা বলা হয়েছে; আবার বণিকের ওপর প্রভাব বিস্তার করে অভিজাত শ্রেণির মানুষের মধ্যে চণ্ডীর পূজা প্রচারের কথাও বর্ণিত হয়েছে।
পরদিন দেবী ছলনা করে বনের সকল পশু লুকিয়ে রাখলেন। কালকেতু কোন শিকার না পেয়ে এক স্বর্ণগোধিকা ধরে নিয়ে ঘরে ফিরল। চণ্ডীদেবীই স্বর্ণগোধিকার ছদ্মবেশ ধারণ করেছিলেন।
কালকেতুর গৃহে দেবী নিজের মূর্তি ধারণ করলেন এবং নিজের প্রকৃত পরিচয় দিয়ে কালকেতুকে সাত ঘড়া ধন ও একটি মহামূল্যবান আংটি দান করলেন।
দেবীর নির্দেশে কালকেতু গুজরাটে বন কেটে এক নগর স্থাপন করল। নগর ধনেজনে পরিপূর্ণ হয়ে উঠলে ভাঁড়ু দত্ত নামে এক ধূর্তলোক কালকেতুর আশ্রয়ে প্রজাদের ওপর নানা প্রকার অত্যাচার করতে থাকে। কালকেতু তা জানতে দত্তকে তাড়িয়ে দিল।
ভাঁড়ু দত্ত প্রতিবেশী কলিঙ্গরাজের কাছে অভিযোগ করে রাজ্য আক্রমণ করার জন্য তাঁকে প্ররোচিত করে। ফলে কালকেতু ও কলিঙ্গরাজের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ভাঁড়ু দত্তের চক্রান্তে কালকেতু পরাজিত ও বন্দী হলে চণ্ডীদেবীর দয়ায় সে মুক্তি পায়।
আরও পডুন :- মঙ্গলকাব্যের উদ্ভব ও বিকাশ
তারপর দীর্ঘকাল রাজত্ব করে পুত্র পুষ্পকেতুর হাঁতে রাজ্যভার সমর্পণ করে কালকেতু স্ত্রী ফুল্লরাসহ স্বর্গারোহণ করে।
কালকেতু পূর্বে ছিল স্বর্গের ইন্দ্রপুত্র নীলাম্বর এবং ফুল্লরা ছিল নীলাম্বরপত্নী ছায়া। অভিশপ্ত হয়ে তাঁরা মর্ত্যে ব্যাধের ঘরে জন্ম নিয়েছিল। চণ্ডী দেবী মর্ত্যলোকে নিজের পূজা প্রচার করতে মনস্থ করেছিলেন এবং ইন্দ্রের পুত্র নীলাম্বরকে তিনি এ কাজের ভার দিতে চেয়েছিলেন। শিবকে এ কথা জানালে শিব অস্বীকৃতি জানান, কিন্তু চণ্ডীর ষড়যন্ত্রে অভিশপ্ত হয়ে নীলাম্বরকে পৃথিবীতে আসতে হয়েছিল।
বিয়ের পর খুল্লনাকে লহনার কাছে রেখে ধনপতি রাজ আজ্ঞায় সুবর্ণপিঞ্জর আনার জন্য গৌড়ে গেল। সতীনের প্রতি ঈর্ষাকাতর হয়ে লহনা খুল্লনাকে নানা প্রকার অত্যাচার করতে লাগল। বাধ্য হয়ে খুল্লনা বনে গেল ছাগল চরাতে।
সেখানে খুল্লনা চণ্ডীদেবীর পূজাপদ্ধতি শিখে নিয়ে চণ্ডীর পূজা সম্পন্ন করে। এতে চণ্ডীদেবী তার প্রতি প্রসন্ন হন। চণ্ডীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে ধনপতি সদাগর ফিরে আসে। খুল্লনার চণ্ডীর পূজা দেখে ধনপতি রেগে পূজার ঘট পায়ে ঠেলে ফেলে দিল।
খুল্লনা বনে ছাগল চরাত বলে স্বজাতিবর্গ তার সতীত্ব সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করল। খুল্পনা সতীত্বের পরীক্ষা দিল।
তাকে জলে ডুবানোর চেষ্টা করা হল, সাপ দিয়ে কামড়ানো হল, প্রজ্বলিত লৌহদণ্ডে বিদ্ধ করা হল, শেষে তাকে জতুগৃহে রেখে আগুন দেওয়া হল—কিন্তু খুল্লনার কিছুই হল না।
সে সতী হিসেবে বিবেচিত হল। কিছুদিন পর বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে ধনপতি সিংহল যাত্রা করে। পথে কালিদহে কমলে কামিনী মূর্তি দেখতে পায়।
সেখানে এক অপরূপ সুন্দরী তরুণী পদ্মের ওপর বসে এক বিরাট হস্তী গলধঃকরণ ও উদ্গীরণ করছে। এই অপূর্ব ও আশ্চর্য দৃশ্যের কথা সিংহলরাজকে জানালে তিনি তা দেখতে চাইলেন। কিন্তু চণ্ডীদেবীর মায়ায় ধনপতি তা দেখাতে পারল না।
সিংহলে আগমনের পূর্বে ধনপতি খুল্লনা পূজিত চণ্ডীর ঘট ভেঙে দিয়েছিল বলে চণ্ডীদেবী তার ওপর ক্রোধান্বিত ছিলেন। তখন সিংহলরাজ শাস্তিস্বরূপ ধনপতিকে কারারুদ্ধ করেন।
ইতোমধ্যে খু্ল্লনার এক পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করেছে। তার নাম শ্রীমন্ত। বড় হয়ে সে পিতার সন্ধানে সিংহল যাত্রা করল। পথে শ্রীমন্তও কালিদহে কমলে কামিনী মূর্তি দেখতে পায়। কিন্তু পিতার মত শ্রীমন্তও সিংহলরাজকে তা দেখাতে পারল না। রাজা অসন্তুষ্ট হয়ে তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন।
শ্রীমন্তের স্তবে চণ্ডীদেবী সন্তুষ্ট হয়ে তাকে রক্ষা করলেন। পিতাপুত্রে মিলন ঘটল। সিংহল রাজকন্যার সঙ্গে শ্রীমন্তের বিয়ে হল তারপর পুত্র ও পুত্রবধূ সঙ্গে নিয়ে ধনপতি সদাগর দেশে ফিরে আসে।
উজানি নগরে এসে শ্রীমন্ত উজানি নগরের রাজাকে কমলে কামিনীর মূর্তি দেখিয়ে মুগ্ধ করল এবং তাঁর কন্যা জয়াবতীকে বিয়ে করল। তারপর স্বর্গভ্রষ্ট ব্যক্তিগণ স্বর্গে ফিরে গেলেন।
মানিক দত্তের চণ্ডীমঙ্গলে ব্যাধ ও বণিকের দুটি আখ্যানই আছে। কবির বর্ণনা মতে, নিরঞ্জন থেকে সৃষ্ট আদ্যাই হলেন চণ্ডী। কাহিনী ও চরিত্র রচনায় মানিক দত্তের কাব্যে সুষম ঐক্যের অভাব আছে যথেষ্ট।
আরও পডুন :- মনসামঙ্গল কাব্যের বৈশিষ্ট্য
দ্বিজ মাধবের কাব্যের নাম ‘সারদাচরিত'। তবে ভণিতায় 'সারদামঙ্গল' বলেও অভিহিত করেছেন। কবিকঙ্কন পূর্ববর্তী সময়ে দ্বিজ মাধবই চণ্ডীমঙ্গলের শ্রেষ্ঠ কবি। দ্বিজ মাধব চৈতন্যোত্তর যুগের কবি ছিলেন। তার প্রমাণ যত্রতত্র বিষ্ণুপদের প্রয়োগ। চরিত্র চিত্রণেও তিনি বাস্তবতাবোধের পরিচয় দিয়েছেন।
মুকুন্দের কাব্য 'চণ্ডীমঙ্গল' নামে পরিচিত হলেও তিনি ভণিতায় বারে বারে 'অভয়ামঙ্গল' নামটি উল্লেখ করেছেন।
সম্ভবতঃ ষোড়শ শতকের শেষ বা সপ্তদশ শতকের প্রথম দশকের মধ্যে 'অভয়ামঙ্গল' সমাপ্তি লাভ করে।
কবির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন বাঁকুড়া রায়। তাঁর পুত্র রঘুনাথের রাজত্বকালে কবি চণ্ডীমঙ্গল লেখেন। ‘চণ্ডীমঙ্গল’ দেবতার কাহিনী, কিন্তু কবি মুকুন্দ এ কাব্যে বেশি করে ফুটিয়ে তুলেছেন মানুষকে।
মুকুন্দ ছিলেন বাস্তবরসের অনবদ্য কারিগর। শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন —“এ যুগে জন্মগ্রহণ করিলে তিনি যে কবি না হইয়া একজন ঔপন্যাসিক হইবেন, তাহাতে সংশয়মাত্র নাই।”
উপন্যাসের অন্যতম উপকরণ হল বাস্তবতা। তবে নায়ক বা নায়িকা চরিত্র নয়, টাইপ চরিত্র রচনায় কবিকঙ্কণের সর্বাধিক সিদ্ধি। তাঁর রচিত কালকেতু, ফুল্লরা, মুরারি শীল, ভাঁড়ুদত্ত কিংবা দুর্বলা দাসী অনন্য।
গুজরাট নগরে বসতি স্থাপনে নানা বর্গের বৃত্তিধারী মানুষের ক্রিয়াকলাপের বর্ণনায় তিনি ঔপন্যাসিকের মতো নিখুঁত বর্ণনার পরিচয় দিয়েছেন।
রামদেবের কাব্য তিনভাগে বিভক্ত। প্রথমভাগে রয়েছে সৃষ্টিপত্তনের বর্ণনা। দ্বিতীয়ভাগে গঠিত হয়েছে কালকেতু ব্যাধের কাহিনী দিয়ে। তৃতীয়খণ্ডে মেলে বণিক ধনপতির আখ্যান।
'গ্রহ ঋতু কাল শশী' বা ১৬১৯ শক অর্থাৎ ১৭৪৭ খ্রীঃ তিনি কাব্য লেখেন। কবি তাঁর কাব্যের নাম দিয়েছিলেন ‘সারদামঙ্গল'। এটি একই সঙ্গে 'অষ্টমঙ্গলার চতুষ্প্রহরী পাঁচালী' নামেও পরিচিত।
'মঙ্গলচণ্ডীর পাঞ্চালিকা' নামে কবির পুথিটি স্থানীয় সমাজে ‘জাগরণ' নামে পরিচিত হলেও কবি ভণিতায় বারবার ‘পাঞ্চলিকা' শব্দটির উল্লেখ করেছেন।
ভবানীশঙ্করের এই রচনা দু'একটি কারণে বিশিষ্টি। কালকেতু ও ধনপতির আখ্যান বর্ণনার আগে তিনি দেবী ভাগবতের কাহিনী উপস্থাপন করেছেন। এতে আদ্যাশক্তির সতীরূপে জন্ম, শিবের সঙ্গে সতীর বিবাহ, দক্ষ কর্তৃক শিব নিন্দা, স্বামী নিন্দা শ্রবণে সতীর দেহত্যাগ, পরে পার্বতী রূপে জন্ম, হরপার্বতীর বিবাহ, পার্বতীর পুত্রকন্যাদির জন্ম এবং অসুরযুদ্ধে দিগ্ৰসনা কালিকার আবির্ভাব ইত্যাদি চিরাচরিত কাহিনী বর্ণিত হয়েছে।
কবিরা রাঢ়ের কৌলিন্য ত্যাগ করে বারেন্দ্র সমাজভুক্তও হয়েছিলেন। কবি আখ্যানকাব্য লিখলেও গীতিকবিতার সুর প্রতিধ্বনিত করেছেন অনেকগুলি শাক্তপদ রচনা করে।
কাব্যের নাম 'বাসুলীমঙ্গল'। এ কাব্যে কালকেতুর আখ্যান নেই, রয়েছে কেবল বণিকের উপাখ্যানটি। কিন্তু এ বনিক ধনপতি সদাগর নয়, ধুসদত্ত।
দেবী চণ্ডীর উদ্ভব সম্পর্কে তিনটি উৎসের কথা বলেন বাঙালি পণ্ডিত সমাজ। এগুলি হল
১ - ক্ষীয়মান মহাযানী বৌদ্ধ ধর্ম,
২ - অনার্য আদিবাসীদের ধর্মজগৎ ও
৩ - হিন্দু পুরাণের সুপ্রাচীন ঐতিহ্য।
ব্রজযানী বৌদ্ধরা ‘ব্রজতারা' নামে এক দেবীর কল্পনা করেন। অনেকের মতে ছোটনাগপুর অঞ্চলের ওঁরাও সমাজের দেবী 'চাণ্ডী' বাংলায় এসে চণ্ডী নাম ধারণ করেছেন। চণ্ডীপূজার মুখ্য উপাচার ধেনোমদ ও ছাগল। এই উৎসসূত্রে মনে হয় চণ্ডী হলেন অরণ্য পশুদের দেবতা। চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের কাহিনীতে দেবীর মৃগীরূপ, গোধিকারূপ, ষোড়শী কন্যার রূপ ধারণ লক্ষ্য করা যায়।
চণ্ডী মূলে নারী সমাজেরই দেবতা। চণ্ডী কখনও উমা – শিবপত্নীর কল্যাণীমূর্তিতে প্রতিষ্ঠিতা ; আবার কখনো এঁকে লক্ষ্মী বলে ভ্রম জন্মায় কেননা তিনি ধন ও ঐশ্বর্যদাত্রী। আবার ইনিই দুর্গা, ইনিই মহিষমর্দিনী দশভূজা, ইনিই মহাকালী কখনো বা সরস্বতী।
চণ্ডীর দেবীত্বের সার্বিক প্রতিষ্ঠা ঘটেছে মার্কণ্ডেয় পুরাণে। চণ্ডীমঙ্গলের দুটি আখ্যান। একটিতে রয়েছে ব্যাধসন্তান কালকেতুর প্রতি দেবীর অহৈতুকী কৃপা, অন্যটিতে রয়েছে ধনপতি সদাগরের সঙ্গে চণ্ডীর বিরোধ ও সবশেষে বিবাদ-নিষ্পত্তি।
আরও পড়ুন :- ধর্মমঙ্গল কাব্য কি?
চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের কাহিনী :-
চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের কাহিনী দুই খণ্ডে বিভক্ত। প্রথম আক্ষেটিক খণ্ড এবং দ্বিতীয় বণিক খণ্ড।প্রথম খণ্ডে আক্ষেটিক বা ব্যাধ কালকেতুর কাহিনি এবং দ্বিতীয় খণ্ডে বণিক ধনপতির কাহিনি বর্ণিত হয়েছে।
এ ধরনের দুটি কাহিনি কেবল চণ্ডীমঙ্গলেই পাওয়া যায়, অন্যান্য মঙ্গলকাব্যে একটি মাত্র কাহিনি রয়েছে। তবে অপরাপর মঙ্গল কাব্যের মতই চণ্ডীমঙ্গলেও দেবখণ্ড আছে। চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের কাহিনিতে ব্যাধের ওপর চণ্ডীর প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে সমাজের নিচু পর্যায়ের মানুষের মধ্যে পূজা প্রচারের কথা বলা হয়েছে; আবার বণিকের ওপর প্রভাব বিস্তার করে অভিজাত শ্রেণির মানুষের মধ্যে চণ্ডীর পূজা প্রচারের কথাও বর্ণিত হয়েছে।
আক্ষেটিক বা ব্যাধ কালকেতুর কাহিনী :-
কলিঙ্গরাজ্যের সীমান্তের এক অরণ্যে বনদেবী চণ্ডীর অনুগ্রহে বনের পশুরা পরম সুখে দিন উপভোগ করছিল । এক সময়ে কালকেতু নামক এক ব্যাধের পশু শিকার জনিত অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে বনের পশুরা চণ্ডীদেবীর শরণাপন্ন হলে চণ্ডী তাদের অভয় দিলেন।পরদিন দেবী ছলনা করে বনের সকল পশু লুকিয়ে রাখলেন। কালকেতু কোন শিকার না পেয়ে এক স্বর্ণগোধিকা ধরে নিয়ে ঘরে ফিরল। চণ্ডীদেবীই স্বর্ণগোধিকার ছদ্মবেশ ধারণ করেছিলেন।
কালকেতুর গৃহে দেবী নিজের মূর্তি ধারণ করলেন এবং নিজের প্রকৃত পরিচয় দিয়ে কালকেতুকে সাত ঘড়া ধন ও একটি মহামূল্যবান আংটি দান করলেন।
দেবীর নির্দেশে কালকেতু গুজরাটে বন কেটে এক নগর স্থাপন করল। নগর ধনেজনে পরিপূর্ণ হয়ে উঠলে ভাঁড়ু দত্ত নামে এক ধূর্তলোক কালকেতুর আশ্রয়ে প্রজাদের ওপর নানা প্রকার অত্যাচার করতে থাকে। কালকেতু তা জানতে দত্তকে তাড়িয়ে দিল।
ভাঁড়ু দত্ত প্রতিবেশী কলিঙ্গরাজের কাছে অভিযোগ করে রাজ্য আক্রমণ করার জন্য তাঁকে প্ররোচিত করে। ফলে কালকেতু ও কলিঙ্গরাজের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ভাঁড়ু দত্তের চক্রান্তে কালকেতু পরাজিত ও বন্দী হলে চণ্ডীদেবীর দয়ায় সে মুক্তি পায়।
আরও পডুন :- মঙ্গলকাব্যের উদ্ভব ও বিকাশ
তারপর দীর্ঘকাল রাজত্ব করে পুত্র পুষ্পকেতুর হাঁতে রাজ্যভার সমর্পণ করে কালকেতু স্ত্রী ফুল্লরাসহ স্বর্গারোহণ করে।
কালকেতু পূর্বে ছিল স্বর্গের ইন্দ্রপুত্র নীলাম্বর এবং ফুল্লরা ছিল নীলাম্বরপত্নী ছায়া। অভিশপ্ত হয়ে তাঁরা মর্ত্যে ব্যাধের ঘরে জন্ম নিয়েছিল। চণ্ডী দেবী মর্ত্যলোকে নিজের পূজা প্রচার করতে মনস্থ করেছিলেন এবং ইন্দ্রের পুত্র নীলাম্বরকে তিনি এ কাজের ভার দিতে চেয়েছিলেন। শিবকে এ কথা জানালে শিব অস্বীকৃতি জানান, কিন্তু চণ্ডীর ষড়যন্ত্রে অভিশপ্ত হয়ে নীলাম্বরকে পৃথিবীতে আসতে হয়েছিল।
বণিক ধনপতি সদাগরের কাহিনি :-
উজানী নগরে ধনপতি সদাগর নামে এক বিলাসী যুবক বাস করত। তার প্রথমা স্ত্রী লহনা নিঃসন্তান। শ্যালিকা খুল্লনার প্রতি প্রেম আসক্ত হয়ে সে তাকে বিয়ে করে। ধনপতি সদাগরের প্রথমা স্ত্রী লহনা এ বিয়ের কথা শুনে অভিমান করেছিল। ধনপতি তাকে অনেক বোঝাল, সবশেষে লহনা একখানা পাটশাড়ি ও চুড়ি তৈরির জন্য পাঁচ তোলা সোনা পেয়ে বিয়েতে সম্মতি দিল ।বিয়ের পর খুল্লনাকে লহনার কাছে রেখে ধনপতি রাজ আজ্ঞায় সুবর্ণপিঞ্জর আনার জন্য গৌড়ে গেল। সতীনের প্রতি ঈর্ষাকাতর হয়ে লহনা খুল্লনাকে নানা প্রকার অত্যাচার করতে লাগল। বাধ্য হয়ে খুল্লনা বনে গেল ছাগল চরাতে।
সেখানে খুল্লনা চণ্ডীদেবীর পূজাপদ্ধতি শিখে নিয়ে চণ্ডীর পূজা সম্পন্ন করে। এতে চণ্ডীদেবী তার প্রতি প্রসন্ন হন। চণ্ডীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে ধনপতি সদাগর ফিরে আসে। খুল্লনার চণ্ডীর পূজা দেখে ধনপতি রেগে পূজার ঘট পায়ে ঠেলে ফেলে দিল।
খুল্লনা বনে ছাগল চরাত বলে স্বজাতিবর্গ তার সতীত্ব সম্বন্ধে সন্দেহ প্রকাশ করল। খুল্পনা সতীত্বের পরীক্ষা দিল।
তাকে জলে ডুবানোর চেষ্টা করা হল, সাপ দিয়ে কামড়ানো হল, প্রজ্বলিত লৌহদণ্ডে বিদ্ধ করা হল, শেষে তাকে জতুগৃহে রেখে আগুন দেওয়া হল—কিন্তু খুল্লনার কিছুই হল না।
সে সতী হিসেবে বিবেচিত হল। কিছুদিন পর বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে ধনপতি সিংহল যাত্রা করে। পথে কালিদহে কমলে কামিনী মূর্তি দেখতে পায়।
সেখানে এক অপরূপ সুন্দরী তরুণী পদ্মের ওপর বসে এক বিরাট হস্তী গলধঃকরণ ও উদ্গীরণ করছে। এই অপূর্ব ও আশ্চর্য দৃশ্যের কথা সিংহলরাজকে জানালে তিনি তা দেখতে চাইলেন। কিন্তু চণ্ডীদেবীর মায়ায় ধনপতি তা দেখাতে পারল না।
সিংহলে আগমনের পূর্বে ধনপতি খুল্লনা পূজিত চণ্ডীর ঘট ভেঙে দিয়েছিল বলে চণ্ডীদেবী তার ওপর ক্রোধান্বিত ছিলেন। তখন সিংহলরাজ শাস্তিস্বরূপ ধনপতিকে কারারুদ্ধ করেন।
ইতোমধ্যে খু্ল্লনার এক পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করেছে। তার নাম শ্রীমন্ত। বড় হয়ে সে পিতার সন্ধানে সিংহল যাত্রা করল। পথে শ্রীমন্তও কালিদহে কমলে কামিনী মূর্তি দেখতে পায়। কিন্তু পিতার মত শ্রীমন্তও সিংহলরাজকে তা দেখাতে পারল না। রাজা অসন্তুষ্ট হয়ে তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন।
শ্রীমন্তের স্তবে চণ্ডীদেবী সন্তুষ্ট হয়ে তাকে রক্ষা করলেন। পিতাপুত্রে মিলন ঘটল। সিংহল রাজকন্যার সঙ্গে শ্রীমন্তের বিয়ে হল তারপর পুত্র ও পুত্রবধূ সঙ্গে নিয়ে ধনপতি সদাগর দেশে ফিরে আসে।
উজানি নগরে এসে শ্রীমন্ত উজানি নগরের রাজাকে কমলে কামিনীর মূর্তি দেখিয়ে মুগ্ধ করল এবং তাঁর কন্যা জয়াবতীকে বিয়ে করল। তারপর স্বর্গভ্রষ্ট ব্যক্তিগণ স্বর্গে ফিরে গেলেন।
চন্ডীমঙ্গল কাব্যের শ্রেষ্ঠ কবিগণ :-
মানিক দত্তের চন্ডীমঙ্গল :-
চণ্ডীমঙ্গলের আদি কবি মানিক দত্ত। তবে অনেকের মতে তিনি ছিলেন মালদহের ফুলবাড়ী গ্রামের অধিবাসী। কবি প্রথম জীবনে কানা ও খোঁড়া ছিলেন। পরে ব্যাধিমুক্ত হন দেবীর কৃপায়। দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে পুঁথি রচনায় আত্মনিয়োগ করেন।মানিক দত্তের চণ্ডীমঙ্গলে ব্যাধ ও বণিকের দুটি আখ্যানই আছে। কবির বর্ণনা মতে, নিরঞ্জন থেকে সৃষ্ট আদ্যাই হলেন চণ্ডী। কাহিনী ও চরিত্র রচনায় মানিক দত্তের কাব্যে সুষম ঐক্যের অভাব আছে যথেষ্ট।
আরও পডুন :- মনসামঙ্গল কাব্যের বৈশিষ্ট্য
দ্বিজ মাধব :-
চণ্ডীমঙ্গলের পূর্ববঙ্গীয় কবিকুলের মধ্যে অন্যতম ছিলেন দ্বিজ মাধব। কবি প্রদত্ত আত্মবিবরণী থেকে জানা যায় গঙ্গা নদী পার্শ্ববর্তী ত্রিবেণীতে তাঁর জন্ম হয়েছিল।দ্বিজ মাধবের কাব্যের নাম ‘সারদাচরিত'। তবে ভণিতায় 'সারদামঙ্গল' বলেও অভিহিত করেছেন। কবিকঙ্কন পূর্ববর্তী সময়ে দ্বিজ মাধবই চণ্ডীমঙ্গলের শ্রেষ্ঠ কবি। দ্বিজ মাধব চৈতন্যোত্তর যুগের কবি ছিলেন। তার প্রমাণ যত্রতত্র বিষ্ণুপদের প্রয়োগ। চরিত্র চিত্রণেও তিনি বাস্তবতাবোধের পরিচয় দিয়েছেন।
কবিকঙ্কণ বা মুকুন্দ চক্রবর্ত্তী :-
চণ্ডীমঙ্গল কাব্যধারার জনপ্রিয় কবি হলেন বর্ধমান জেলার দামিন্যার কবি মুকুন্দ চক্রবর্ত্তী। 'কবিকঙ্কণ’ তার উপাধি।মুকুন্দের কাব্য 'চণ্ডীমঙ্গল' নামে পরিচিত হলেও তিনি ভণিতায় বারে বারে 'অভয়ামঙ্গল' নামটি উল্লেখ করেছেন।
সম্ভবতঃ ষোড়শ শতকের শেষ বা সপ্তদশ শতকের প্রথম দশকের মধ্যে 'অভয়ামঙ্গল' সমাপ্তি লাভ করে।
কবির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন বাঁকুড়া রায়। তাঁর পুত্র রঘুনাথের রাজত্বকালে কবি চণ্ডীমঙ্গল লেখেন। ‘চণ্ডীমঙ্গল’ দেবতার কাহিনী, কিন্তু কবি মুকুন্দ এ কাব্যে বেশি করে ফুটিয়ে তুলেছেন মানুষকে।
মুকুন্দ ছিলেন বাস্তবরসের অনবদ্য কারিগর। শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন —“এ যুগে জন্মগ্রহণ করিলে তিনি যে কবি না হইয়া একজন ঔপন্যাসিক হইবেন, তাহাতে সংশয়মাত্র নাই।”
উপন্যাসের অন্যতম উপকরণ হল বাস্তবতা। তবে নায়ক বা নায়িকা চরিত্র নয়, টাইপ চরিত্র রচনায় কবিকঙ্কণের সর্বাধিক সিদ্ধি। তাঁর রচিত কালকেতু, ফুল্লরা, মুরারি শীল, ভাঁড়ুদত্ত কিংবা দুর্বলা দাসী অনন্য।
গুজরাট নগরে বসতি স্থাপনে নানা বর্গের বৃত্তিধারী মানুষের ক্রিয়াকলাপের বর্ণনায় তিনি ঔপন্যাসিকের মতো নিখুঁত বর্ণনার পরিচয় দিয়েছেন।
দ্বিজ রামদেব :-
চট্টগ্রামের কবি দ্বিজ রামদেব সপ্তদশ শতকে, অর্থাৎ ১৬৫৩ খ্রী: ‘অভয়ামঙ্গল' নামে কাব্য লেখেন।রামদেবের কাব্য তিনভাগে বিভক্ত। প্রথমভাগে রয়েছে সৃষ্টিপত্তনের বর্ণনা। দ্বিতীয়ভাগে গঠিত হয়েছে কালকেতু ব্যাধের কাহিনী দিয়ে। তৃতীয়খণ্ডে মেলে বণিক ধনপতির আখ্যান।
মুক্তারাম সেন :-
কবিকঙ্কণ অর্থাৎ মুকুন্দ চক্রবর্ত্তীর কাব্যকে আদর্শ করে আঠারো শতকে যে কয়েকজন কবি চণ্ডীমঙ্গল রচনায় হস্তক্ষেপ করেছিলেন মুক্তারাম সেন তাঁদের মধ্যে একজন।'গ্রহ ঋতু কাল শশী' বা ১৬১৯ শক অর্থাৎ ১৭৪৭ খ্রীঃ তিনি কাব্য লেখেন। কবি তাঁর কাব্যের নাম দিয়েছিলেন ‘সারদামঙ্গল'। এটি একই সঙ্গে 'অষ্টমঙ্গলার চতুষ্প্রহরী পাঁচালী' নামেও পরিচিত।
ভবানীশঙ্কর দাস :-
এই কবির জন্ম আত্রেয় গোত্রীয় নরদাসের কুলীন কায়স্থ বংশে। পূর্বপুরুষ রাঢ়ের অধিবাসী হলেও কোন কারণে তাঁরা পূর্ববঙ্গে গিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন। কবির জন্ম চট্টগ্রামের চক্রশালা গ্রামে। তাঁর পিতার নাম নয়ন রায়।'মঙ্গলচণ্ডীর পাঞ্চালিকা' নামে কবির পুথিটি স্থানীয় সমাজে ‘জাগরণ' নামে পরিচিত হলেও কবি ভণিতায় বারবার ‘পাঞ্চলিকা' শব্দটির উল্লেখ করেছেন।
ভবানীশঙ্করের এই রচনা দু'একটি কারণে বিশিষ্টি। কালকেতু ও ধনপতির আখ্যান বর্ণনার আগে তিনি দেবী ভাগবতের কাহিনী উপস্থাপন করেছেন। এতে আদ্যাশক্তির সতীরূপে জন্ম, শিবের সঙ্গে সতীর বিবাহ, দক্ষ কর্তৃক শিব নিন্দা, স্বামী নিন্দা শ্রবণে সতীর দেহত্যাগ, পরে পার্বতী রূপে জন্ম, হরপার্বতীর বিবাহ, পার্বতীর পুত্রকন্যাদির জন্ম এবং অসুরযুদ্ধে দিগ্ৰসনা কালিকার আবির্ভাব ইত্যাদি চিরাচরিত কাহিনী বর্ণিত হয়েছে।
কবিরা রাঢ়ের কৌলিন্য ত্যাগ করে বারেন্দ্র সমাজভুক্তও হয়েছিলেন। কবি আখ্যানকাব্য লিখলেও গীতিকবিতার সুর প্রতিধ্বনিত করেছেন অনেকগুলি শাক্তপদ রচনা করে।
দ্বিজ মুকুন্দ :-
দ্বিজ মুকুন্দের কাব্য বর্ধমান জেলার রায়না থানার অন্তর্ভুক্ত একটি গ্রাম থেকে আবিষ্কার করেন।কাব্যের নাম 'বাসুলীমঙ্গল'। এ কাব্যে কালকেতুর আখ্যান নেই, রয়েছে কেবল বণিকের উপাখ্যানটি। কিন্তু এ বনিক ধনপতি সদাগর নয়, ধুসদত্ত।
অকিঞ্চন চক্রবর্তী :-
অকিঞ্চন চক্রবর্তী চণ্ডীমঙ্গলের সর্বশেষ কবি। মেদিনীপুরের ঘটাল মহকুমার বেঙ্গারাল গ্রামে কবির নিবাস ছিল। কবির উপাধি ছিল কবীন্দ্র। সম্ভবত আঠার শতকের শেষ ভাগে কাব্যটি রচিত হয়। কবির ভণিতা ছিল এরকম:চণ্ডীকার চরণ চিন্তিয়া অনুক্ষণ।
রচিলা কবীন্দ্র চক্রবর্তী অকিঞ্চন ॥
আজ্ঞা পায়্যা অপাঙ্গিনী আরম্ভে রজ্জন ।
রচিলা কবীন্দ্র চক্রবর্তী অকিঞ্চন ॥
0 মন্তব্যসমূহ
Please do not enter any spam link in the comment box.